রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘উস্তাদদের প্রতি অনাস্থা তৈরির কারণ চিহ্নিত করে ছাত্রদের সংশয় দূর করতে হবে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

‘শিক্ষকের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীরা’- যুগ যুগ ধরে এই খ্যাতিই প্রচলিত ধারার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কওমি অঙ্গনকে দিয়েছে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, উচ্চতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন মাদরাসায় আন্দোলন ও নানা অস্থিরতায় হঠাতই যেন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ইলমে নববীর অনন্য এবাগানগুলো- এমন অভিযোগ অনেকের।

বিষয়টি কি আসলে এমন না ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা আছে এর? আদব-কায়দা ও এর নানা দিক নিয়ে জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি, শাইখুল হাদিস মুফতী মনসুরুল হকের সাথে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের সাব-এডিটর নুরুদ্দীন তাসলিম। তিন পর্বের এই ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারটির  ২য় পর্ব  আজ তুলে ধরা হল আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য।

 

গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে আদব-কায়দার দিকগুলোতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন এ ব্যাপারে আপনার অভিমত আশা করছি?

বাস্তবেই বিষয়টি এমন। দিন দিন আদব-কায়দার অবনতি হচ্ছে। ফলে ফলাফল যা হচ্ছে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট। অথচ আকাবিরদের বক্তব্য হলো; যারা বঞ্চিত হয়, তারা কেবল আদব না মানার কারণেই বঞ্চিত হয়। যারা কিছু অর্জন করেছে তারা আদব-আখলাকের কারণেই অর্জন করতে পেরেছে। কাজেই কথাটা চরম সত্য ও বাস্তব। 

 

আদব-কায়দার মত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে শিক্ষার্থীদের এমন উন্নাসিকতার জন্য কোন বিষয়গুলো দায়ী বলে আপনি মনে করেন?

এর জন্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ দায়ী। যখন কোন মাদরাসায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটবে, তখন তার অনিবার্য ফলাফল হল ছাত্ররা বেয়াদব ও উশৃঙ্খল হবে। বর্তমানে হচ্ছেও তাই।

দ্বিতীয় আরেকটি কারণ - শিক্ষকরা মাদরাসায় ছাত্রদের মাঝে অবস্থান করেন না। ছাত্রদের মাঝে যে বিষয়ের অবনতি দেখেন সে বিষয়ে নসিহত করেন না। মাদরাসাগুলোতে এখন আর আগের মতো ইসলাহি মজলিস হয়না ।

বর্তমানে শিক্ষকরা সাধারণত মাদরাসার বাইরে কোন মসজিদে অবস্থান করে থাকেন। যে কারণে তালিমের সাথে তরবিয়ত যা কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য তা এখন খুব কমই পাওয়া যায়। তাই যে সকল উস্তাদ ইমামতি করেন, তাদের অবস্থান যদি মাদরাসায় সম্ভব হয়, তাহলে ছাত্রদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যাবে।

 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা কওমী অঙ্গনের চির ঐতিহ্যকে ( আদব-কায়দা) ফিরিয়ে আনতে আবার কী কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন, এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

কওমী অঙ্গনের চির ঐতিহ্যকে ( আদব-কায়দা) ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা বেশ কিছু কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারেন। যেমন:

১. মাদরাসাগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে আকাবির ও উস্তাদদের কর্মধারার প্রতি অনাস্থা তৈরির কারণগুলোকে চিহ্নিত করে যৌক্তিকভাবে তাদের সন্দেহ-সংশয় দূর করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত নেগরানির মাধ্যমে ছাত্রদেরকে ইলম থেকে মাহরূমের সকল উপকরণ থেকে দূরে রাখতে হবে।

২. মাসে অন্তত একবার তারবিয়াতি মাজলিসের ব্যবস্থা করতে হবে এবং আকাবিরদের জীবনী শুনাতে হবে।

৩. আদব বিষয়ে কিতাবের তালিম করতে হবে। যেমন; হযরত থানবী রহ: এর আদাবুল মুআশারাত ইত্যাদি কিতাব।

৪. আদব ইলম অর্জনের পূর্বশর্ত, এ কথা ছাত্রদের খুবই গুরুত্বের সাথে বোঝাতে হবে।

পূর্ববর্তীতের মাঝে আদবের গুরুত্ব সম্পর্কিত কিছু উক্তি বর্ণনা করতে চাই:

১. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন; আমি আমার উস্তাদ হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমানের সম্মানে তার বাড়ীর দিকে কখনো পা ছড়িয়ে বসিনি। অথচ আমার বাড়ী আর তার বাড়ীর মাঝে সাতটি গলির ব্যবধান ছিল।

২. ইমাম শাফিয়ী রহ. বলেছেন; আমার উস্তাদ ইমাম মালিক রহ.-এর দরসে কিতাবের পাতা উল্টানোর প্রয়োজন হলে খুবই আস্তে উল্টাতাম, যাতে এর শব্দ তাঁর কান পর্যন্ত না পৌঁছে।

৩. হযরত রবী বিন সুলাইমান রহ. বলেছেন; আল্লাহর কসম! ইমাম শাফিয়ী রহ. আমার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় তাঁর হাইবাতের দরুন আমি পানি পান করার সাহস করতাম না। (মা‘আলিমুল ইরশাদিয়্যাহ; পৃ;১৭২)

৪. হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ: কাবা শরীফের গিলাফ কালো হওয়ায় তিনি কালো জুতা পরিধান করতে ভয় পেতেন যদিও এতে কোন গুনাহ নেই।

৫. মাওলানা থানবী রহ: বলেন, পয়সা আল্লাহর অনেক বড় নিয়ামত এর দ্বারা দ্বীন ঈমান রক্ষা করা যায়। তাই তিনি জীবনে কখনো বাম হাতে টাকা নিতেন না এবং খানা চৌকির পায়ের দিকে রেখে খেতেন না। বরং মাথার দিতে রাখতেন।

 আদব-কায়দার মত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে শিক্ষার্থীদের এমন উন্নাসিকতা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে সামনে কি ধরনের হুমকির মুখে পড়তে পারে কওমি অঙ্গন?

 আদব-কায়দার অবনতির এই ধারা আব্যাহত থাকলে কওমী অঙ্গন নানা মাত্রিক এবং মারত্মক ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। সাম্ভব্য কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে বলতে চাই:

১. কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যাবে। স্কুল-কলেজের মত মাদরাসার ছাত্রদের আন্দোলনের ভয়ে উস্তাদরা অতঙ্কিত থাকবে। ছাত্রদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইন-কানূন প্রণয়ন করতে সাহস করবে না।

২. যোগ্য কোন আলেম তৈরি হবে না। ফলে সমাজে অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে। মূর্খ লোকেরা দ্বীনী কাজে নেতৃত্ব দিবে। এতে জন-সাধারণের গোমরাহীর পথ সুগম হবে।

৩. আক্ষরিক জ্ঞান অর্জন করলেও ছাত্রদের মধ্যে ইলমের নূর থাকবে না। ফলে এদের দ্বারা আশানুরূপ দ্বীনের কাজ হবে না।

৪. আল্লাহর সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে অল্পতেই দুশমনরা মাদরাসার বন্ধ করার সুযোগ পাবে।

৫. মাদরাসার প্রতি জনগণের আস্থা ও ভালবাসা উঠে যাবে। ফলে মাদরাসা আর্থিক সংকটে পড়বে।

৬. কিয়ামতের আগে ইলম উঠিয়ে নেওয়ার যে হাদীস আছে যে, উলামাদেরকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে সে হাদীস আল্লাহ না করূক আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হবে। মুসলিম জাতি ধ্বংস উপকরণগুলো তরান্বিত হবে। -চলবে

গত পর্বের লেখাটি পড়ুন- নতুন শিক্ষাবর্ষে যেভাবে শুরু হতে পারে কওমি শিক্ষার্থীদের দিনগুলি: মুফতী মনসুরুল হক

-কেএল


সম্পর্কিত খবর