অনুবাদ: মুফতি শফিকুল ইসলাম রাহমানী
একবার মজনু জানতে পারে, এক ব্যক্তি লায়লার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তখন সে দৌড়ে তার নিকট গেল। সে সময় ওই লোকটি উটের উপর সওয়ার ছিল। মজনু জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বাস্তবেই আমার লায়লার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ!
মজনু বলল, আমার লায়লার নিকট আমার পক্ষ থেকে ভালোবাপূর্ণ সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবেন, মজনু তোমার ভালোবাসায় ব্যাকুল হয়ে কাতরাচ্ছে। একথা বলে সে থেমে গেল। আর সওয়ারি লোকটি সামনে অগ্রসর হতে লাগলো। মজনু স্বজোরে ডাক দিয়ে বলল, জনাব! আমার পক্ষ থেকে এই বিষয়টি বলবেন এবং অমুক বিষয়টিও পৌঁছাবেন।
কিছুক্ষণ পর মজনু আবার দৌড়ে এসে বলল, জনাব! আমার লায়লার নিকট একথাটিও বলে দিবেন। মজুন তার পিছনে দোঁড়াতে লাগলো আর একের পর এক সংবাদ বলতে লাগল যে, জনাব! এই বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলাম, এটাও বলে দিবেন। এমন করতে করতে একপর্যায়ে সফর শেষ হয়ে গেল, কিন্তু লায়লার প্রতি মজনুর প্রেমবার্তা শেষ হচ্ছিল না। এমনকি তারা লায়লার বাড়ির কাছে চলে আসল।
দীর্ঘ সফরের কারণে মজনুর পা ফুলে ফেটে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু সে তার লায়লার জন্য একেরপর এক বার্তা দিয়েই যাচ্ছিল। লোকির দৃষ্টি যখন মজনুর পায়ে পড়ল তখন তিনি চমকে গিয়ে বললেন, হায়! তোমার পায়ের এই কি অবস্থা?
শহরের সীমানায় প্রবেশের জন্য যেহেতু মজনুর উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাই সেখানেই সে থেমে গেল। আর সওয়ারি লোকটি লায়লার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। এদিকে মজনু সওয়ারির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। যখন লোকটি দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল তখন পায়ের প্রচণ্ড ব্যথার কারণে মজনু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। তাই সে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ তার মনে আসল, যে দিকে পা দিয়েছি, সে দিকে যদি লায়লার ঘর হয়ে থাকে! তাই সে দ্রুত পা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল।
আবার মনে হল, যদি এদিকে লায়লার ঘর হয়ে থাকে! তাই আবারও পা ঘুরিয়ে নিল। এমন করতে করতে একপর্যায়ে সে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু পায়ে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিল না। আর এই সামান্য দাঁড়ানোর ফলেই তার পা থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। তখন তার মাথায় একটি অভিনব বুদ্ধি আসল যে, মাথা নিচে এবং পা উপরে দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন হয়! অন্তত এটা নিশ্চিত যে, লায়লার বাড়ি আকাশে নয়।
আর এদিকে মজনুর পা ফুলে যাওয়া এবং রক্ত ঝরতে দেখে তার উপর খুব মায়া হল। তাই তিনি ঔষধের জন্য সোজা ডাক্তারের নিকট চলে যান। ডাক্তারের কাছে মজনুর সফরের অবস্থা ও কষ্টের বিবরণ দিয়ে চিকিৎসা দিতে বললেন। ডাক্তার বললেন, যদি দ্রুত আরোগ্য চান তাহলে সর্বোত্তম চিকিৎসা হলো, কিছুক্ষণের জন্য তার মাথা নিচে এবং পা উপরে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। যদি সে না পারে তাহলে অন্য কেউ তাকে ধরে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখবে।
কেননা দীর্ঘ সফরের কারণে পায়ের রক্ত নেমে এসেছে। এভাবে রাখলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফোলা কমে যাবে। অন্যভাবে চিকিৎসা করতে গেলে সুস্থ হতে কমপক্ষে একসপ্তাহ সময়তো লাগবেই। লোকটি চিকিৎসা-পদ্ধতি জেনে দ্রুত মজনুর নিকট গিয়ে দেখতে পেল, মজনু মাথা নিচে ও পা উপরে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আরে তোমাকে এই চিকিৎসা-পদ্ধতি কে বলে দিয়েছে! লোকটি পুনরায় ডাক্তারের নিকট গিয়ে চিকিৎসার বিবরণ জানাতে চাচ্ছিল। তখন মজনু বিরক্ত হয়ে বলল, জনাব! আপনি আমার লায়লার কাছে গিয়ে আমার ভালোবাসার বার্তাগুলো পৌঁঁছে দিন। আপনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে খামাখামা কষ্ট করে সময় নষ্ট করছেন। আমার ভালোবাসাইতো আমার আসল ডাক্তার!
মজনু একজন পাগল হওয়া সত্ত্বেও সে একটি মহামূল্যবান কথা বলেছে 'স্বয়ং ভালোবাসাই ভালোবাসা রোগের চিকিৎসা। আমরাতো শুধু নামে মুসলমান। কাজে-কর্মে ইহুদি-খ্রিস্টান। শরীয়তের বিধানের উপর আমল করতে গিয়ে 'কেন করবো? কী জন্য করবো? এমন অবান্তর প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রকৃত ভালোবাসাই হলো ঈমানের প্রাণ, আর সেটাই আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। শরীয়তের বিধান পালনের মধ্যেই আল্লাহর প্রকৃত আশেক এবং ওলী-আউলিয়াগণ অমৃতের স্বাদ অনুভব করে থাকেন। কেননা তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা নামক মহামূল্যবান সম্পদ অর্জিত হয়েছে।
শরীয়তের বিধান এবং সুন্নাতের অনুসরণে আসল মজা পাওয়ার জন্য তপ্ত হৃদয়ের মানভূমিতে ভালোবাসার আগুন জ্বালাতে হবে। আর সে জন্য আপন দিলের নির্বাপিত বাতির মাঝে আগুন জ্বালানোর জন্য কোনো প্রজ্বলিত দিলের সংশ্রব প্রয়োজন।
আরেফ বিল্লাহ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আহমাদ পারতাব রহ. কতো সুন্দরই না বলেছেন, তপ্তহৃদের পরশ তুমি নাও বুলিয়ে, হৃদয় মাঝে আগুন তুমি দাও জ্বালিয়ে!
হৃদয়ের মণিকোঠায় প্রকৃত ভালোবাসার আগুন জ্বালানো ছাড়া আমাদের জীবন বিষাদের ছাঁয়ায় আচ্ছাদিত থাকে এবং একেবারে প্রাণহীন-শুষ্ক মরূভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। হায়! আমরা যদি এই সঠিক বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারতাম!
-এটি