সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


এবার প্রিয় মাতৃভূমি হবে হাফেজে হাদিসদের!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বাংলাদেশ হাফেজে কুরআনদের দেশ। এবার প্রিয় মাতৃভূমি হবে হাফেজে হাদিসদের। কেননা বাংলাদেশে অসংখ্য হাফেজে কুরআন থাকলেও হাফেজে হাদিস নেই হাতেগোণা একজনও। অসংখ্য হিফজুল কুরআন মাদরাসা থাকলেও হিফজুল হাদিস মাদরাসা নেই একটিও। হিফজুল হাদিসের এই সংকট কাটিয়ে উঠতেই নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীস’ বিভাগ চালু করেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা চাঁদপুরের মহামায়া দারুস সালাম মাদরাসা। অত্যান্ত সফলতার সাথে প্রতিষ্ঠানটি এক বছর অতিবাহিত করার পর এবার পা রাখলো দ্বিতীয় বর্ষে। সম্প্রতি নিজের প্রতিষ্ঠিত হিফজুল হাদিস মাদরাসা নিয়ে আওয়ার ইসলামের মুখোমুখি হয়েছেন সৃজনশীল মননের এ তরুণ আলেম মাওলানা আসাদুল্লাহ সুলতান। তার সাথে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদ।


গত পর্বের পর থেকে,

আওয়ার ইসলাম: দুনিয়ার অন্য কোনো দেশে ‘হিফজুল হাদিস’ নামে আলাদা বিভাগ আছে কী না?
আসাদুল্লাহ সুলতান: আমাদের জানা নেই। তবে একজন মাদানীর মাধ্যমে জেনেছি, আরবে ভার্সিটি লেভেলেও ‘হিফজুন নুসূরের’ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। আসলে কোন দেশে আছে কিনা, সেটা আমাদের কাছে মূখ্য নয়। বরং বর্তমান বাস্তবতায় এ দেশের ইলমি অঙ্গনের ধারক-বাহকদের জন্য ‘হিফজুল হাদিস’ এর স্বতন্ত্র কোন বিভাগ প্রয়োজন আছে কিনা, সেটাই আমাদের কাছে বিবেচ্য। কোন একটি জরুরী বিষয়ের সূচনা অন্য দেশে না হয়ে, আমাদের দেশে হলে কি তা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না? কত কিছুই তো আমাদের দেশে আছে, অন্য দেশে নেই। ভারত উপমহাদেশে যে পরিমাণ কওমি মাদরাসা, তা কি পৃথিবীর সব যায়গায় অভিন্ন পদ্ধতিতে আছে? এমনকি বাংলাদেশে হিফজুল কুরআনের প্রচলিত যে পদ্ধতি, তাও তো সকল দেশে হুবহু নেই। তবুও তো বাংলাদেশী হাফেজে কুরআনগণই বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন।

গত পর্বের সাক্ষাৎকার পড়ুন শুধু হাফেজে কুরআন নয়, আমরা বানাবো হাফেজে হাদিস

 

আওয়ার ইসলাম: বিভাগটি পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনি কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করছেন?
আসাদুল্লাহ সুলতান: প্রক্রিয়াটা আমাদের দেশের হিফজখানাগুলোর প্রশিদ্ধ রুটিনের আলোকেই হচ্ছে। মূল রাবি, মূল কিতাবের নাম ও অর্থসহ সবক মুখস্থ করানো হয় হুবহু হিফ্জুল কুরআনের পদ্ধতিতেই। বাধ্যতামূলকভাবে সাত সবকও (পিছনের সাত দিনের সবক ধারাবাহিকভাবে) শুনা হয়। তবে সবিনা ও আমুখতাটি হুবহু হিফজুল কুরআনের পদ্ধতিতে নয়, প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে তামরীন। যেমন: বিষয় বলে হাদীস জানতে চাওয়া, বিষয় ও রাবির নাম বলে হাদীস জানতে চাওয়া, বিষয় ও মূল কিতাব উল্লেখ করে হাদীস জানতে চাওয়া। হাদীসের অংশ উল্লেখ করে পূর্ণ হাদীস জানতে চাওয়া। অর্থ উল্লেখ করে হাদীসের হুবহু ইবারত জানতে চাওয়া। নির্দিষ্ট কোন ছাত্র থেকেও জানতে চাওয়া হয়, আবার সম্মিলিতভাবে সবার কাছেও জানতে চাওয়া হয়। দৈনন্দিন এভাবে প্রচুর পরিমানে প্রশ্নোত্তরের আদলে তামরীন হচ্ছে। মৌখিকের পাশাপাশি লিখিত তামরীনও হচ্ছে। আলহাম্দুলিল্লাহ্! এভাবে যথেষ্ট উপকার লক্ষ করছি।

আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশের মানুষের মেধার সাথে আরবদের মেধার একটি তারতম্য আছে। সেক্ষেত্রে হাদিস মুখস্থের স্পেশাল কোনো ব্যবস্থা আপনার কাছে আছে কী না? আপনি ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছেন?
আসাদুল্লাহ সুলতান: আরবদের মেধার সাথে বাংলাদেশের মানুষের মেধার তারতম্য অনস্বীকার্য। তাই বলে তাদের জন্য যেটা স্বাভাবিক, সেটা আমাদের জন্য অসাধ্য হয়ে যেতে পারে না। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত, বাংলাদেশের হাফেজে কুরআনগণ হাজার হাজার আরবকে পিছনে ফেলে বিশ্বমঞ্চে বিজয়ের মুকুট অর্জন করে আসছেন।

তাছাড়া হাদীস সংকলনের ইতিহাসে প্রথম শতাব্দীগুলোর প্রেক্ষাপট ও হিফজুল হাদীসের ধরণ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ধরণ এক নয়। তখনকার মুহাদ্দিসগণ সনদ, মতন ও রাবীদের হালতসহ লক্ষ লক্ষ হাদীস হিফজ করেছেন, করতে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তখনকার প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন অনুযায়ীই তাঁদেরকে মেধা দিয়েছেন। আমাদের তো আর অত ভারি কিছু করতে হবে না। আমাদের সামনে সব প্রস্তুত। শুধু কিছু নির্বাচিত ও সীমিতসংখ্যক হাদীস মুখস্ত করবো।

তাছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই সম্ভব। এর বাস্তব উদাহরণ, আজ থেকে তিন দশকের আগের পরিবেশে হয়ত তিন-চার অংকের একটি নম্বর মুখস্ত রাখা অনেক কঠিণ বিষয় ছিলো। কিন্তু বর্তমানে ১১ ডিজিটের বহু মোবাইল নম্বর আমরা অনায়াসেই মুখস্ত করে ফেলতে পারি। এটা মূলত পরিবেশ ও প্রয়োজনের তাগিদেই হয়েছে।

[caption id="" align="aligncenter" width="545"]No description available. মাদরাসা অফিসে কম্পিউটারে ব্যস্ত মাওলানা আসাদুল্লাহ সুলতান[/caption]

স্পেশাল ব্যবস্থা হিসাবে প্রচলিত হিফজুল কুরআনের পদ্ধতিটাই আমরা আপাতত গ্রহণ করেছি, এটাকেই মডেল হিসাবে নিয়েছি। যেহেতু মুখস্থের ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘদিনের একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি। পাশাপাশি আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাও তো যোগ হবে।

আওয়ার ইসলাম: ‘হিফজুল হাদিস’ নামে আলাদা বিভাগ করার জন্য আপনি কার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
আসাদুল্লাহ সুলতান: সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি নয়, বরং ‘হিফজুল হাদীসে’ নিজের অজ্ঞতার আক্ষেপ ও উপলব্ধি থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। তবে এতটুকু অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, যখন হিফজুল হাদীস বিষয়ে বিশেষ টার্গেট নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, বিভিন্ন মুহাদ্দিসের জীবনী ও লেখা পড়লাম তখন প্রত্যেকের থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। নাম উল্লেখ করার মতো দুইজনকে স্মরণ করতেই হয়, ‘তাদবীনে হাদীস’ পড়ে মানাজির আহসান গিলানী রহ. থেকে এবং ‘হাদীসে আলো’ কিতাবের ভূমিকা পড়ে মাওলান আব্দুল মালিক হাফি. থেকে (তাঁর যে কোন লেখা পড়ে আমি উপকৃত হই) অনুপ্রাণিত হয়েছি।

আওয়ার ইসলাম: আপনি কী কী কারণে এমন যুগান্তকারী কাজের জন্য উৎসাহিত হলেন? একটু বিস্তারিত বলুন।
আসাদুল্লাহ সুলতান: কারণ হিসাবে অনেক কিছুই তো বলা যায়, তবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যদি বলতে হয়, বলবো:
ক- ‘হিফজুল হাদীস’টিও হিফজুল কুরআনের মতো হতে পারে, প্রথম শতাব্দীগুলোর বহু মুহাদ্দিসের জীবনী ও নির্দেশনাতে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে পেরেছি। যা ‘হিফজুল কুরআনের আলোকে হিফজুল হাদীস’ বইয়ে স্ববিস্তারে উল্লেখ করেছি।

[caption id="" align="aligncenter" width="629"]May be an image of ‎outdoors and ‎text that says '‎দারুস সালাম জামে মসজিদ দারুস সালাম মাদরাসা দারুস সালাম কমপ্লেক্স আলুমুড়া, মহামায়া, সদর, চাঁদপুর ০১৬২৮-৮১৬৮১ ০১৮৬০-৩১৩৪২১ اله‎'‎‎ মাদরাসার নিজস্ব ভবন ‘দারুস সালাম কমপ্লেক্স’[/caption]

খ-পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকলেও মৌলিকভাবে ‘হিফজুল হাদীসে’র প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করেন না। তা সত্ত্বেও এ যুগে হিফজুল হাদীসে চরম পর্যায়ের উদাসীতা। তা কাটিয়ে হিফজুল হাদীসে একটি নতুন জাগরনের প্রচেষ্টা।

গ-বর্তমান সময়টা (তাখাসসুস) বিশেষায়িত শিক্ষার যুগ। তাই দেখা যায় প্রত্যেক বিষয়েই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি একটি বিশেষ আবেদনও তৈরী করা সম্ভব হয়। বর্তমানে সারা বিশ্বেই ‘বিশেষায়িত’ শিক্ষাটা পছন্দনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, ইসলামী শিক্ষায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘হাদীস’ মুখস্থের বিষয়টাও একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে গুরুত্ব দেয়া সময়ের চাহিদা। পাশাপাশি একটি সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা, লক্ষভিত্তিক ব্যবস্থাপনাও দরকার। এমনকি একাগ্রতা ও ধারাবাহিকতার সাথে একটি নির্ধারিত সময়কাল ‘হিফজুল হাদীসে’র জন্য বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

ঘ-সহীহ হাদীসের নামে কিংবা ‘মাওজুআত’ নির্ভর বিভিন্ন ফিতনা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং আহলে হক উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে হাদীস না জানারও তোহমত দেয়া হচ্ছে, তার মোকাবেলায় সকল তালিবে ইলমের জন্য ব্যাপকভাবে হাদীস মুখস্থের প্রয়োজন। সেই অনুভূতিটাও বিশেষ কারণ।

আওয়ার ইসলাম: আপনার ‘হিফজুল হাদীস’ হাদিস বিভাগটি এক বছর অতিববাহিত করেছে? গতবছরের অভিজ্ঞতা কী?
আসাদুল্লাহ সুলতান: আলহামদুলিল্লাহ! আশাব্যঞ্জক। শিক্ষার্থীদের মতামত হলো, এখন কোন আমল করতে গেলে বা দ্বীনী কোন কথা বলতে গেলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসগুলো মনে পড়ে যায় এবং ইবাদাত করতেও ভালো লাগে। আরেকটি মজার বিষয় হলো, আমাদের মসজিদে কয়েকজন মুসল্লি আছেন। তারা ছাত্রদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। কখনো তাদের সাথে কোন ইলমি বিষয়ে কথাবার্তা হলে, তারা হাদীস নম্বর বলে কিংবা শুধু মর্ম বলেই দলীল দেন, আর হিফজুল হাদীসের ছাত্ররা যখন প্রতিউত্তরে হাদীসের মতন বলেন, তখন তারা নিশ্চুপ হয়ে যান।

বি. দ্র. তিন পর্বের সাক্ষাৎকারে আজ দেওয়া হলো দ্বিতীয় পর্ব। শেষ পর্ব পড়ুন আগামীকাল।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ