২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে পারে আগামী ৩ জুন। বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মালয়েশিয়া থেকে একটি অনলাইন ভার্চুয়াল মিটিংয়ে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারের বাজেট হতে পারে সবচে বেশি মুল্যের। অর্থমন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের তুলনায় যা ২৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা বেশি। প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
বিশাল এ বাজেট নিয়ে কী ভাবছেন দেশের শীর্ষ আলেমরা? বাজেট বিষয়ে আলেমদের ভাবনা নিয়ে থাকছে আজকের আয়োজন। সাজিয়েছেন আওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদ।
দেশের শীর্ষ আলেম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, বাজেট হলো একটি দেশের আগামী একবছরের ব্যয় নির্বাহের জন্য জনমানুষের দেয়া টাকা খরচের পরিকল্পনা। এখানে আশা করা বাঞ্ছনীয় যে, বাজেট প্রণয়নের আগে জনমানুষের সাথে আলাপ করা হবে। আদতে তা হয় না। অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সাথে আলাপ করে, সমাজ ও বাস্তবতা বিমুখ আমলাদের দিয়ে বাজেট তৈরি করে। ফলে আমাদের বাজেটের কলেবর বাড়ে, কথার ফুলঝুরি উপচে পরে, কিন্তু কাজের কাজ কমই হয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এ নেতা বাজেট বিষয়ে ৮টি মৌলিক দাবী তুলে ধরেন। দাবীগুলো হলো:
১. বাজেট উপস্থাপনের আগে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করতে হবে।
২. কল্পনাবিলাস বাদ দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্ষমতা পরিমাপ করে সে অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া। আমরা জানি গত অর্থবছরে চিকিৎসা গবেষণায় টাকা রাখা হলেও তার কোন টাকা ব্যবহার হয় নাই। তারপরেও এবছর আবারো চিকিৎসা গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এমন উদাহরণ আরো অনেক দেয়া যাবে। সক্ষমতাহীন এমন বরাদ্দ দুর্নীতির রাস্তা খুলে দেয়।
৩. ঋণ ও অনুদান নির্ভর বাজেট থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের কোনো দেশের পক্ষে ঋণ ও অনুদান নির্ভর বাজেট শোভা পায় না।
৪. শিক্ষা ও জনসম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি, বাজেটের বরাদ্দ দেখানোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কাম্য। শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ দেখানো হয়, তার সাথে অন্যখাতও জুড়ে দেয়া হয়। আমরা মনে করি, এই চতুরতা বাদ দেয়া উচিৎ।
৫. আমরা গত বাজেটেও দেখেছি যে, বাজেটের ১৫% এর মতো অর্থ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে। এটা শোভনীয় না। এটাকে যুক্তিসংগত করতে হবে।
৬. থোক বরাদ্দ কমাতে হবে।
৭. এডিপি বাস্তবায়নের হার খুবই কম। আমলাদের অদক্ষতার কারণেই এটা হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
৮. প্রতিরক্ষা ব্যয় কমাতে হবে। দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের নাগরিককে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা না করে প্রতিরক্ষায় অস্বাভাবিক ব্যয় অগ্রহণযোগ্য। প্রতিরক্ষা ব্যয় কমিয়ে জনস্বার্থ ও সামাজিক সুরক্ষা নির্ভর বাজেট দিতে হবে। সামরিক বাহিনীর ব্যয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যৌক্তিকতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোকে একটি উৎপাদনশীল বাহিনীতে পরিণত করে গড়ে তুলতে হবে।
আওয়ার ইসলামের সাথে আলাপকালে দেশের শীর্ষ মুফতি ও ইসলামী অর্থনীতিবিদ মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, আমরা ইসলামের আলোকে বাজেট চাই। বাজেট হবে রাষ্ট্রের আয় অনুপাতে। সুদভিত্তিক কিংবা পরনির্ভরশীল কোনো বাজেট আমরা চাই না। ইসলামের আলোকে বাজেটের প্রক্রিয়া সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ইনকাম অনুপাতে বাজেট প্রদান করতে হবে। লোনের দিকে যেনো যেতে না হয়। ঋণের দিকে যেনো যেতে না হয়। দেশের নাগরিকদের প্রতি লক্ষ রেখে বাজেট প্রণয়ন করা। বাজেটটি হতে হবে দেশের নাগরিকদের জন্য কল্যাণমূলক। নৈতিক, চারিত্রিক ও মানসিক ক্ষতি হয় এমন বাজেট প্রনয়ণ না করাই হচ্ছে ইসলামের আলোকে প্রণীত বাজেট।
তিনি বলেন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা-এগুলো হলো বাজেটের মৌলিক খাত। এগুলোতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা জরুরি। এক. জরুরত। দেশের নাগরিকদের জন্য যেটা জরুরত, যা ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়-এমন বিষয়কে সবার আগে বিবেচনায় আনতে হবে। দুই. হাজত। দেশের নাগরিকদের জন্য যা প্রয়োজন। তবে এগুলো ছাড়াও মানুষ বাঁচবে। এমন বাজেট। তিন. তাহসীন (সৌন্দর্য বর্ধন)। দেশের নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনের পরে যেগুলোর মাধ্যমে সুন্দরভাবে জীবন চালাতে পারে-এমন বিষয়।
মোটকথা: এক. মানুষের জন্য কঠিন প্রয়োজন। দুই. মানুষের প্রয়োজন তবে কঠিন নয়। তিন. হলে ভালো। না হলে তেমন সমস্যা নেই। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা।
বাজেটের ক্ষেত্রে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এমন প্রশ্নের উত্তরে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, প্রাণ বাঁচানো বা জীবন বাঁচানো সবার আগে জরুরি। তারপর মানুষের অর্থের সংরক্ষণ। এরপর মানুষের মান-সম্মান, বংশ-মর্যাদার হেফাজত। অত:পর ধর্ম বা দীন বাঁচানো। সবশেষে মস্কিস্ত বা মেধার বিকাশ ঘটে এমন বিষয়ের উন্নয়ন ও মেধার ক্ষতিসাধন করে এমন বিষয়ের বিনষ্টকরণ জরুরি। এগুরো ধারাবাহিকভাবে বাজেটে স্থান পাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের পেক্ষোপট হিসেবে কোন খাত বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ? এর জবাবে মুফতি মিজান সাঈদ বলেন, বর্তমানে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের জন্যই স্বাস্থ্যখাতকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি।
এরপর হলো দারিদ্র বিমোচন। যেসব খাতে বরাদ্দ করলে মানুষের কল্যাণ হয়-এমন খাতগুলো বিবেচনায় আনতে হবে। অত:পর মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ধর্মীয় স্থাপনা তৈরি ও সংরক্ষণ বিষয়ে বাজেট ঘোষণা করতে পারে সরকার।
মুফতি মিজান সাঈদ বলেন, আমরা কখনো সরকারের কাছে মসজিদ মাদরাসার উন্নয়নকল্পে বাজেট বরাদ্দ থাকুক এমনটা বলি না। কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশ ও মুসলিম সরকার হওয়ার কারণে সরকার নিজের উদ্যোগেই মসজিদ-মাদরাসা বিষয়ে বাজটে বরাদ্দ রাখতে পারেন।
এদিকে রাজধানীর জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসার ইফতা বিভাগের প্রধান সহকারী মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম আওয়ার ইসলামকে দেয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার বলেন, অর্থনীতিতে আয় ও ব্যয়ের সমতার দিক থেকে বাজেটকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
১. উদ্বৃত্ত বাজেট: কোন নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে সরকারের রাজস্ব আয় যখন রাজস্ব ব্যয় অপেক্ষা বেশি হয়, তখন তাকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। অর্থাৎ রাজস্ব আয়ের তুলনায় যদি ব্যয় কম হয় তবেই তাকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের চলতি রাজস্ব প্রাপ্তি বেশি হলে সে বাজেটকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে।
২. ঘাটতি বাজেট: কোন নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে সরকারের রাজস্ব আয় অপেক্ষা ব্যয় অধিক হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। সাধারণত সরকার নতুন অর্থ সৃষ্টি, অতিরিক্ত কর আরোপ, অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করার জন্য উদ্যোগী হয়। দুঃখের বিষয় হল, আমাদের দেশে এই ধরনের বাজেটই বেশি হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে একবারের জন্যও ঘাটতি বাজেট সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি প্রিয় বাংলাদেশ।
৩. সুষম বাজেট: যে বাজেট সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিমাণ সমান হয় তাকে সুষম বাজেট বলে। অর্থাৎ যে বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ও ব্যয় সমান হয় তাকে সুষম বাজেট বলে। ক্লাসিক্যল অর্থনীতিবিদগণ সুষম বাজেটকে সর্বোত্তম বাজেট মনে করেন। ইসলাম মূলত এই ধরনের বাজেটের কথাই বলে।
এবারের বাজেটে কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম বলেন, প্রতি বছর দেশের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই বাজেট রচিত হয়। এবারের বাজেট আমাদের করোনার দ্বিতীয় বর্ষের বাজেট। আমরা যদি দেখি, এ সময়ে আমাদের জাতীয় প্রয়োজনগুলো কি কি, তাহলে মোটা দাগের যে বিষয়গুলো সামনে আসে সেটা হলো-
১. টিকার সংকট। এক্ষেত্রে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ না নিয়ে শুধু ভারতের উপর ভরসা করা নীতিগত ভুল ছিল। তাছাড়া নিজেরাই টিকা উৎপাদনের পথেও যায়নি। এখন সময় এসেছে নিজেরাই মানসম্মত টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া। বাজেটে এ বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।
২. চিকিৎসা সেবার সংকট। করোনায় চিকিৎসা খাতের দূর্বল অবকাঠামো উলঙ্গ হয়ে পড়েছে। এর উপর আছে এ খাতের সীমাহীন দুর্নীতি। সুতরাং এবারের বাজেটে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত।
৩. দরিদ্র সংকট: করোনায় বহু মানুষ কর্মহীন। দেশের সকল দরিদ্র মানুষের কাছে কিভাবে নগদ অর্থ পৌঁছে দেয়া যায়, দেশের জন্য তাদের কাজে লাগানো যায় এটিও বাজেটে গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
এছাড়া আয়ের উৎস হিসাবে বাজেটে সুকুক ও অন্যান্য ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতির প্রতি সরকারের আরও গুরুত্ব দেয়া উচিত। জনগণকে জাতীয় অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের এটি একটি ভালো মাধ্যম। পাশাপাশি ক্যাশ, ওয়াকফ, যাকাত এর প্রতিও গুরুত্ব দেয়া উচিত। সর্বোপরি, বাজেট বাস্তবায়ন তদারকি করতে হবে।
এদিকে দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে- বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা; কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সফল বাস্তবায়ন; কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া; অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেচ ও বীজ প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা; ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ; সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ; গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ (মুজিববর্ষের প্রধান কার্যক্রম) কার্যক্রম বাস্তবায়ন; নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু রাখা এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন।
সূত্র জানিয়েছে, করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার দেওয়া খাতগুলোর মধ্যে আছে- স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার কর্মসূচি। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগ, স্বাস্থ্যবিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুত বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয়। এই দশ খাতে আগামী বাজেটেও থাকছে সর্বোচ্চ বরাদ্দ।
এমডব্লিউ/