মোস্তফা ওয়াদুদ ও আব্দুল্লাহ তামিম
আরবি প্রবাদ আছে ‘মাউতুল আলিম মউতুল আলম’-একজন আলেমের মৃত্যু মানে একটি পৃথিবীর মৃত্যু। গত এক মাস আঠার দিনের মাঝেই আমরা হারিয়েছি বিশ্বখ্যাত তিন তারকা আলেমকে। যারা ছিলেন ভারত উপমহাদেশের ইলমী রাহবার। দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ সিপাহসালার। উম্মাহর দরদী বিশ্বখ্যাত সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা। যাদের ত্যাগ ও ইলমী খেদমাত বিশ্ববাসী কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে আজীবন।
গত ২০২০ ছিলো আমুল হুজুনের বছর। শোকের বছর। বাংলার শীর্ষ আলেমদের হারানোর বছর। আর ২০২১ শুরু হয়েছে বিশ্ব আলেমদের বিদায় দিয়ে। দেশের জনগণের শোকে কাতরের বছর। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ আলেম হারানোর বেদনায় মর্মাহত। কোটি জনতার হৃদয়ের মানুষগুলো বিদায় নিয়েছে এ বছর।
যারা মানুষকে ডাকতো হকের পথে। শোনাতো কুরআনের বাণী। পৌঁছাতো রাসূলের কথা। যাদের হৃদয়গ্রাহী আলোচনা শুনে দীনের পথ লাভ করতো এদেশের কোটি কোটি মানুষ। হেদায়াতের আলোয় আলোকিত হতো মানুষের চিত্ত-মন-হৃদয় ও অন্তর। কিন্তু এখন থেকে তারা আর কোনোদিন মানুষকে নামাজের জন্য ডাকবেন না। শোনাবেন না হেদায়াতের বাণী। তাদের দরদমাখা নসিহত আর আমাদের কর্ণকুহরে বেজে উঠবে না।
এক. বিখ্যাত আদীব মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী রহ. (১৯৫২-২০২১) ইংরেজি
গত ৩ এপ্রিল সোমবার রাত ৩ টা ১৫ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন দারুল উলুম দেওবন্দের বিখ্যাত আদীব আল্লামা নূর আলম খলীল আমিনী রহ.। ইন্তোকালের আগে মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী রহ. ১৫ দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। অক্সিজেন লাগানো হয়েছিল, প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে মৃত্যুর দুইদিন আগে কিছুটা সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু পরদিন দুপুর থেকে তার শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হলে মধ্যরাতের দিকে তিনি দেওবন্দে নিজের বিশ্রামাগারে ইন্তেকাল করেন।
তিনি ছিলেন আরবি ম্যাগাজিন ‘আদ-দাঈ’ এর চিফ এডিটর। মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনী রহ. দারুল উলুম দেওবন্দে তিন দশক ধরে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছিলেন। এছাড়াও তিনি হিন্দুস্তান থেকে প্রকাশিত মাসিক আদ দাঈ ম্যাগাজিনের চিফ এডিটর ছিলেন।
তিনি আরবি উর্দূ দুই ভাষাতেই প্রায় ১০টির মত কিতাব লিখেছেন এবং কিতাবগুলোও আহলে ইলমের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়।
তাঁর তার লিখিত বই ‘فلسطین في انتظار صلاح دين’ (ফিলিস্তিন ফি ইন্তিজারি সালাহিদিন) আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এছাড়া তার مفتاح العربية (মিফতাহুল আরব) বইটি বিভিন্ন মাদরাসায় দরসে নিজামির সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত।
তিনি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালের বাইরে আরব ও ইউরোপের দেশগুলোতেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তার আরবি কিতাবগুলো আরব দেশের পাঠকরা খুব আগ্রহভরে পড়েন। বিশ্বজুড়ে তার অসংখ্য শাগরিদ রয়েছে।
মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনী রহ. বিহারের সীতামরাহী জেলার রায়পুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৫২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট অফ অনার লাভ করেন।
স্ত্রী, তিন ছেলে ও কন্যা সন্তান রেখে ইন্তেকাল করেছেন মাওলানা খলিল আহমদ আমিনী রহ.। তার জানাজা ও দাফন কাফন সম্পন্ন হয়েছিলো দারুল উলুম দেওবন্দেই। তার ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে তার ভক্তকূল ও বিশ্বব্যাপী থাকা তার শাগরেদদের।
দুই. ইবনে হাজার ছানী মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী রহ. (১৯৪৪-২০২১) ইংরেজি
গত ১৪ এপ্রিল (৩০ রমজান) বৃহস্পতিবার ভোর সকালে ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রবীণ উস্তাদ ইবনে হাজার ছানীখ্যাত মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমী রহ.। সম্প্রতি তিনি তার নিজ শহর আজমগড়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা দারুল উলূম দেওবন্দের সম্পাদক ছিলেন মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমী রহ। তিনি আসমাউর রিজাল সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমী রহ ইতিহাসের প্রতি গভীর নজর রেখেছিলেন। ইসলামের ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ের অনেকগুলো বই রচনা করেন তিনি। জনসাধারণের মধ্যে তার বইগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিলো।
তিন. আমীরে হিন্দ মাওলানা কারি উসমান মানসুরপুরী রহ. (১৯৪৫-২০২১) ইংরেজি
সবশেষে চলে যাওয়ার এ মিছিলে যোগ হোন আমীরে হিন্দ কারী সাইয়েদ উসমান মানসুরপুরী। গতকাল শুক্রবার (২১ মে) জুমার নামাজের পর (দুপুর দেড়টায়) তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের কার্যনির্বাহী মুহতামিম। দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. এর ইন্তেকালের পর তিনি বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের কার্যনির্বাহী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হোন।
ভারতের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের (একাংশ) সভাপতিও ছিলেন তিনি। এর আগে ৫ মে (বুধবার) তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কারী সাইয়েদ উসমান মানসুরপুরী শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর সুযোগ্য জামাতা। অল ইন্ডিয়া মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়াতের সদর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
এমডব্লিউ/