সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

ঈদ ও বঙ্গদেশে ঈদের ঐতিহাসিকতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোহাম্মদ ইমরান।।

যে সব আনুষ্ঠানিক উৎসব মুসলমানদের অস্তিত্বের জানান দেয় ‘ঈদ’ তার অন্যতম। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি। যা আওদ্ থেকে উৎকলিত। এর শাব্দিক অর্থ ঘুরে ঘুরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। প্রচলিত অর্থে ঈদ মানে আনন্দ বা খুশি। যেহেতু এ আনন্দ বছর ঘুরে ফিরে আসে এজন্য ঈদকে ‘ঈদ’ বলে নামকরণ করা হয়েছে। মুসলমানদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ঈদ। বছরে পালিত হয় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি উৎসব।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, কিন্তু আয়োজন-প্রয়োজনে ব্যাপকতর। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঘোষিত উপহার।

ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদ-উল- ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উৎসব উদযাপন। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু’টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা এ মেলায় অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কাজে মেতে ওঠতো। একই সাথে মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায়ও মেতে উঠত তারা। সেগুলো ছিল উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলোশ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদআনন্দ। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর।

ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সাথে যোগ হয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। তাই ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। ঈদের সাথে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সাথে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ, পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ।

ঈদের পরিচিতি
সর্বাধিক মহিমান্বিত ও সাওয়াবে ভর্তি মাস পবিত্র রামাদ্বানের পরেই চন্দ্র বর্ষের দশম মাসের সূচনা দিনের মধ্য দিয়েই মাহে সাওয়ালের আগমন। সাওয়ালের বাঁকা চাঁদ বয়ে আনে মুমিন মুসলমানের আনন্দ উৎসবের এক গুচ্ছ স্লোগান

ঈদ ঈদ ঈদ!
হে! মোবারক ঈদ!
তুমি আসবে বলে
চোখে নেই নিদ।
অর্থাৎ দীর্ঘ একমাস পবিত্র সিয়াম সাধনার পর সাওয়ালের প্রথম দিনে ইসলামী শরীয়তের প্রণেতা মুসলমানদের জন্য যে উৎসব নির্ধারণ করেছেন তা-ই হচ্ছে ‘ঈদুল ফিতর’। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায়- ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।’’ অপরদিকে চন্দ্র বছরের প্রান্তিক মাস হল জিলহজ্জ। এ মাসের দশম তারিখে পশু জবেহ করার মাধ্যমে যে উৎসব পালন করা হয় তা হচ্ছে ঈদুল আদ্বহা বা কুরবানীর ঈদ। উভয় ঈদের ঘোষণা আল্লাহর হাবীব রহমতে আলম সা. দ্বিতীয় হিজরী সনে জারী করেন।

ঈদের সূচনায় রাসূলে আরাবী বর্ণনা
ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায় মদীনাবাসী জাহেলী যুগ থেকে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘ মেহেরজান’ নামে দু’টো উৎসব পালন করতো। যা ছিল ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যহীন। এ ব্যাপারে খাদিমুল রাসূল হযরত আনাস রাদ্বি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (৬২২ খৃষ্টাব্দে) পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় তাশরীফ আনলেন, তখন তাদেরকে (বৎসরে) দু’দিন খেলাধূলা করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এ দু’দিন কিসের? সাহাবাগণ জবাবে বললেন, জাহেলী যুগে আমরা এই দুই দিবসে খেলাধূলা বা আনন্দ প্রকাশ করতাম। অতপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমালেন, আল্লাহ তায়ালা উপরি-উক্ত দিন দু’টির পরিবর্তে তা অপেক্ষা উত্তম দু’টি দিন তোমাদের খুশি প্রকাশ করার জন্য দান করেছেন- এর একটি হচ্ছে- ‘ঈদুল আদ্বহা’ এবং অপরটি হচ্ছে- ‘ঈদুল ফিতর’। তখন থেকেই ইসলামী শরীয়তে দু’টি ঈদ আনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ঈদ
এই যে ঈদ, এই উৎসবের কীভাবে উদ্ভব হয়েছে তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র ও তথ্য থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে ইতিহাস জানা যায় তাতে ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ আগে থেকেই। বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব-বাংলায় পড়েছিল।

এ বিষয়ে নানা ইতিহাস গ্রন্থ পর্যলোচনা করলে আরও দেখা যায় অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। এদেশবাসীর ধর্ম-সামাজিক পার্বণ নয়। এদেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুল সোলহা নামক গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায় আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সন মুতাবিক ৯৪১ খৃস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে-ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খৃস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। তবে এদের প্রভাবে পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, তা বলা সমীচীন নয়। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খুদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলি আরবীয় ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার।

বাংলায় ইসলামের প্রতিনিধিত্বশীল এসমস্ত শব্দের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যৌক্তকতার প্রশ্নে যে কেউ আপত্তি করতে পারে। ইসলামের প্রতিনিধিত্বশীল শব্দ আরবীতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফার্সি বা অন্যকোন বিদেশী শব্দ ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করবে এটা কেমনজানি মেনে নেওয়া অসম্ভব।

প্রখ্যাত বিশ্লেষক আহমদ ছফা বলেন, মিশর থেকে শুরু করে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা আরবি ভাষা এবং বর্ণমালা দুটিই গ্রহণ করেছিলেন। মিশরে যেভাবে সহজে আরবিভাষা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, ইরানে তেমনটি পারেনি। কারণ ইরানিরা ছিলেন অতিমাত্রায় ঐতিহ্য সচেতন এবং সংস্কৃতিপ্রাণ জাতি। তাদের মহীয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে এ যুক্তি উদ্ধার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি যে আরবি ভাষা না আয়ত্ব করেও প্রকৃত মসলমান হওয়া যায়।

এধারাবাহিকতায় ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্থান পেরিয়ে ভারতবর্ষ অবধি মুসলিম শক্তির যে জয়যাত্রা সূচিত হয় হয়েছে তার পেছন পেছন ফার্সিভাষাও ভারতে প্রবেশ করেছে।এমনকি মোগল বিজেতেরাও তাদের মাতৃভাষা তুর্কির পরিবর্তে ফার্সিকেই সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে।

বাংলা ভাষায় ইরানীদের সাংস্কৃতিক আদিপত্য। সপ্তদশ শতকে আরাকান রাজসভায় এবং অষ্টাদশ শতকে আরবী ফারসী শব্দবহুল পুঁথিকাব্য রচনার মাধ্যমে মুসলিম কবিরা বাংলা ভাষাও সাহিত্যের সম্পদ বৃদ্ধি করেন। আরাকান রাজসভায় কবি দৌলত কাজী,আলাওল প্রমুখ মর্ত্যের মানুষের রোমান্টিক প্রেমকাহিনীর রচিয়তা হিসাবে, আরবী-ফার্সী শব্দবহুল পুঁথিকাব্যের রচিয়তরা বাংলা সাহিত্যে বীরত্ব -ব্যঞ্চক ও মানুষ্যত্বের উদ্বোধক কাহিনী-কাব্যের প্রণেতা হিসাবে সুবিখ্যাত।

মুসলিম আমলে বাংলা গদ্য
মুসলিম শাসন কালে বাংলা ও সাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ হওয়া সত্ত্বেও ফার্সী ভাষায় ছিল রাজভাষা। কারন তখনো পুরিপুরি বাংলার গদ্যরীতি শুরু হয়নি। তাই বাংলা ভাষা রাজভাষা করা সম্ভব ছিল না তবে বাংলার জন্মের পর থেকে সুদীর্ঘ ১৮০০সন পর্যন্ত কাব্যের ব্যাপক চর্চার পাশাপাশি গদ্যের প্রচলনও শুরু হয়। এ ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগে মুসলমানদের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক চর্চার কারণে সহজ সাবলীল একটি রীতি তৈরি হয়েছে। যা ছিল সর্বসাধারণ জন্য সুখ্যপাঠ্য। যাতে আরবী,উর্দু, ফার্সীর শব্দের অনুপ্রবেশ করে। গড়ে ওঠা এরীতিতে এঅঞ্চলের বাসিন্দারা লেখালেখি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। তাই অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবীর পাশাপাশি ফার্সীর প্রাচুর্যতা লক্ষ্য করা যায় বাংলা ভাষায়।

প্রথম ঈদগা নির্মাণ
ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন: ১৬৪০ খৃ. বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগা। প্রথমদিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগার পাশে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগার পার্শ্বে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাটি এখন সংরক্ষণ পুরাকীর্তি।

শামসুজ্জামান খান তার ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ নিবন্ধে বলেছেন ‘ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকের বাংলায় ইসলাম এলেও চার/পাঁচশত বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিলো তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোনো ঘটা লক্ষ্য করা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি: এক. গ্রাম-বাংলার মুসলমানেরা ছিলো দরিদ্র; এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদোৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি ঊনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। নবাব-বাদশারা ঈদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিলো অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসাবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিলো না। তবে গোটা ঊনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগর জীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।’

মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। তবে মুঘলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলামেলা গণমুখী শাহি ঈদগাহের উপস্থিতি দেখে। সুফিসাধকদের ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে আলাদা, অধিকতর গণমুখী।

বিট্রিশ শাসনাধীন যুগে ঈদ নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেন :এই আনন্দোৎসব কে আমরা প্রার্থনা-সভায় পরিণত করিয়াছি আমাদের পতনের যুগে।স্বভাবতই এটা ঘটিয়াছে।সাময়িক বিপদেও মানুষ তার আনন্দোৎসবকে সংক্ষিপ্ত সম্কুচিত করে।স্থায়ী বিপদে ত কথাই নাই।দুর্দিন দীর্ঘস্থায়ী হইল মানুষ অদৃষ্টবাদী ও অতিরিক্ত ধার্মিক হইয়া পড়ে আমরাও তাই হইলাম।প্রায় দুই-দুইশ'বছর কি বিপদটাই না গেল আমাদের ওপর দিয়া! জান-মাল,মান-ইযযৎ কিচ্ছু ছিল না।সর্বাত্মক যুলুমে প্রাণ রাখিতেই আমাদের প্রাণান্ত! আনন্দোৎসব করিব কখন? তাই ঈদের দিনের ধর্মের যে বিধানটুকু না করিলেই নয়, সেইটুকু শুধু করিলাম, পারিলে ময়দানে গিয়া নয় ত মসজিদেই।আর বেশির ভাগ ঘরের কোণে বসিয়া বিপদ-তারণ আল্লাহর দরগায় কান্নাকাটি করিয়া কাটাইলাম দুই-দুইশ বছর। এই সময়েই আমাদের জীবন হইতে গেল স্বাচ্ছন্দ্য, সমাজ হইতে গেল উৎসব, ঘর হইতে গেল আনন্দ। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বাপেক্ষা উর্বর ক্ষেত্র ঈদ-পর্ব সৃজনীশক্তির দিক দিয়া হইয়া গেল বন্ধ্যা।
সূত্র :বাংলাদেশের কালচার

তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকজ মেলা। সে ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থের জোড়াতালির ভেতরও ঈদবাজার এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর।

ঈদুল ফিতর দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ তাআলা এ দিনে তার রোজাদার বান্দাদের নিয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বার বার ধন্য করেন এবং তাঁর ইহসানের দৃষ্টি বার বার দান করেন। কেননা মুমিন বান্দা আল্লাহর নির্দেশে রমজানে পানাহার ত্যাগ করেছেন আবার রমজানের পর তাঁরই পানাহারের আদেশ পালন করে থাকেন। তাই দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা পানাহারে মুক্ত করে দনে। তাই ঈদুল ফিতরকে ঈদুল ফিতর করে নাম করা হয়েছে।

কোরবানির ঈদের নানা উপাখ্যান
কোরবানী এটি ইসলামের অন্নতম সংস্কৃতি। কিন্তু হিন্দুরাজা কর্তৃক প্রতি যুগে তা পালন করতে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে মুসলিমরা। শত বাধা মোকাবেলায় কখনো আদর্শের এসংস্কৃতির যুদ্ধ থেকে পিছু হঠেননি মুসলিমরা। এতে মোকাবেলা করছে ওলী -আওলিয়া থেকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকগণ।সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও পিছিয়ে নেই।
খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে সিলটে গৌড় গোব্দিন্দ নামে এক রাজা রাজত্ব করেন। তার রাজত্ব কালে সিলেট জুড়ে সংখ্যালুঘু বসবাস করত। শহরের টুলটিকর মহল্লার বুরহান-উ-দ্বীন তার পুত্রের আকীকা উপলক্ষে একটি গুরু জবেহ করেন। উগ্র ও চরমপন্থি এ হিন্দু রাজা তার হাত কেটে ফেলে এবং গোবৎস প্রীতির বশে নবজাত শিশুকেও হত্যা করতে দিদ্বাবোধ করেনি। অতঃপর বুরহান-উ-দ্বীন তৎকালীন সুলতান -শামছুদ্বীন ফীরুয শাহ্ এর নিকট নালিশ করেন, এবং এব্যাপারে সাহায্য চান।সুলতান সেনাপতি সিকান্দার খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু যাদুবিদ্যা বিশারদ গৌড় গৌবিন্দের বাহিনীর কাছে পরাজিত বরণ করে, ফিরে আসেন।

অতঃপর সেনাপতি শিকান্দার খান সোনারগাঁও হযরত শাহ্ জালালের সাথে সাক্ষাত করেন ও দোয়া চান। এই সময় হযরত শাহ্ জালাল র. সোনারগাঁও কে কেন্দ্র করে পর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতে কাজে রত ছিলেন। তিনি সিকান্দার খানের সাফল্যের জন্য দোয়া করেন।এবং খোদ নিজেই তিনশ ষাটজন সাথী ও ভক্ত শিষ্যসহ জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। এবং অপরদিকে নাসিরুদ্দিন সিপাহশালার ও তার বাহিনীসহ সিকান্দারের সাথে যোগদান করেন। (ইসলামী বিশ্বকোষ)
মাওলানা শামছুল হুদা
যোগেশ বাবু।ধলার হিন্দু জমিদার।মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেন। গফরগাঁওয়ের বাগের গাঁ গ্রামের সাহেব আলী মন্সী ও ছিপান গ্রামের পঁচা খাঁ।এরা দুজন কোরবানীর ঈদে নির্জনে গরু কোরবানী করল।জমিদার যোগেশ বাবু তা শুনে আগুন! কী এত বড় সাহস!! সাথে সাথে তাদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করলেন। চরম শাস্তি দিল।তারপর যথাক্রমে ৫শ ৬শ টাকা জরিমানা করল।জরিমানা এ বিশাল অংক পরিশোধ করতে করতে তারা একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেল। তাদের অসহায়ত্ব দেখে, রোরুদ্ধকান্না দেখে সবাই অশ্রুসজল হল, দুঃখিত হল। মর্মাহত হল।অশ্রু মুছতে মুছতে দূরে সরে এল।কিন্তু কেউ পাশে দাড়ানোর সাহস পেল না। মাওলানা শামছুল হুদা তখন জমিদারের বিরুদ্ধশক্তি হয়ে মাঠে নেমে এসেন। (সূত্র:কিংবদন্তীর মহানায়ক মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী রহঃ)

মোশারফ হোসেন কোরবানির গরু জবাই এর বিরুদ্ধে লিখে ব্যাপক প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে ছিলেন। মৌলবী মোহাম্মাদ নইমুদ্দীন প্রমুখ তার বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল এ শতাব্দীর ২০শের দশকে "ইসলামী দর্শন"পত্রিকায় "গো কোরবানী" প্রসঙ্গে রচনায় বলা হয়েছিল কতিপয় শরিয়ত অনভিজ্ঞ অদূরদর্শী গো-কোরবানীর বিরুদ্ধে ফতওয়া ও মন্তব্য প্রকাশ করিয়া এবং সেন্ট্রাল খেলাফত কমিটি গো-কোরবানীর বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন জারি করিয়া পবিত্র ইসলাম ধর্মে হস্তক্ষেপ ও মুসলিমদের জাতিগত অধিকার রহিত করিবার জন্যে যে অন্যায় আয়োজন করিয়াছিল,সুখের বিষয় ভারতের প্রত্যেক মুসলমান ধর্মক্ষেত্র হইতে তাহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনি সম্মুথিত হইয়াছে (সূত্র:ইসলামী দর্শন, শ্রাবণ১৩২৮/ঈদসংখ্যা২০১৭)

প্রমথ চৌধরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র 'পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় তরিকুল আলম 'আজ ঈদ'শীর্ষক এক প্রবন্ধে কোরবানীর ঈদে পশু হত্যার বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। এপ্রবন্ধের প্রতিক্রিয়াতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'কোরবানী 'কবিতাটি লিখেছিলেন।৬মাত্রার মাত্রাবৃত্তের অপরূপ অন্তমিলে এক আশ্চর্য সুরঝংকার সৃষ্টি করেছিলেন কবি, কবিতার মাঝেই শক্তির উদ্বোধন হয়েছিল।তরিকুল আলমের 'আজ ঈদ'প্রবন্ধের কথা আজ আর মনে নেই করো।কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের 'কোরবানী 'কবিতাটি পচাত্তর বছর পরেও এবারের বসন্তের কৃষ্ণাচূড়ার মতোই তরতাজা মনে হয়।(ঈদ সংখ্যা এসময়২০১৭)

এভাবে ঈদ এদেশের মুসলিমদের কাছে পরিচিত লাভ করে।উদযাপনের ধারাবাহিক রীতি শুরু হয়।বাঙালী মুসলিমদের স্বীকৃত একটি সংস্কৃতি পরিচয় লাভ করে।

বাঙালী সংস্কৃতিতে ঈদের প্রভাব

সংস্কৃতির আলোচনার আগে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মাঝে তফাৎ সুস্পষ্ট হওয়া আবশ্যক একটা জাতির একাধিক কালচার থাকতে পারে কিন্তু একাধিক সিভিলিযেশন থাকতে পারে না। অপর দিকে তেমনি বহু জাতির এক সিভিলিযেশন থাকতে পারে বটে কিন্তু এক কালচার থাকতে পারে না। কারণ কালচারের নিজস্বতা বা জাতীয়তা বা জাতীয় রূপ থাকতে হবে; পক্ষান্তরে সিভিলিযেশনের কোন জাতীয় রূপ থাকতে পারে না।
সূত্র :বাংলাদেশের কালচার

সভ্যতা বলতে সাধারণত শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে,দর্শন-সাহিত্যে,শিল্পে-বাণিজ্যে,কলা-কারিগরিতে মানুষের সামগ্রিক অগ্রগতির নামই সভ্যতা।মানবমনের ক্রমবিকাশের নিদর্শন এটা। সে কারণে গভীরতা ও ব্যাপ্তিতে প্রসার লাভ সভ্যতার স্বভাব। বনের আগুনের মতো নিজের আলোকে ও দাহিকা শক্তিতে বিস্তার লাভই ইহার অন্তর্নিহিত জীবনী শক্তি।সভ্যতা ক্রমবিকাশমান। জ্ঞানের মতোই সে অক্ষয়, আগুনের মতোই সে অনির্বাণ।

অতীতের সভ্যতার সাথে কোন একটা বিশেষ মানব-গোষ্ঠীর নাম সংযুক্ত থাকার অর্থ এই নয় যে, ঐ সভ্যতা শুধু ঐ মানব-গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বস্তুুত ঐ সব সভ্যতার ফল ঐ মানব গোষ্ঠির বাহিরের লোকেরাও ভোগ করেছিল।প্রদীপ যার আঙ্গিনায় জ্বলুক, পথচারীও সে আলোকে সুবিধা ভোগ করিবে। ইসলামের সভ্যতা শুধুমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পূক্ত হলে এর রাষ্টীয় সুযোগ সুবিধা অমুসলিমরাও গ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত। একেবারে ঘরের কাছে নযির লওয়া যাক। বর্তমানে যুগের সভ্যতাকে আমরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইউরোপীয় সভ্যতা বলতাম। ঐ সভ্যতার নেতৃত্ব এখন আমেরিকার হাতে চলে যাওয়ার কারণে তাকে আমরা এখন ওয়েস্টার্ন সিভিলিযেশন বা পশ্চিমা সভ্যতা বলি।

এভাবে সভ্যতাটা আসলে যুগের বৈশিষ্ট কোন জাতি বা দেশের বৈশিষ্ট নয়

সভ্যতা ও কালচার থিওরি হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামের একটা সভ্যতা আগমন করেছে যে সভ্যতা অর্ধপৃথিবী তার করায়ত্ব করে শাসন করেছিল। ইসলাম কোন ভূখন্ড সাথে সম্পূক্ত নয়। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের মুসলিম সভ্যতা ছোঁয়াতে এসেও দেশীয় কালচারকে কখনো বর্জন করেনি। সভ্যতা সমাজকে সংস্কার করে।তাই মুসলিমদের আলাদা সংস্কৃতি মুসলিমদের বাঙ্গালী পরিচয়কে কখনো ক্ষুন্ন করে না। ইসলাম সভ্যতার বিচারে সর্বজনীন ধর্ম। তাথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের বাঙ্গালী সংস্কৃতি হাঁকডাঁক নামে মুসলিমদের হেয়প্রতিন্ন বা তাঁদের বাঙ্গালী পরিচয়কে ক্ষুন্ন করা অপ্রচেষ্টার ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়াটা স্বাভাবিক এখানে।

তবে সভ্যতার বিচারে ভঙ্গদেশে তার ছোঁয়া কি পরিমাণ বা কিভাবে লেগেছে তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয়। আহমদ ছফা বলেন ইসলামও যে একটা উন্নততর দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সাধন করেছিল, বাঙালী মুসলমানের মনে তার কোনো গভীরাশ্রয়ী প্রভাব পড়েনি বললেই চলে।

প্রথমত, ভারতে ইসলাম প্রচারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী দরবেশদের একটা গৌণ ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু লোদী, খিলজী এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্য বিস্তারই ইসলাম ধর্মের প্রসারের যে মুখ্য কারণ, তাতে কোনো সংশয় নেই। এই পাঠান-মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক একবস্তু ছিল না।

আব্বাসীয় খলীফাদের আমলে বাগদাদে, ফাতেমীয় খলীফাদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলীফাদের আমলে স্পেনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল, ভারতবর্ষে তা কোনদিন প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের যে অপ্রতিহত প্রভাব ইউরোপীয় রেনেসাঁকে সম্ভাবিত করে তুলেছিল, ভারতের মাটিতে সে যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা একেবারেই শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া, সংগীতকলা, স্থাপত্যশিল্প, উদ্যান রচনা এবং ইরান, তুর্কীস্থান ইত্যাদি দেশের শাসনপদ্ধতি এবং দরবারী আদব-কায়দা ছাড়া অন্য কিছু ভারতবর্ষ গ্রহণ করেনি।

তদুপরি, এই ভারতবর্ষের লক্ষ্ণৌ, দিল্লি ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলামের যেটুকু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে বাংলামুলুকে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছতে পারেনি।যে মুসলিম শাসক শ্রেণীটি নানাসময়ে বাংলাদেশ শাসন করতেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন বিদেশী। রক্ত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোন সম্পর্ক ছিল না।অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মত সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তারা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক-ফ্যাশন ইত্যাদির জন্য দিল্লি কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন।
সূত্র:আহমদ ছফার রচনাবলী ১

কালচারের বিচারে বাঙ্গালী স্বকীয়তা নিয়ে গবেষক আবুল মনসুর আহমদ তার "বাংলাদেশের কালচার"রে বলেন বাংলার কালচার বলিয়া কোন কালচার নাই।কথাটা প্রথম দৃষ্টিতে ভ্রান্ত মনে হবে। বাংলা একটা দেশ। বাঙ্গালী একটা জাতি।এটাই স্থূল সত্য। কারণ দেশ, গোত্র,ভাষার দিক হইতে বাংলার বাশিন্দারা একটা জাতি। এই জাতির একটা জাতীয় কালচার থাকার কথা। কিন্তু সত্য কথা এই, বাংলায় কোনও জাতীয় কালচার নাই।বাংলা সেদিন বৃটিশ ভারতের এবং তারও আগে মোগল ভারতের প্রদেশ ছিল বলিয়াই বাঙ্গালীরা স্বাধীন জাতি হিসেবে গড়িয়া উঠিতে পারে নাই এবং সেই কারণে বাঙ্গালীদের জাতীয় কোন কালচার নাই,ব্যাপারটা তা নয়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ছাড়াও মানব-গোষ্ঠির মধ্যে জাতীয় কালচার গড়িয়া উঠিতে পারে।বাংলায় জাতীয় কালচার গড়িয়া না উঠার কারণ রাষ্টীয় পরাধীনতা নয়, সমাজিক বিচ্ছিন্নতা।

তবু নতুন সভ্যতার ছোয়াঁতে অনেক সময় মানুষের মাঝে নতুন বোধ তৈরি হয় যা ধীরেধীরে কালচারে পরিণত হয়।কারণ আবুল মনসুর আহমদ বলেন, মানুষের ভাষা উপাসনা-প্রণালী এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিরও খানিকটা কালচার, আর খানিকটা সিভিলিযেশন। যার নযীর ইসলাম তার ইতিহাসে ভুরে ভুরে দিয়েছে। তবে এদেশে ধর্ম ও কৃষ্টির একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাই তাথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ধর্মকে সবসময় আলাদা করে দেখে বাঙ্গালী সংস্কৃতি থেকে।

ধর্ম ও কৃষ্টি সীমারেখা
ধর্ম ও কৃষ্টির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় ;কিন্তু দুটো এক নয় পুরোপুরি। পোটেনটাইযড কালচার দার্শিনিক ম্যালিনস্কির ভাষায় "মাস্টার ফোর্স অব হিউম্যান কালচার "।কাজেই ধর্মের সবটুকুই কালচার, কিন্তু কালচারের সবটুকুই ধর্ম নয়। খেলাধূলা মানুষের কর্মজীবনের স্বাভাবিক অংশ স্বীকার করা সভ্যতা। কিন্তু খেলার বিভিন্ন রূপ ফুটবল না রাগাবি, ক্রিকেট না বেসবল, পলো না ঘোড়দৌড় ইত্যাদি এসব সভ্যতার প্রশ্ন নয়, কালচারের প্রশ্ন মাত্র। যে কোন দেশের কালচার তা যতই সুন্দর হোক না কেন অন্য দেশে চালানের উপযুক্ত হবেনা কখনো।স্থানীয় রসে অভাবে তা মারা যাবে। কারন কালচার মনের বস্তু, মস্তিস্কের বস্তু নয়।

ঠিক একারণে দুনিয়ার লোক যত সহজে পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করেছে, তত সহজে পশ্চিমা কৃষ্টি গ্রহণ করে নাই। ইসলামী সভ্যতাকে আরবের আশপাশের রাষ্ট্র পুরোপুরি আরবি ছাঁচে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেনি প্রথাগস্থ এনীতি।ইরান, স্পেন ইত্যাদি রাষ্ট্র তাকে অবিকল আরবি ছাঁচে গ্রহণ করেনি বরং সভ্যতা হিসেবে তাকে গ্রহণ করেছে।

এবার আসা যাক বাঙ্গালীর ঈদ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক রূপে কথা নিয়ে।মসজিদ মন্দির গির্জার বাহিরে যে উৎসব যতটা প্রসারিত হয়, জাতীয় রূপ পাওয়ার সম্ভবনা হয় তার তত বেশি।ঈদ এধরনের একটি উৎসব। সব কালচারের অনুষ্ঠানে আনন্দোৎসবে মধ্য দিয়ে জাতির সমবেত মন বিকশিত হয়। সুস্থ ও স্বাভাবিক পথে নির্মল আনন্দ না পেলে মানুষ পাপের পথে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করে।তাপর পরবাদিতে মানুষের আনন্দ ক্ষুধায় আসে জোয়ার। এসময় সাংস্কৃতিক আনন্দ অনুষ্ঠানে সে ক্ষুধার তৃপ্তি না থাকলে মানুষ কুপথে গিয়ে সে পিপাসা মিটায়। আমাদের জীবনে তা-ই হচ্ছে।কারণ আনন্দের ক্ষুধা মানুষের পেটের ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধার মতই তীব্র। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নির্মল আনন্দের অভাবে ঈদের দিনের প্রাণের জোয়ার ঝাড়ি আমরা সিনেমা দেখে।কুস্থানে গিয়ে এবং ক্লাবে "ঈদবল"নাচিয়ে। এটা বেদনার বিকৃত নযীর।

ঈদের আনন্দ ও আমেজ অনুভব ও উপভোগ্য একটি স্বভাবত বিষয়। তবে ইসলামে সবচেয়ে কঠিন ও সুক্ষ্ম বিষয়টি হচ্ছে খেলা-ধূলা, আনন্দ উল্লাস ও শিল্পকলার বিষয়টি।আর তা একারণে যে, অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও শিথিলতায় নিমজ্জিত।এদৃষ্টিকোণ থেকে যে,তা বুদ্ধি ও চিন্তার চেয়ে হৃদয় ও অনুভূতির সাথে বেশি সম্পূক্ত।ইসলামী সমাজকে অনেকে ইবাদত বন্দেগির এবং কষ্ট ও পরিশ্রমের সমাজ বলে মনে করে।

কাজেই তাদের ধারণা এখানে খেলা-ধূলা, হাসি-ঠাট্টা,আনন্দ -বিনোদনের কোনো স্থান নাই এসমাজে হাসি ফুটতে পারবেনা। কারো অন্তরে খুশীর উদয় হতে পারবেনা আর না কোনো চাকচিক্যের রেখা অংকিত হতে পারবে।সম্ভবত এধারণা পোষণের ক্ষেত্রে তাদের কে সহযোগীতা করেছে কোন ধার্মিকের আচরণ যারা নিরাশ ব্যর্থ,মানসিকভাবে অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন তবে তারা তাদের এদোষিত আচরণকে ধর্মের নামে দোষমুক্ত করতে চায়। অর্থাৎ তারা তাদের আত্মকেন্দ্রিক ও সন্ত্রস্ত স্বভাবকে ধর্মের ওপর আরোপ করতে চায়। এখানে ধর্মের কোন অপরাধ নাই, অপরাধ তাদের। তারা ধর্মের কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছে আর কিছু প্রত্যাখান করেছে।

ব্যায়াম যদি শরীরের পুষ্ট বিদান করে আর ইবাদত আত্মার খোরাক যোগায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান বুদ্ধি বাড়ায়,তাহলে শিল্পকলা মন-মানসে পুষ্টি বিদান করে। এখানে আমরা সে শিল্পকলার কথা বলছি যা মানুষের কল্যাণ সাধন করে, অকল্যাণ করে না। ইসলাম সৌন্দর্যবোধকে জাগ্রত করে, এবং নান্দনিক শিল্পকে সমর্থন করে। তবে তা শর্ত সাফেক্ষে। যাতে তা কল্যাণে আসে, ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী না হয়।

আমরা বাঙ্গালী হিসেবে পোশাক-আশাকে বাঙালী মুসলিমরা কখনো দেশীয় সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়নি। বরং দেশীয় সংস্কৃতির চাপ তাদের পোশাক-আশাকে পরিলক্ষতি হয় সর্বদা। যার ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে ড.দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন- মুসলমানরা ইরান,তুরান প্রভৃতি যে স্থান থেকে আসুন কেন এদেশে এসে তাঁরা সম্পূর্ণ বাঙালী হয়ে পড়েন।অনুরূপ আমাদের ঈদের আমেজে বাঙ্গালীর চাপই বেশি পরিলক্ষিত হয়

তবে এতে ইসলামের সাংঘর্ষিকতা অতটা কখনো বাঙালী পোশাক ও শিল্পে পরিলক্ষিত হয়নি। এটা ইসলামের সার্বজনীন দৃষ্টান্ত। যুগ ও স্থানে অনুকূলে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংস্কারের দূরদর্শী প্রক্রিয়া। যা অন্যান্য মতবাদ থেকে ইসলাম কে আলাদা করেছে।

লেখক: তরুণ লেখক, গবেষক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ