মাহদি হাসান তাসনিম।।
ঈদের দিন সবচেয়ে আনন্দমুখর! মজা আর খুশীতে ভরপুর। আগমন করত এক হাঁড়ি আমোদ নিয়ে। উপভোগ করতাম খুব করে। সবেমাত্র পা বাড়ালাম কৈশোরে। বয়স আর কত হবে এগারো, বারো। ছিলাম একটু ডানপিঠে। চঞ্চলতা কম যেতাম না । এই বয়সে যা হয় আর কি।
আমার প্রিয় বন্ধু ছিল পাঁচ জন। সবাই মার্জিত স্বভাবের । আমাদের বেড়ে ওঠা একসাথে। নামাজ ,পড়া-লেখা ,খেলাধুলা থেকে শুরু করে বাকি সব । চাঁদ রাত থেকে পড়ে যেত ঈদ উল্লাসের ঢেউ। ইফতার সারতাম কোনমতে। তারপর মাগরিব নামাজ। একটু পরেই চাঁদ দেখার নিরব প্রতিযোগিতা। কার আগে ,কে দেখবে।
উঁচু বিল্ডিংয়ের জানালা, মসজিদের ছাদ ,খেলার মাঠ। বাদ দিতাম না কোনটাই। উঁকিঝুঁকি চলত ,ধুমছে। খানিকটা বাদে হেসে উঠতো, শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ।
ঐযে, ঐযে ঈদের চাঁদ! কে দেখে আমাদের আহলাদ। বলাবলি করতাম বারবার। দোস্ত! আগামীকাল তো ঈদ।
খুশিতে হয়ে যেতাম আঁকুপাঁকু। আমরা যেন ছড়াতাম গ্রাম্যময় ঈদ ঈদ উৎসব। মুরুব্বীরা তন্ময় হয়ে দেখতেন আমাদের উচ্ছ্বাস। আর ছাড়তেন স্নেহ-মমতার শ্বাস। এদিকে মাইকে মাইকে ছড়িয়ে যেত ঈদের জামাতের ঘোষণা। এ ফাঁকে আমরা জমাতাম সন্ধ্যাড্ডা । আগামীকাল কি কি করব, কই কই করব, কখন ঈদগাহে যাব নানান বিষয়ে। চানাচুর মুড়ি চকলেট চিপস গতি বাড়িয়ে দিতো মজলিসের।
গল্প চলত একটানা এশা নাগাদ। নামাজ শেষে যার যার বাড়ি, খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে যাই বিছানায়। বিছানায় শরীরে এলাতেই ডুবে যায় কল্পনার অথৈ সাগরে। কেমন কাটবে আগামীকাল।
ঘুম ভেঙে যায় মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানে। অন্যদিনের মত বলতে হয়নি। ওঠো, ওঠো, ওঠো না! ঈদের দিন বলে কথা! ফজরের নামাজ শেষে বেরোলাম হাঁটতে। মৃত হাওয়ার আলতো ছোঁয়ায় মন হয়ে গেল ফুরফুরে। নীলিমায় মেঘের ছোটাছুটি ভরে দিল হৃদয় এক আবহে। প্রকৃতিও যেন ভাগ করে নিয়েছে ঈদের উৎসব। তাইতো তারা নতুন সাজে সেজেছে।
খানিকটা বাদে চলে আসি ঘরে। গোসল সারি জলদি করে। আম্মু বললেন, কইরে সেমাই খেয়ে যাও। তাড়াতাড়ি মুখে পুরে নিলাম মজা মজা সেমাই! মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ! হুমম, ঈদের দিন মিষ্টিমুখ করে যেতে হয় ঈদগাহে। চির সুন্দর সুন্নতে নববী এটিই। গায়ে জড়িয়ে নিলাম নতুন পাঞ্জাবি ,পায়জামা। মাথায় সাদা বাহারি টুপি। মাখলাম ঘ্রাণে ভরা আতর -গোলাপ। বোগল চাপা দিলাম সুন্দর জায়নামাজ টি। চনমনে ভাব নিয়ে ছুটলাম ঈদগাহে । তাকবীর পড়ছি গুনগুনিয়ে। রাস্তায় দেখা হলো কত পরিচিত জনের সাথে। সবাই ঈদগাহ যাচ্ছেন সাজুগুজু করে।
বাবাদের হাত ধরে এসেছে ছোট্ট মানিক টিও। খুশি খুশি ভাব নিয়ে। এতক্ষণে চলে এলাম ঈদগাহের গেটে। কি সুন্দর দৃশ্য! সবার মাথায় টুপি, পরনে নতুন পাঞ্জাবি! মুহূর্তেই ঈদগাহ ভরে গেল মুসল্লী দিয়ে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের একটি বাগান। জান্নাতি সমীর প্রবাহিত থাকলো চারদিকে।
ইমাম মহাদোয় খুতবা পড়ছেন নিপুণভাবে। যেন শুভ্র মুক্তামালা ঝরছে তার বদন থেকে। কি দারুন স্বর্গীয় পরিবেশ! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালেন সবাই। ধনী-গরীব, ছোট-বড় ব্যবধান নাই। 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হল ঈদগাহময়। নামাজ শেষে, শুরু হলে মুসাফাহা ,কোলাকুলি। রব উঠলো 'ঈদ মোবারক 'ঈদ মোবারক'। উপচে পড়ছে নিঃস্বার্থ মহব্বত। চেহারা সবার হাস্যজ্জল। এ যে প্রীতির এক সম্মেলন। বন্ধুদের সাথে আমিও বিনিময় করলাম ঈদ ঈদ শুভেচ্ছা । উষ্ণ উষ্ণ অভিনন্দন।
ঈদগাহের বাইরটা ভরে দিয়েছে দুস্হগণ। খুব মায়া হলো তাদের দেখে। কচ কচে নোট দিলাম তাদের একজনের হাতে। কি যে খুশি হলো! নামাজ শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। চটজলদি খাবার সেরে নিলাম। বের হলাম বন্ধুদের সাথে।
আরম্ভ এবার ঘোরাঘুরি। গতকালের পরিকল্পনা অনুযায়ী। আমাদের খুব দূরে যাওয়া হয়না। আশেপাশের বন্ধু- সহপাঠি বাড়িতেই ক্ষান্ত। দূরে গেলে ঝাল ঝাল বকুনি ।ব্যথা ব্যথা পিটুনি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। ঘুরতাম আর ঘুরতাম। সবখানে থেকেই পেতাম হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। সাথে কচকচে ঈদ সালামি। দুপুরে যৎসামান্য জিরিয়ে নিতাম। যাতে বিকালটা মিস না যায়।
বিকেলে যেতাম নদীর পাড়ের দিকে। বাড়ি থেকে আধা কিলো দূরে ছোট নদী। গা জুড়াতাম কোমল অনিলে। আনন্দ খুঁজে নিতাম নিসর্গ অপরুপে। বুট বাদাম থাকতো পকেটে । ছল- ছল নদীতে পানি ঢেউ খেলছে খুব করে। কি মনোরম দৃশ্য! সবুজে সবুজে ঢাকা! রূপ -রস- গন্ধে ভরা! হাঁটছি আর হাঁটছি।
এদিকে ডুবি ডুবি করছে রবি। উচ্ছ্বসিত মনে কেটে যেতো ঈদের সারা বেলা। কত সুন্দর সেই সোনালী অতীত! মধুমাখা, রুপালি স্মৃতি। আজ ও নাড়া দেয় হৃদয়ের মনিকোঠায়। মিশে যেতে মন চায় সে হারানো দিনগুলিতে। মজার এক সংস্কৃতি ঈদ! খুশির হিল্লোলে দোল খায় হৃদয় কত!
এনটি