নুরুদ্দীন তাসলিম।।
দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরই মার্চের ১৭ তারিখে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর কয়েক দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ এই ছুটি গড়ায় ৩০ মে পর্যন্ত। এতে বাধ্য হয়েই ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়া করোনা মহামারী কারণে নানান বাধ্যবাধকতায় বিনোদন কেন্দ্র পার্ক ও খেলার মাঠগুলোতেও যেতে পারছে না শিশু-কিশোররা।
তবে ঘরবন্দি সময়ে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল-এর মত স্মার্ট ডিভাইস গুলোতে সারাদিন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে শিশু-কিশোররা। এতে নানান মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেক অভিভাবকই অভিযোগ করছেন, এতে করে সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া, স্বাভাবিক চলাফেরা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আচরণেও লক্ষ করা যাচ্ছে বেশ অস্বাভাবিকতা, এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে থাকেন মোহাম্মদ ওসমান গনি, চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, করোনা মহামারীর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আর দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি বাড়ানোর ঘোষণাতে নিজের সাত বছরের সন্তান ইমরানকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলছিলেন, আগে দিনের বড় একটা সময় স্কুলে কাটতো, এরপর বাড়িতে ফিরে কিছুটা খেলাধুলা, আবার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা, এরপর হালকা টিভি দেখে ঘুমিয়ে যেত। তবে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার কারণে তার রুটিনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে, সারাদিন মোবাইল ফোনেই বুঁদ হয়ে থাকছে, পড়াশোনার প্রতি এসছে পুরাই অমনোযোগিতা। এখন পড়তে বসতে বললেই বলে-‘ সারাদিন কত পড়া যায়’।
আরো পড়ুন: মাদরাসা ছাত্রদের মোবাইল ব্যবহার: বছরের শুরুতেই কঠোর হওয়ার পরামর্শ শিক্ষাবিদদের
মোহাম্মদ ওসমান গনির মতো রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকেই অভিযোগ করছেন, রাত জেগে মোবাইল ফোনে সময় দিচ্ছে সন্তানেরা। এতে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু তাদের বলেতো আর বোঝানো যাচ্ছে না, আবার বাইরেও বের হতে না পারায় খুব বেশি শাসনেও রাখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ঘরবন্দি শিশুদের মাঝে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। এর ফলে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, অবসাদগ্রস্ততা পড়াশোনায় অমনোযোগিতা এর মাঝে অন্যতম।
তিনি বলছিলেন, ‘গেমস খেলতে না দেওয়ায় মায়ের সাথে অভিমান করে শিশুদের আত্মহত্যার খবরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচার হচ্ছে। স্মার্ট ফোনে শিশুদের এই আসক্তি মাদকদ্রব্য থেকেও থেকেও মারাত্মক।’।
তিনি আরো বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের আড্ডা বেড়েছে এতে করে কিশোর গ্যাং এবং শিশু অপরাধগুলো বাড়ছে, যা আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দিচ্ছে । এসব অবশ্যই আমাদের ভালো কোন বার্তা দেয় না
আরো পড়ুন: কওমি মাদরাসা রাজনীতি মুক্ত থাকবে: ব্যাখ্যায় চার বুদ্ধিজীবী আলেম
তার মতে, পরিস্থিতির নাজুকতা বিবেচনা করে নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই অভিভাবকদের শিশু-কিশোরদের প্রতি বিশেষ নজরদারি চালু রাখা প্রয়োজন।।
এদিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফয়সাল আহমেদ বলছেন, বর্তমানে স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত ঘরবন্দি শিশু-কিশোররা নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, নির্দিষ্ট করে কোন একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা বেশ দুষ্কর। তবে এসব ডিভাইসের কারণে শিক্ষার্থীরা সবথেকে বেশি মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তাদের মাঝে ভালো কাজের ক্ষেত্রে অনীহা প্রকট আকারে দেখা যাচ্ছে। এ কারণে পড়াশোনাও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এবং অভিভাবকদের কোথাও শুনতে চাচ্ছে না তারা।
তিনি বলছেন, বাইরে বের হতে না পারার কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে শিশুদের। সবমিলিয়ে বর্তমান ঘরবন্দী স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেই মতামত দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলছেন, সরাসরি স্কুলগুলোতে একের পর এক ক্লাস চলতে থাকতো তবে বর্তমানে ভার্চুয়ালি ক্লাসগুলোতে একের পর এক ক্লাস হচ্ছে না, আবার এক শিক্ষক ক্লাস করালে আরেক শিক্ষক ক্লাস করাচ্ছেন না। দেখা যাচ্ছে, অভিভাবকরা হয়তো ৩ ক্লাসের জন্য এমবি কিনে দিয়েছেন, এক ক্লাসের পর বাকি দুই ক্লাস হচ্ছে না, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অভিভাবকদের তা না জানিয়ে গেমসসহ ইন্টারনেটের অন্যান্য মাধ্যমগুলোতে জড়িয়ে পড়ছে। তার মতে, শিশুদের স্বভাবটাই এমন, তাই এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের মনিটরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- বলছেন তিনি।
তিনি আরো বলছেন, টানা পনের/ বিশ মিনিটের থেকে বেশি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তা চোখের সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকের তো চশমা ব্যবহার করার পর্যায়ে নিয়ে যায়, আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটা প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরো পড়ুন: ছুটিতে কী করবেন শিক্ষার্থীরা?
এ ছাড়া, স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটে গেমসে বুঁদ হয়ে থাকার কারণে শিশুদের মস্তিষ্কেে বেশ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তা। তাদের খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সবকিছুর মাঝে নেশার মতই গেমস-এর প্রভাব বিস্তার করছে। ধূমপান এবং মাদক গ্রহণের নেশার মতো এটাও নেশায় পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। তার মতে, শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষার স্বার্থেই বর্তমানে গণপরিবহনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে সাহস করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়াই এ থেকে পরিত্রাণের অন্যতম পথ হতে পারে।
তিনি আরো যোগ করেন, গত আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় আট মাস আবাসিক ব্যবস্থাপনায় চালু ছিল কওমি মাদরাসাগুলো। এতে খুব একটা সমস্যা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি, তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার দাবী জানান তিনি।
আরো পড়ুন: অনলাইনে ইফতা কোর্স: হুমকির মুখে ফতোয়া বিভাগ
তিনি আরো বলছেন, ইন্টারনেট, ফেসবুক এবং ইউটিউবে ভালো মন্দ সব কন্টেন্টই বিদ্যমান, তবে শিশু-কিশোররা যেন মন্দ কনটেন্টগুলো থেকে বাঁচতে পারে এজন্য অভিভাবকরা তাদের মনিটরিং করতে পারেন অনেকটা বন্ধু সেজে, প্রয়োজনে কিছুটা গোয়েন্দাগিরিও করতে পারেন শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে বিভিন্ন কারণে ও শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, এক্ষেত্রে অধ্যাপক গোলাম রব্বানীর পরামর্শ হচ্ছে, অভিভাবকরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব কোন আইডি খুলতে না দিয়ে নিজেদের আইডিগুলোই ব্যবহার করাতে পারেন এতে তাদের প্রতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বলে মত দিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুঠোফোন সব সময় ঠিক জায়গায় আছে কিনা তা নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকে। মোবাইল হারানোর ভয় থেকে মনের মধ্যে জন্ম নেয় এক ধরনের মানসিক সমস্যা। গবেষকরা মুঠোফোন হারানোর এই ভয়জনিত অসুখের নাম দিয়েছেন ‘নোমোফোবিয়া’। যার পুরো নাম ‘নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া’। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ৫৩ শতাংশ এবং ২৯ শতাংশ ভারতীয় তরুণরা এ রোগের শিকার। ৫ বছর আগেও এই রোগের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়নি। এই রোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে চিন্তিত মনোবিজ্ঞানী-মহল।
২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারী শুরুর পর ইউনিসেফ শিশুদের নিয়ে একটা গবেষণা প্রকাশ করে৷ সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে৷
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম