সাঈদ আহমাদ খান নদভি
দারুল উলুম দেওবন্দের মোহতামিম হজরত মাওলানা কারি সাইয়্যিদ উসমান মানসুরপুরী রহ.'র ইন্তেকালে হজরত মাওলানা সাইয়্যিদ সালমান হুসাইনি নদভি গভীর শোক প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, হজরত মাওলানা কারি সাইয়্যিদ উসমান মানসুরপুরী আমাদের বংশেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন৷ তিনি ছিলেন আমার সম্মানিত চাচা৷ সেই ১৯৬১/৬২ সনের কথা৷ তখন আমি মানসুরপুরে হাফেজ সাজেদ সাহেবের কাছে হিফজ পড়তাম৷ তখন থেকেই হজরত মরহুম কারি সাহেব আমাকে অত্যন্ত মুহাব্বত করতেন৷ সব সময় আমার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন৷
আমার দাদার বংশধরগণ মূলত মানসুরপুরেই ছিলেন৷ আমার দাদা হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ ইউসুফ হুসাইনি রহ. হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.'র অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন৷ পরবর্তিতে হজরত মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভি রহ.'র নির্দেশে এবং হজরত মাওলানা আব্দুল কাদের রায়পুরি রহ. ও হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.'র পরামর্শে আমার পিতা মাওলানা সাইয়্যেদ তাহের হুসাইনি রহ. লাখনৌর হাসানি খান্দান, নদওয়াতুল উলামার তৎকালীন মহাপরিচালক মাওলানা ড. আব্দুল আলি রহ.'র মেয়েকে বিবাহ করেন৷ আব্বাজান মরহুম মাওলানা তাহের হুসাইনি রহ. এবং আমার মামা উস্তাদে মোহতারাম মাওলানা সাইয়্যেদ রাবে হাসানি নদভি দা.বা.'র বিবাহের খুৎবা পড়েন একই দিনে একই সাথে লাখনৌর পাকাড়িয়া মসজিদে হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.৷ এভাবে হাসানি ও হুসাইনি দু'টি পরিবার একই সূত্রে গেঁথে যায়৷
এরপর থেকে আব্বাজান লাখনৌতেই বসবাস করতে থাকেন৷ হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. বিভিন্ন কাজে দেওবন্দ থেকে লাখনৌ আসলে আমাদের বাসাতেই থাকতেন৷ হজরত মাওলানার আগমনে আমাদের পুরা এলাকা জমজমাট হয়ে উঠতো৷
আমার আম্মা হজরত সাইয়্যেদা ফাতেমা থেকে শুনেছি, আমার বয়স যখন দুই- আড়াই বছর, আমার বাবা আমাকে হজরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ.'র কাছে নিয়ে যান৷ হজরত মাওলানা আমাকে কোলে নিয়ে দুআ দেন৷
হজরত মাওলানা মরহুম কারি সাইয়্যিদ উসমান মানসুরপুরি সাহেব ইলম, আমল ও আখলাকে আমাদের পুরা বংশে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ তাঁর আখলাকে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. তাঁর কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেন৷ এভাবে হুসাইনি পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে আরো গভীরতর হয়৷
এক সময় কাতারের এক প্রগ্রামের জন্য উস্তাদে মোহতারাম ড. ইউসুফ কারজাভি আমাকে দাওয়াত দেন৷ এবং হিন্দুস্তানের আরো কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যেতে বলেন৷ আমি মরহুম চাচা কারি উসমান সাহেব এবং মাওলানা আরশাদ মাদানিকে দাওয়াতের কথা জানালে তারা সাদরে গ্রহণ করেন৷ এবং একই সাথে আমরা কাতারে সফর করি৷
চাচাজান মরহুম মাঝে মাঝেই লাখনৌতে আমাদের বাসায় আসতেন৷ অত্যন্ত ভালোবাসার সাথে নিজেকে পেশ করতেন৷ আল্লাহ তাআলা তাঁকে ইলম, আমল ও আখলাকের এমন বৈচিত্র দান করেছিলেন যে, তাঁর নমুনা পাওয়া দুষ্কর৷ তাঁর কথা ও ব্যবহারে যেনো মিষ্টি ঝরে পড়তো৷
আল্লাহ তাআলা তাঁকে দৈহিক এতোটাই সৌন্দর্য দিয়েছেন, মনে হতো যেনো হজরত ইউসুফ আ.'র সৌন্দর্যের কিয়দাংশ হলেও তাঁর গঠনে বিদ্যমান৷ তেলাওয়াত এতোটাই তারতিল ও সুমধুর ছিলো যে, হজরত দাউদের কণ্ঠস্বর যেনো তাঁর কণ্ঠে এসে মিশে যেতো! ইলম, আমল, সৌন্দর্য আর বংশের এতোসব সমষ্টি থাকা সত্ত্বেও আখলাকে এতোটাই নমনীয় ছিলেন যে, ছোটো- বড় সকলের সাথে খুবই মধুরতার সাথে ব্যবহার করতেন৷ জীবনে হয়ত কোনো দিন কারো দোষ- ত্রুটি বর্ণনা করতেন না৷
কারো দোষ শুনতেও চাইতেন না৷ তাঁর এই আখলাকের কথা আমাদের খান্দানসহ পুরা দেওবন্দেই প্রসিদ্ধ ছিলো৷ তাই তিনি ছাত্র, শিক্ষক সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন৷ শেষ জীবনে আল্লাহ তাআলা তাঁকে দারুল উলুম দেওবন্দের মোহতামিম পদে সমাসীন করেন৷ এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আমির নিযুক্ত হয়ে আমিরুল হিন্দ লকবে ভূষিত হন৷
দেওবন্দের উস্তাদ হওয়ার পর থেকে তাদের বাসায় আমার মাঝে মাঝেই যাওয়া হতো৷ আমাকে খুবই ভালোবাসতেন৷ স্নেহ করতেন৷ তার সবচে' বড় সৌভাগ্যের একটি হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর সন্তানদ্বয় মাওলানা সাইয়্যিদ সালমান মানসুরপুরী এবং মাওলানা সাইয়্যিদ আফফান মানসুরপুরীকে দ্বীনের মহান খাদেম হিসেবে কবুল করেছেন৷ সেই ছোটোবেলাই দেখতাম চাচাজান তাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পড়াতেন৷ তাদের তরবিয়াতের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন৷ তাদের সাথে আমার সম্পর্ক হৃদয়ের গহীনের৷ দুআ করি আল্লাহ আমাদের এ সম্পর্ককে স্থায়ি করুন! তাদেরকে ধৈর্য্য ধারণ করার তৌফিক দিন!
মরহুম হজরত মাওলানা সাইয়্যিদ কারি উসমান রহ. রমজান থেকেই অসুস্থ ছিলেন৷ ডাক্তারদের ভাষ্য মতে, তাঁর শরীরে করোনা পজিটিভ ছিলো৷ দীর্ঘ দিন অসুস্থতার জীবন কাটিয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান পরপারে৷ জান্নাতে আল্লাহ তাঁর মাকাম বুলন্দ করুন! তাঁর পরিবারকে সবরে জামিল নসিব করুন! আমীন!
-এটি