।।মুফতী যায়েদ মাযাহেরী।।
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. একটি কথা লিখেছেন। যদি তালিবে ইলমরা তা মনে রাখে তাহলে তাদের অনেক ফায়েদা হবে। তিনি বলেছেন, যদি কোনো তালিবে ইলম তিনটি কাজ পাবন্দির সাথে করে তাহলে তার কিতাব বুঝে এসে যাবে। ইবারত যদি হুবহু মনে নাও থাকে তবুও তার কিতাব বোঝার মত যোগ্যতা তৈরি হয়েই যাবে।
আপনি কিতাব পড়লেন, বুঝে পড়লেন, কিন্তু পরে তা মনে থাকল না, ভুলে গেলেন। এই ভোলা কিন্তু ভোলা নয়। পঠিত বিষয় মানুষের মনের কোণে পড়ে থাকে। সময়মত তা মনে পড়ে যায়। প্রয়োজনের সময় তা মনে এসে যায়। অনেক তালিবে ইলম পেরেশান থাকে, আমি পড়ি কিন্তু মনে থাকে না, ভুলে যাই। হযরত সান্ত¡না দিয়ে বলছেন, এই ভুলে যাওয়াতে সমস্যা নেই। সময়মত তা মনে পড়বে। শর্ত হল, তিনটি কাজ পাবন্দির সাথে করতে হবে।
প্রথম কাজ : মুতালাআ
আগামীকাল দরসে যে সবক পড়া হবে তা দরসে যাওয়ার আগেই একবার দেখে যাবে। এই কাজটিকে আমরা ‘মুতালাআ’ বলি। ‘মুতালাআ’ করার এই সুন্দর রেওয়াজটি এখন প্রায় শেষই হয়ে যাচ্ছে। ‘মুতালাআ’ করার সময় কী হয়? ‘মুতালাআ’র সময় মালুমাত আর মাজহুলাতের মাঝে ইমতিয়ায হয়। এটি মুতালাআর একটি বড় ফায়েদা। যেমন আপনি হেদায়া কিতাব পড়ছেন, বলা যায়, হেদায়া কুদূরীর শরাহ। কুদূরী তো আপনি পড়েছেন। কুদূরীর যে মাসআলা আপনার পড়া আছে তা তো পড়া আছেই। এখন নতুন যে কথা হেদায়ায় আসছে, নতুন যে ইবারত ও দলীল আসছে তা আপনার বোঝা বাকি। তো মুতালাআর সময় প্রথমেই ধরা পড়বে যে, এই অংশ আমার জানা আর এই অংশ আমার জানা নেই। কিতাবের এই অংশ আমি বুঝেছি আর এই অংশ আমি বুঝিনি। معلومات আর مجهولات -এর মাঝে تميُّز । এটা মুতালার অনেক বড় ফায়দা।
প্রত্যেক ফন এমনকি প্রত্যেক কিতাব মুতালাআর তরীকা কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন হয়। নাহু-সরফের কিতাবের মুতালাআর তরীকা ভিন্ন হবে। ইবতেদায়ী মারহালার কিতাবের মুতালাআ এক ধরনের হবে আর উপরের স্তরের মুতালাআ আরেক ধরনের হবে। মুতালাআর সময় আপনাকে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রথম বিষয় হল, ইবারত সহীহ পড়া, আপনি এ‘রাব কী দিচ্ছেন এবং কেন দিচ্ছেন? فعل দিয়ে বাক্য শুরু করেছেন তো فاعل কোথায়? এটা আপনাকে হল্ করতে হবে। যদি جملة اسمية হয় তাহলে এই اسم টি مبتدأ, তো এর خبر কোথায়। যদি এক সপ্তাহ কেউ এভাবে মেহনত করে তাহলে তার এবারত হল্ হয়ে যাবে।
হযরত মাওলানা সিদ্দিক আহমদ বান্দূবী রাহ. শুনিয়েছেন, নাহু-সরফে যদি অনেক বেশি দক্ষতা না-ও থাকে তবুও তরীকামত মেহনত করলে পনের দিনে এবারত সহীহ করা সম্ভব।
এক লাইন এবারত নিন। প্রথম كلمةটি فعل । তো চিন্তা করুন এটি ثلاثى না رباعي مجرد না مزيد فيه? এটি সাত প্রকারের কোন্ প্রকার- صحيح/مهموز/معتل নাকি مضاعف? কোন্টা? এখানে কোনো تعليل হয়েছে না হয়নি? বেশি নয়, এভাবে দুই-তিন শব্দ নিয়ে চিন্তা করুন। এটি صرفي اعتبار -এ চিন্তা করা হল। এখন, نحوي اعتبار -এ ফিকির করুন যে, إعراب কী পড়া হবে? কেন পড়া হবে? এটি কি فعل না فاعل, নাفعل مجهول ?مفعول হলে نائب الفاعل কোথায়? كان এসে থাকলে তা কী আমল করছে।
نصب প্রদানকারী হরফ এসে থাকলে তা কীভাবে আমল করছে। এভাবে চিন্তা করে পড়ুন। কাজটি বেশি কঠিন নয়। যদি প্রতিদিন দশ মিনিট সময় দেওয়া হয় তাহলে এক সপ্তাহে এসকল বিষয় চিন্তা করা সম্ভব। এভাবে মেহনত করতে থাকলে আপনার এবারত পড়া ঠিক হয়ে যাবে।
এবারত সহীহ পড়ার পর করণীয় হল, فني اعتبار -এ চিন্তা করা যে, কিতাবের আলোচ্য অংশের এইটুকু আমি বুঝেছি আর সামনের অংশ আমার জন্য নতুন। এর কিছু তো আমি বুঝেছি, কিছু বুঝিনি। তো যতটুকু আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব, আপনি তা বোঝার চেষ্টা করুন। ব্যস, মুতালার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
দ্বিতীয় কাজ : দরসে উপস্থিতি
প্রথম কাজ হল, মুতালাআ। দ্বিতীয় বিষয় হল, দরসে উপস্থিতি। পূর্ণ মনোযোগের সাথে দরসে উপস্থিত থাকা। এমন যেন না হয় যে, আমি এখানে বসে আছি আর আমার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।
এই যে মোবাইল, এটা এত মারাত্মক যে, যখন মোবাইল দেখে কেবল সেই সময়টুকু নষ্ট হয় এমন নয়; বরং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে।
হযরত থানভী রাহ. বলেন, কোনো কোনো কবীরা গুনাহ অন্যসব কবীরা গুনাহ থেকে মারাত্মক হয়। এই যে চোখের গুনাহ, এটা কিন্তু মারাত্মক, অথচ কখনও তা সগীরাহও হয়ে থাকে। কখনও চোখের গুনাহ সগীরাহ গুনাহ হয় কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। বারবার তার কথা মনে পড়তে থাকে। হৃদয়-মনকে তা আচ্ছন্ন করে ফেলে, কলুষিত করে ফেলে।
রাতে মোবাইলে কিছু দেখেছিল এখন সবকে বসে সে কথা মনে পড়ছে। সবকে মনোযোগ দিতে পারছে না। মোবাইলের প্রতিক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী। এটি বিষতুল্য। আপনার উস্তায আপনাকে কতক্ষণ দেখে রাখবে? আপনার বাবা আপনাকে কতক্ষণ দেখে রাখবে? আখের আপনার নিজেরই ক্ষতি। মোবাইল থেকে বেঁচে থাকুন।
তো দ্বিতীয় বিষয় হল, দিল-দেমাগ হাজির রেখে দরসে বসা। দরসে উপস্থিত থাকা।
সবক মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং বুঝবে। বুঝে না এলে উস্তাযকে প্রশ্ন করবে। কিন্তু তা করতে হবে আদবের সাথে। যদি তিনি না বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে যান কিংবা তখন না বলতে চান তাহলে আদবের দাবি হল, তখন না জিজ্ঞাসা করে অন্য সময় জিজ্ঞাসা করবে। পরের দিন জিজ্ঞাসা করবে। দ্বিতীয়ত উস্তাযকে পেরেশান করার জন্য জিজ্ঞাসা করবেন না। যেমন, উস্তায একটি কথা বলল, আর তালিবে ইলম বলে উঠল, হাশিয়াতে বা শরহে তো এমন লেখা আছে। এটি এক ধরনের বেআদবি। এর দ্বারা আপনি ইলম থেকে মাহরূম হয়ে যাবেন।
দেখুন, উস্তাযও মানুষ। মানুষ হিসেবে তার ভুল হতেই পারে। কিন্তু সে কারণে আপনি তার সাথে বেআদবি করতে পারেন না। বলতে হলে আপনি আদবের সাথে বলুন, বিনয়ের সাথে বলুন যে, হযরত এ কথাটি বুঝে আসছে না। যদি মনে করেন যে, উস্তাযের ذهول হয়ে গেছে বা এ বিষয়টি তার মুতালাআয় আসেনি তাহলে এখন জিজ্ঞাসা না করলেন, পরে একাকী তাঁর কাছে গিয়ে আদব ও তাওয়াযুর প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য রেখে বলুন, হযরত আপনি তো এমন বলেছেন আর অমুক কিতাবে বা শরহে এমন লিখেছে। এমন তো নয় যে, আমি ভুল বুঝেছি। সর্বদা তাওয়াযুর প্রতি লক্ষ্য রাখা চাই।
কোনো কোনো মেধাবী ছাত্র উস্তাযের সামনে বড়াই করে, নিজের যোগ্যতা যাহির করে। খবরদার মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে, কিছু মুতালাআ দিয়ে কিছু হবে না। যোগ্যতার কারণে যদি উস্তাযকে খাটো চোখে দেখে তাহলে এটাই মাহরূমীর জন্য যথেষ্ট।
আদব রক্ষার এক চমৎকার ঘটনা
একবার হযরত থানভী রাহ. থানাভবনের খানকাহের মসজিদে বললেন, কারো কাছে ভাংতি দশ রুপি আছে অথবা বলেছেন, একশ রুপি আছে? এখন এটা তো মুদ্রার বদলে মুদ্রার বিনিময়। পরিভাষায় যাকে بيع الصرف বলে। আর মসজিদে বেচাকেনা নাজায়েয। কিন্তু থানভী রাহ.-এর যেহেনে তখন বিষয়টি ছিল না।
একজন পকেট থেকে ভাংতি বের করে দিবেন এমন সময় হযরতের এক মুরীদ আদব ও তাওয়াযুর সঙ্গে বললেন, হযরত! এটি بيع الصرف নয় তো? থানভী রাহ. সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হাঁ, হাঁ এটি بيع الصرف। জাযাকাল্লাহ, তুমি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছ। মসজিদে এই লেনদেন না হওয়া কর্তব্য।
তো সেই মুরীদ আদব ও তাওয়াযুর প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য রেখে জিজ্ঞাসা করার সুরতে হযরতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই আদব অনেক বড় জিনিস।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের আদবের একটি ঘটনা
একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত বিশিষ্টি নামাযে তিন রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। তখন এক সাহাবী পূর্ণ আদবের প্রতি লক্ষ্য রেখে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন-
أَقَصُرَتِ الصّلاَةُ، أَمْ نَسِيتَ يَا رَسُولَ اللهِ؟
ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ থেকে নামায কিছুটা কমানো হয়েছে নাকি আপনার মনে ছিল না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৪
কত আদবপূর্ণ সম্বোধন! কত আদবপূর্ণ জিজ্ঞাসা! বড়দের সাথে, উস্তাযদের সঙ্গে কথা বলার ধরন এমনই হওয়া উচিত। কোনো কিছু বলতে হলে, কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলে তাওয়াযু থাকা চাই। এর মাধ্যমে ইলমে বরকত হয়। মেধা দিয়ে যোগ্যতা দিয়ে কিছু হয় না।
তো দ্বিতীয়, যে বিষয়ের কথা হযরত থানভী রাহ. বলেছেন তা হল, দিল-দেমাগ হাজির রেখে দরসে বসা, দরস মনোযোগ দিয়ে শোনা, যা বুঝে আসে না, তা আদবের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া।
তৃতীয় কাজ : মুযাকারা-তাকরার
তৃতীয় বিষয় হল, দরস শেষ হওয়ার পর একবার পুনরায় তা দেখে নেওয়া কিংবা মুযাকারা করে নেওয়া। এভাবে মুযাকারা করবে- এই এবারতের অর্থ এই। এর মতলব এই। উস্তাদযী এই এবারতের এই মতলব বয়ান করেছেন। হযরত থানভী রাহ. বলেন, কোনো তালিবে ইলম এই তিন কাজ গুরুত্বের সাথে এবং পাবন্দির সাথে করলে তার কিতাব বুঝে এসে যাবে। তো আমরা এই তিন কাজ পাবন্দির সাথে করার চেষ্টা করব।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, এগুলো أسباب ظاهري বা বাহ্যিক উপায়। কোনো বিষয়েই কেবল أسباب ظاهري তথা বাহ্যিক উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার দ্বারা ترقي (উন্নতি) হয় না। এর পাশাপাশি আপনাকে কিছু باطني أسباب অবলম্বন করতে হবে। এগুলো ছাড়া ইলমে বরকত হবে না। আপনার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে না। ফয়েয জারী হবে না। মনে রাখবেন, আপনি যত যোগ্যতাসম্পন্নই হোন, যত বড় নাম্বারধারীই হোন যদি এই باطني أسباب না থাকে তাহলে আপনি কামিয়াব হবেন না। আপনার ইলমে বরকত হবে না। ফয়যের দরোজা খুলবে না। অন্যদের فيض পৌঁছানো তো দূরের কথা নিজেই ফয়েয থেকে মাহরূম থেকে যাবেন।
তো আরও তিনটি أسباب আপনাকে অবলম্বন করতে হবে, এগুলোকেই আমি باطني أسباب বলেছি-
১. উস্তাযের আদব
২. কিতাবের আদব
৩. প্রতিষ্ঠানের আদব
প্রথম বিষয় : উস্তাযের আদব
যে উস্তাযের মাধ্যমে আপনার কাছে ইলমে ওহীর ফয়েয পৌঁছুচ্ছে তাঁর কদর করুন। চারটি বিষয়-
ক. محبت
খ. عظمت
গ. إطاعت
ঘ. خدمت
সকল বড়র ক্ষেত্রেই এই চার বিষয় থাকতে হবে। উস্তাযের সাথেও, পীরের সাথেও, বাবার সাথেও, নবীর সাথেও। হাঁ, এতে স্তরভেদ হবে, তারতম্য হবে। হুদূদের রেয়ায়েত করতে হবে। শরয়ী সীমার মাঝে থেকে- মুহাব্বাত, আযমত, ইতাআত, খেদমত- এই চার জিনিস থাকলে ইলমে বরকত হবে।
হযরত সিদ্দীক আহমদ বান্দূবী রাহ. বলেন, জুমার দিন অন্যান্য ছাত্ররা তো খেলতে যেত আমি উস্তাযদের কাছে চলে যেতাম। কী করতেন গিয়ে? বলতেন, হযরত! কোনো কাজ থাকলে বলুন। কোনো উস্তাযের কাপড় ধুয়ে দিতেন, কারো কামরা ঝাড়– দিয়ে দিতেন, কারো বরতন-পাত্র পরিষ্কার করে দিতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে কত কাজ নিয়েছেন। কাজ তো হয় এভাবে।
মাওলানা উমর পালনপুরী রাহ.-এর মাধ্যমে আল্লাহ কত কাজ নিয়েছেন। উনি কি অনেক ভালো এস্তে‘দাদের অধিকারী ছিলেন? তাঁর সহপাঠী মাওলানা ইন্তেজাম ছাহেব ছিলেন আমাদের উস্তায, আমরা তার কাছে সিরাজী পড়েছি; তিনি বলেছেন, মাওলানা উমর পালনপুরী রাহ. খুব বেশি এস্তে‘দাদের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে কত কাজ নিয়েছেন।
তো ভাই! কাজের তাওফীক ও আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হওয়ার পথ তো এটা; খেদমত ও আদবের পথ। তো আপনাদের কর্তব্য, সকল উস্তাযের প্রতি আযমত ও মুহাব্বাত রাখা, তাদের খেদমত ও এতাআত করা।
আর এ আযমত ও মুহাব্বত কেবল ঐসকল উস্তাযদের প্রতি নয়, যাদের কাছে বড় বড় কিতাব পড়েছেন, বরং যাদের কাছে নূরানী কায়েদা পড়েছেন, নাজেরা পড়েছেন, তাদের প্রতিও আযমত ও মুহাব্বত থাকা কর্তব্য। তাদেরও খেদমত করা কর্তব্য।
আপনি হয়ত সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখলেন উস্তায এসে পিছনের কাতারে দাঁড়িয়েছেন সরে গিয়ে তাঁকে সামনে আসতে দিন, তাঁর মন খুশি হয়ে যাবে। এভাবেই ইলমে বরকত হয়।
হযরত থানভী রাহ. বলেছেন, তোমার কোনো উস্তাযের যদি মালী জরুরতের কথা আঁচ করতে পার, তিনি তোমার কায়েদার উস্তায হোন, নাযেরার উস্তায হোন, আরবীর উস্তায হোন, যদি তার কোনো মালী জরুরতের কথা আঁচ করতে পার আর আল্লাহ তাআলা তোমাকে সম্পদের নিআমতও দান করেছেন তাহলে গোপনে চুপচাপ তার কিছু মালী খেদমত কর। চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। আল্লাহর কসম! এভাবেই ইলমে বরকত হয়।
হযরত থানভী রাহ. কত বড় মুহাক্কিক মুসান্নিফ ছিলেন। তাঁর উস্তায শাইখুল হিন্দ রাহ. থানাভবনে আগমন করেন। তখন তার বয়ানুল কুরআন লেখার মা‘মূল ছিল। উস্তাযকে বসিয়ে তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে বললেন, হযরত আমি একটু সময়ের জন্য আসছি, উস্তাদযী অনুমতি দিলেন। যাও, মা‘মুল পুরো কর, তাহলেই আমি খুশি হব। তিনি গিয়ে এক লাইন লিখে আবার ফিরে আসলেন। শাইখুল হিন্দ রাহ. জিজ্ঞাসা করলেন কী ব্যাপার তুমি তো গিয়েই ফিরে এলে? তিনি বলেন, হযরত এখন আপনার খেদমতে বসতে পারছি এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে। কিতাব তো লেখা হতেই থাকে। ‘নাগাহ’ যেন না হয় সেজন্য এক লাইন লিখে চলে এসেছি।
তো ভাই! এই খেদমত অনেক বড় জিনিস। উস্তাযের কাছে যাওয়া উচিত। তার খেদমত করা উচিত। কাপড় থাকলে ধুয়ে দিলেন, কামরা ঝাড়– দিয়ে দিলেন। সম্ভব হলে মালী খেদমতও করা কর্তব্য।
এ তো গেল এক দিক। বিপরীত দিক? যদি উস্তাযের না-কদরি করা হয়? এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। ‘পুরানে চেরাগ’-এ সায়্যিদ সুলায়মান নদভী রাহ.-এর সাথে এক তালিবে ইলমের বে-আদবীর ঘটনা আছে। ঘটনা অনেক লম্বা। এখন বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। ছেলেটি ছিল বেশ মেধাবী। পড়াশুনায় অনেক ভালো ছিল। চমৎকার আরবী বলতে ও লিখতে পারত। নদওয়ার শীর্ষ ছাত্র ছিল। সায়্যেদ সুলাইমান নদভী রাহ.-এর সাথে বেআদবী করে। হযরত অনেক কষ্ট পান। কিছুদিন পর ছেলেটা পাগল হয়ে যায়। দুই হাতে রশি বেঁধে ছেলেটাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেসময় নদওয়ার নাযেম ছিলেন ডা. আবদুল আলী ছাহেব। তিনি সায়্যেদ ছাহেবকে বলেন, এ ছেলের উপর আপনার বদদুআ লেগেছে আপনি তাকে মাফ করে দিন। তিনি জবাবে চুপ করে থাকেন, কোনো উত্তর দেননি সেদিন। পরের দিন তিনি ডা. ছাহেবকে বলেন, আমি আপনার কথা মেনে নিয়েছি। অর্থাৎ আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বেআদবীর এই প্রতিক্রিয়া কখনো তৎক্ষণাত হয়, কখনো ধীরে ধীরে হয়। কখনো পাঁচ বছর-দশ বছর পর প্রকাশ পায়।
নদওয়ার একজন উস্তায, ছাত্রজীবনে আমার সহপাঠী ছিল, সে আমাকে বলেছে, আমি খাবার রেখে গিয়েছি, এসে দেখি ছেলেরা আমার খাবার খেয়ে ফেলেছে। এরপর বলেন, একবার আমিও আমার উস্তাযের সাথে এরকম করেছিলাম। উস্তায খাবার রেখে গিয়েছিলেন, আমি খাবার খেয়ে ফেলেছিলাম। যে যেমন করবে সে তেমনই ফল পাবে-‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। এই ঘটনার ফলে তার নিজের জীবনের ঘটনা মনে পড়ে গেছে।
আমাদের ছোটরা আমাদের পেরেশান করে, শাগরেদরা পেরেশান করে, ছেলে-মেয়েরা পেরেশান করে, এগুলো থেকে যদি বাঁচতে চান তাহলে নিজের বড়দের কদর করুন।
তো বাতেনী আসবাবের মধ্যে একটি হল, উস্তাযের কদর করা। উস্তাযের আদব রক্ষা করা, তাঁর খেদমত করা, আনুগত্য করা।
যে যেমন করবে সে তেমনই পাবে। উস্তাযকে খোশ রাখার চেষ্টা করবেন, উস্তাযকে নারায করবেন না। ভুল তো সবারই হয়। পিতার ভুল হয়, উস্তাযের ভুল হয়, শায়েখের ভুল হয়। কিন্তু বড়দের ভুল ছড়ানো যায় না, প্রচার করা যায় না। অন্যদের বলা যায় না, বদনাম করা যায় না।
الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ
মুমিন মুমিনের আয়না। আয়নায় কেবল নিজেকে দেখা যায়। আয়না আপনার সামনেই কেবল আপনার চেহারা প্রকাশ করে, আপনার চেহারার ত্রুটি-বিচ্যুতি-খুঁত কেবল আপনিই দেখতে পারেন, অন্য কারো সামনে তা প্রকাশ করে না, অন্যদের কাছে বলেও বেড়ায় না। মুমিনও অন্য মুমিনের দোষ মানুষের কাছে প্রকাশ করে না, মানুষকে বলে বেড়ায় না। বললে কেবল তাকেই বলে।
দ্বিতীয় বিষয়
দ্বিতীয় বিষয় প্রতিষ্ঠানের আদব। প্রতিষ্ঠানের কদর করুন। যে প্রতিষ্ঠানে আপনি পড়ছেন, যে প্রতিষ্ঠান আপনাকে এ পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের কদর করুন। প্রতিষ্ঠান আপনার মুহসিন। প্রতিষ্ঠানেরও অবদান আছে আপনার প্রতি। আপনার উপর প্রতিষ্ঠানের হক আছে। প্রতিষ্ঠানের হেফাজতের চিন্তা করা উচিত। কখনো হয়ত প্রতিষ্ঠান কোনো সমস্যায় পড়ল, প্রতিষ্ঠানের গায়ে কেউ আঁচড় দিতে চাইল, আপনি তা প্রতিহত করতে পারেন, আল্লাহ তাআলা হয়ত আপনাকে সেই সামর্থ্য দিয়েছেন, আপনি এগিয়ে আসুন। প্রতিষ্ঠানের হেফাযতে অবদান রাখুন। এটি হল প্রতিষ্ঠানের কদর। এধরনের কাজের দ্বারা ইলমে বরকত হয়।
প্রতিষ্ঠানেরও ভুল হতে পারে। কিন্তু তাই বলে আপনি সেটা বলে বেড়াবেন না। প্রতিষ্ঠানের সাথে বে-আদবী করবেন না। ভুল তো নিজের পিতারও হয়, নিজের ঘরেও ভুল হয়। কিন্তু ঘরের ভুল মানুষ মানতে পারে, আর মাদরাসার কোনো ভুল হলে তা মানতে পারে না। অভিযোগ-আপত্তি শুরু হয়ে যায়। এগুলো মাহরূমীর আলামত।
তৃতীয় বিষয়
তৃতীয় বিষয় آلات العلم বা ইলম হাসিলের উপায়-উপকরণের আদব। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, কলম, কাগজ, খাতা-পত্র, কিতাবাদি প্রভৃতি। কিতাবাদি অযতেœ ফেলে রাখা, কিতাবের উপর প্লেট-বাটি রাখা, পত্রিকা রাখা- এগুলো ঠিক নয়। অযুর সাথে মুতালাআর চেষ্টা করা।
তো এই তিনটি বাতেনী আসবাবের প্রতি লক্ষ্য রাখলে ইনশাআল্লাহ ইলমে বরকত হবে। আল্লাহ কবুল করবেন। ফয়েয জারী হবে।
এখানে তিনটি জাহেরী আসবাবের কথা বলা হয়েছে। আর তিনটি বাতেনী আসবাবের কথা বলা হয়েছে। উভয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কেবল বাতেনী আসবাব গ্রহণ করল; খেদমত করতে থাকল উস্তাযদের কিন্তু পড়াশোনায় মনোযোগ নেই, মেহনত নেই- কাজ হবে না। আবার শুধু পড়াশোনায় মেহনত করল বাতেনী আসবাব গ্রহণ করল না- তাও কাজ হবে না। উভয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। জাহেরী-বাতেনী উভয় আসবাবের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। সূত্র-মাসিক আলকাউসার
-কেএল