রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভালোবাসা উপমহাদেশের মানুষের রন্ধে রন্ধে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হামিদ মীর।।

ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে ইসলামাবাদে দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে ‘ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করো’ স্লোগান দিচ্ছিলেন। এই বিক্ষোভ সমাবেশে এক নারী এক হাতে তার দুধের শিশু ও অন্য হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা উঁচিয়ে রেখেছিলেন। কোলের শিশুটি মায়ের হাতে থাকা ফিলিস্তিনের পতাকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। মায়ের কোলেই ফিলিস্তিন সম্পর্কে উপমহাদেশের একটি শিশুর জানাশোনা এভাবেই শুরু হচ্ছে।

আমি সেই নারীর কাছে গেলাম, তাকে সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, বোন!  এই সমাবেশে আপনার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন কেন?

সেই নারী দরাজ কণ্ঠে জবাব দিলেন, ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলায় ফিলিস্তিনের যেই মায়েদের কোল খালি হয়েছে তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে  আমি আমার কোলের শিশুকে এই বিক্ষোভে নিয়ে এসেছি।

এক শিশু তার মাথায় কাগজের একটি মুকুট পরেছিল, সেই মুকুটে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করো’। আমি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মুকুটে কি লেখা আছে? মেধাবী শিশুটি তাৎক্ষণিক উত্তর দিল, ‘আমি নিজের হাতেই আমার মুকুটে লিখেছি, আমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম শিশুটি ক্লাস থ্রিতে পড়ে।

সমাবেশে অংশ নেওয়া  ১৬/১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী তার বাম হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা এঁকেছে। সে জোরে জোরে ‘ইসরায়েল মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কার অনুমতি অথবা নির্দেশে এই সমাবেশে এসেছে, এছাড়া তার এই শ্লোগানে ফিলিস্তিনিদের আসলে কি উপকার হবে?

উত্তরে কিশোরীটি বললো, ‘আমি আমার বন্ধুদের সাথে সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয়েছি। ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ হচ্ছে এখন পর্যন্ত এমন তিনটি সমাবেশে অংশ নিয়েছি’।

এমন সময় সমাবেশের মাইক থেকে এক বক্তার কন্ঠস্বরে ভেসে এলো এই কবিতাটি:

ہے خاکِ فلسطیں پہ یہودی کا اگر حق

ہسپانیہ پر حق نہیں کیوں اہلِ عرب کا

তরজমা: ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইহুদিদের অধিকার থাকলে, আন্দালুসের ভূমিতে আরবদের কোন অধিকার নেই কেন ?

কবিতাটি শুনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নয় বছরের একটি মেয়ে আগের থেকেও আবেগ ও উত্তেজনা নিয়ে ‘ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করো’ স্লোগান দিতে শুরু করলো।

আমি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা  বলতো এই কবিতাটি কার? মেয়েটি মুচকি হেসে জবাব দিল, জনাব! এই কবিতাটি আল্লামা ইকবালের। আমি আমার দাদার কাছ থেকে শুনেছি যে আল্লামা ইকবাল মসজিদে আকসায় নামাজও আদায় করেছিলেন।

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বর্বরোতার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় ২১  মে পাকিস্তানে ‘ফিলিস্তিন দিবস’ পালন করা হয়েছিল।  এতে  ফিলিস্তিনের সাথে সাথে কাশ্মীরের স্বাধীনতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছিল।

আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের মানুষের রন্ধে রন্ধে ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করেছিলেন।

খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির ১৯৩১ সাল। এই বছরটি প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবালের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ বছরের ১৪ ই আগস্ট  লাহোরের একটি সমাবেশ থেকে তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে আওয়াজ তোলেন। এই বছরেরই ২৬ ডিসেম্বর আল্লামা ইকবাল মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বশীলদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে একটি কনফারেন্সে অংশ গ্রহণ করার জন্য জেরুসালেম সফরে যান।

৬ ডিসেম্বর বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কিত মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন সন্ধ্যায় আল্লামা ইকবাল বাইতুল মুকাদ্দাসে যান। প্রথমে তিনি সেখানে মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর রহমাতুল্লাহি আলাইহির কবর জিয়ারত করেন ,তারপর মসজিদে আকসায় মাগরিবের নামাজ শেষে তেলাওয়াত ও একটি কবিতার আসরে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে এশার নামাজও আদায় করেন। এরপর আল্লামা ইকবাল সবার সাথে হাত উঠিয়ে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হন যে, তিনি এই পবিত্র ভূমির হেফাজতের জন্য নিজের জীবন কোরবান করে দিবেন।

সাতদিন ধরে চলা মুসলিম নেতাদের সমাবেশে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলেন আল্লামা ইকবাল। প্রত্যেক দিনই তিনি মসজিদুল আকসায় নামাজ পড়তেন। সেখানে  তিনি বেশ কয়েকবার স্পেন বিজেতা তারেক বিন যিয়াদ রহ. সম্পর্কে লেখা তাঁর  ফার্সি কবিতাগুলো পড়ে শুনিয়েছিলেন, যেগুলো আরবিতে তরজমা করেছিলেন একজন ইরাকি আলেম।

সমাবেশ শেষে আল্লামা ইকবাল মিশরের কায়রো হয়ে হিন্দুস্তান ফিরেছিলেন; কিন্তু ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসার সাথে তার হৃদয়ের বন্ধন আমৃত্যু অবশিষ্ট ছিল।

এই সফরে এক বয়ানে আল্লামা ইকবাল বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ‘আরব নাগরিকদের নিজেদের জাতীয় সমস্যা নিয়ে ভাবার সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, যে আরব বাদশাহদের পরামর্শের উপরে ভরসা করে থাকা যাবে না, কেননা বর্তমান আরব বাদশাদের অবস্থান এমন নয় যে, তারা নিজেদের হৃদয় ও ঈমানের আলোকে ফিলিস্তিন সম্পর্কে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন’।

মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে ১৭ অক্টোবর ১৯৩৭ সালে আল্লামা ইকবাল রহ. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে লেখা চিঠিতে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি চিঠিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ শুধু ফিলিস্তিনের বিষয় এমন কিছু করবে যা ফিলিস্তিনিদের উপকারে আসবে।

১৯৩৭ সালের ৩ ডিসেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমগ্র ভারতবর্ষে ‘ফিলিস্তিন দিবস’ উদযাপন করেছিলেন।

এর আগে ১৯ জুন ১৯৩৬ সালেও ফিলিস্তিন দিবস পালন করা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, ২৬ আগস্টেও ফিলিস্তিন দিবস পালন করা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চও লাহোরে এই অঞ্চলে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের রেজুলেশনের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রেজুলেশনও পাস হয়। এ কারণেই ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকার করেননি। -(ইষৎ সংক্ষেপিত)

উর্দুভাষী  প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট হামিদ মীরের কলাম ( জিও নিউজ অনলাইন ২৪ মে ২০২১) থেকে ভাষান্তর নুরুদ্দীন তাসলিম।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ