।।আলেমা রাবেতা হক।।
বুঝে বা না বুঝে বাঙালি মায়েরা একটি চক্রের মধ্যে ফেঁসে গেছে কিংবা ফাঁসানো হয়েছে। এর বাইরে তারা জীবনকে বুঝে না, ভাবে না। আড়ালে জীবন-জগতের বিশাল উদ্দেশ্যে হারিয়ে যাচ্ছে, তা তারা কল্পনাও করতে পারে না।
জন্মসূত্রে পূর্বপুরুষ থেকে দীন-ধর্ম শিখে আসা জাতি আমরা। ব্যক্তি পরিবার সমাজ সবকিছুতেই ইসলাম ছেড়ে বাপদাদার হালচাল খুঁজে ফিরি। তাই সময়ে সময়ে জীবনযাত্রা কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে আমাদের। চক্রের তালে চলতে পারলে জীবনে মরে হলেও বাঁচা। আর চক্রের পরিবর্তন চাইলেই সামাজিক নির্যাতনে পিষ্ট হয়ে মরার আগেই যেন মরা।
মা-বাবার ফরজ দায়িত্ব হল সন্তানকে সময় দেওয়া। সুস্থ তারবিয়াতের মাধ্যমে তার শারীরিক,মানসিক, চারিত্রিক,নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করা, যাতে সন্তান তাদের সদকায়ে জারিয়া হয়, আল্লাহর জমিনে অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ ও জাতির ইহ- পরকালীন কল্যাণের সবব হয়। বিষয়টি সবাই বুঝতে পারে না। তাই কোরআনে সন্তান ও সম্পদকে 'ফিতনা' তথা পরীক্ষার বস্তু বলা হয়েছে।
রোজগারের দায়ে পুরুষেরা বাইরে যেতে হয়। সঙ্গত কারণেই দায়িত্বটি ব্যাপকভাবে আঞ্জাম দিতে হয় মায়েদের। ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বটি সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য স্ত্রীকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে স্বামীর। 'খাওন-দাওন' চক্র থেকে বের হতে হবে। সামর্থবান হলে প্রয়োজনে বুয়া রেখে স্ত্রীর কাজের চাপ কমাতে হবে, না পারলে ঘরের কাজে নিজে সহযোগিতা করতে হবে। সাথে নিজের অতিরিক্ত চাহিদা ও প্রয়োজনকে সংকোচিত করতে হবে। নবীজি সা. ঘরে এসে আয়েশাকে (রা.) সহযোগিতা করতেন। নিজ হাতে জুতা সেলাই করতেন। কাপড়ে নিজেই তালি লাগাতেন। এককথায়, যেভাবেই হোক মা সন্তানকে সময় দিতে হবে। তার জন্য সময় বের করতে হবে।
উভয়জন বা কোন একজনের অবহেলায় সন্তান নষ্ট হলে আল্লাহর আদালতে মা-বাবার জবাবদিহি করতে হবে। এজন্য আমল, আখলাক ও মানবিক কাজকর্মের সমন্বয়ে পারিবারিক রুটিন তৈরি করা যেতে পারে। সকাল-সন্ধ্যা বাচ্চাদের নিয়ে পড়তে বসা। দৈনিক না পারলে সাপ্তাহিক নিজ ঘরে তালিমের হালকা করা। মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। নিয়মিত বাহারি আইটেম বাদ দিয়ে কর্মে বা গুণে অগ্ৰসর সন্তানকে পুরুস্কৃত করতে সাপ্তাহিক বা মাসিক স্পেশ্যাল মেন্যুর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাধ্যানুযায়ী পরিবারে স্বামী সময় দিতে হবে। না পারলে অন্তত নজরদারি করতে হবে। স্ত্রীকে সচেতন করতে হবে। দায়িত্বে অবহেলা করলে তার প্রতি জোরদার ভূমিকাও রাখতে পারেন। ইসলাম মূলত এ ধরনের পরিবারকেই প্রমোট করে।
এরকম কিছু না করে শুধু খাওনের মাতামাতি, রান্নার পীড়াপীড়ি, আচরণে বাড়াবাড়ি কিছুতেই কল্যাণকর নয়। আফসোস! পারিবারে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমরা আজও অপরিচিত রয়ে গেছি। ইসলামের সাথে সংঘাত তৈরি করে আমাদের পরিবারগুলোকে অভিশপ্ত করে রাখা হয়েছে। জানি না এ দায় কার!
পরিবার একক না যৌথ, তা মুখ্য নয়। কাজের কাজ না হলে শুধু খাওন-দাওনের একক পরিবার সমাধান নয়। পক্ষান্তরে যৌথ পরিবারেও কাজগুলো বাস্তবায়ন হলে খারাপ নয়। এতে বরং ফেসিলিটি বেশি। অসুখে, অসুবিধায় মায়ের কাজ ফুফু বা দাদি চালিয়ে যেতে পারবেন।
আরববিশ্বে বা বহির্বিশ্বের মুসলিম ধর্মভীরু পরিবারের দিকে তাকান। সন্তানকে সময় দেওয়া তাদের প্রধান ব্যস্ততা। কাজের ফাঁকে তারা সন্তান দেখে না , সন্তানকে সময় দেয়ার ফাঁকে তারা কাজ করে।
চক্রের ফাঁদে জড়িয়ে, জীবনভর লক্ষ্যহীন সময় পার করে, গাধার খাটুনি খেটে দিনশেষে বাঙালি মায়ের প্রাপ্তি বলতে কী আছে !! অবহেলার শিকার সন্তান হয় মাস্তানির আখড়া, মোবাইল, গেমসের পোকা, পরিবারের বোঝা বা অনর্থক কিছু।
পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় ইসলাম না আসা পর্যন্ত অধঃপতিত সমাজের মুক্তি নেই। মায়েরা নিপীড়িত হবে। সন্তানরা বিচ্যুত হবে। পরকালের দায় বাড়বে। জানি না, আর কতদূর গড়ালে অভিভাবকদের চোখ খুলবে। বাবারা, মায়েরা! এবার অন্তত বদলে যাও। কিছুটা বদলে নাও।
লেখক প্রধান শিক্ষিকা, মানারাতুল উলুম মহিলা মাদরাসা সিলেট।
-কেএল