সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ফুল হওয়ার আগেই ঝরে যায় কলি!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।রাবেতা হক।।

আমি দেখেছি এবং প্রতিনিয়ত দেখছি সেই মেয়েকে, যার সবকিছুতে সম্ভাবনার আলোকরশ্মি ঠিকরে পড়ে, যার কলম হতে শব্দের ফুল ঝরে, যার চোখের তারায় স্বপ্নের ঝিলিমিলি, যার হৃদয়ে আছে প্রতিভার সুপ্ত প্রদীপ। একটি বিচক্ষণ হাত ও একটু সুন্দর চিন্তার ছোঁয়ায় আকাশের তারা হয়ে সে মিটিমিটি জ্বলতো। প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে চারপাশ সুরভিত করতো। তার সঠিক যত্ন ও সুস্থ তারবিয়াত নিশ্চিত হলে অন্তর্নিহিত সকল শক্তি ও সম্ভাবনার স্ফুরণ ঘটতো। কিন্তু অযত্নে, অবহেলায়, সময়ের নির্দয়তার ফুল হওয়ার আগেই সে ঝরে যায়। আশার প্রদীপ তার নিভে যায় !!

প্রতিটি প্রতিভা তো আল্লাহর দান। যার ঘরে, যার ছায়ায়, যার তত্ত্বাবধানে কোন প্রতিভা বেড়ে উঠতে চায় তার কর্তব্য হলো, প্রতিভার কদর করা। সমাজের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করা। তাকে বিকশিত করতে যত্ন ও মমতার সাথে এগিয়ে নেওয়া। জলসিঞ্চন ছাড়া রোদের তাপে একটি প্রতিভা কতদিন আর বাঁচতে পারে! আমি তো জীবন সফরে পথহারা, ক্লান্ত, পরাজিত সৈনিকের মতো হতাশায় বিপর্যস্ত! আমার হৃদয়ের কান্না ও কলমের কালি সেই বোনের জন্য, যার হৃদয়ে আছে বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন-শিশির। যে লাভ করবে পথচলার শক্তি, ফিরে পাবে মানযিল। যে স্বপ্ন দেখে, একদিন সে বড় হবে; পৃথিবীকে না হোক অন্তত তার পরিবারকে, অনাগত প্রজন্মকে দান করবে একমুঠো কল্যাণ। কিন্তু না! ওরা ধরে নিয়েছে, তার জন্ম হয়েছে চুলোর পাড়ে বসে জীবনকে ভস্ম করার জন্য !! তাই তার দেহ আছে, প্রাণ নেই। সে বেঁচে আছে, জীবিত নেই।

এ সমাজ কি পারে না তার আহত হৃদয়ের আকুতি বুঝতে? চারপাশ কি পারে না একটু উদার চিন্তায় তাকে বরণ করতে? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তায় জড়িয়ে কেন প্রতিভাগুলোর প্রতি এ অবিচার? তবে কেন বলা হয়, 'মাতৃক্রোড় শিশুর সর্বোত্তম পাঠশালা'! আমাদের সমাজে মায়েদের কোল কি হতে পারছে সন্তানের সর্বোত্তম পাঠশালা ! মায়েরা কি হতে পারছে সন্তানের জন্য আদর্শ শিক্ষিকা! কোথায় মা ! আর কোথায় শিক্ষা ও আদর্শ ! শুধু দুধ-ভাত ও জামা-কাপড় কিভাবে হতে পারে একটি প্রতিভার জন্য প্রথম ও শেষ প্রচেষ্টা ? এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব কি আছে আমাদের কাছে?

আজকের চিন্তাশীল সমাজ নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক অবক্ষয়ের নানা কারণ তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো কেউ সমস্যার গভীরে যান না, ফলে সঠিক প্রতিকার ও নির্ণয় হচ্ছে না। হ্যাঁ। সামাজিক অধঃপতন ও নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে অর্থনৈতিক দুর্দশা ও বেকারত্বসহ নানা উপসর্গ ক্রিয়াশীল থাকতে পারে, কিন্তু অন্যতম কারণ হলো, ঘরে ঘরে আজ সুশিক্ষিত ও আদর্শ মায়ের অভাব। সেই কবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তা উপলব্ধি করতে পেরে বলেছিলেন, 'আমাকে শিক্ষিত মা দাও। আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো'। যা আজও এ সমাজের কাছে পরিষ্কার নয়।

নারীজাতির খুব সামান্য একটা অংশ আজ শিক্ষিত; কিন্তু কতটুকু? আর সিংহভাগ নারী তো ধর্মীয় শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত। বিশুদ্ধ জ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষায় নারীরা রয়েছে অনেক পিছিয়ে। অথচ ইসলাম নারীকে দিয়েছে অধিকার, দিয়েছে স্বাধীনতা- শিক্ষার ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে, চরিত্র ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে। দিয়েছে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা। কর্তৃত্বে পুরুষের দিয়েছে মর্যাদা আবার মা হিসেবে নারীকে মর্যাদা। হ্যাঁ উভয়ের দায়িত্ব ভিন্ন ও কর্মক্ষেত্র পৃথক। এটা মর্যাদা ও অধিকারের বৈষম্য নয়, বরং কর্ম-দায়িত্বের পার্থক্য এবং স্বভাব-প্রকৃতির তারতম্য। কিন্তু অধিকার ও স্বাধীনতা উভয়ের।

আমি ব্যথিত হই, রক্তাক্ত হই যখন দেখি, আলেম সমাজের মধ্যেই নারীদের ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা বিরোধী একটা ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে। যাদের করণীয় ছিল, নারীদের পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শিক্ষার বাস্তব নমুনা তুলে ধরা। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীদের ইসলামি কর্মক্ষেত্র জীবন্ত করা। তাই অবাক লাগে না যখন বুঝি, প্রগতিশীল সমাজ তাঁদেরকে নারী অধিকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। এটা কি তাঁদের প্রাপ্য নয়!! তারা তো নারী অধিকারের আংশিক নিশ্চিতকরণের আওয়াজ তুলেন ! কিন্তু শিক্ষা, চিন্তা-চেতনা ও সমাজ বিনির্মাণে নারীদের পূর্ণাঙ্গ ইসলামি অবকাঠামো তুলে ধরতে পারেন না বা সাহস পান না।

তাঁরা বরং বিশ্বাস করেন, ইসলামের বিস্তৃত শিক্ষা রেখে প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধ কিছু মাসায়েল শিখাই মেয়েদের জন্য যথেষ্ট। আহ্! আমরা কি আয়েশা রা. র অগাধ জ্ঞান এর কথা ভুলে গেলাম! সেই হাদিসকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেললাম ! যেখানে আছে, আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব লাগলে আমরা আয়েশা রা. র শরণাপন্ন হতাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে সমাধান নিয়ে আসতাম। জামে তিরমিযি: ৩৮৮৩

কেন তবে শিক্ষাঙ্গনের এত মহড়া? এ সীমাবদ্ধ জ্ঞান তো ঘরে বসেই অর্জন করা সম্ভব। কুরআন, হাদিসের যথাযথ শিক্ষা ও গভীর জ্ঞান কি প্রতিষ্ঠানের কাছে নারীদের প্রাপ্য নয়? শ্রদ্ধেয় আলেমদের সান্নিধ্য থেকে এ অধিকারটুকু পাওয়ারও হক রাখে না? ধর্মীয় অঙ্গনে পর্দার পরিবেশে যদি মাতৃত্বকে উন্নত শিক্ষার ভূষণে ভূষিত করা না যায়, নারীত্বের প্রতিভার মূল্যায়ন না হয়, তবে কেন কলেজ-ভার্সিটিতে মেয়েদের অবাধ বিচরণ? সাধারণ শিক্ষায় ও পার্থিব জ্ঞানে কেন এ অনুমোদন? অন্যায়ের প্রতি নমনীয়তা ও সত্যকে সীমাবদ্ধ করণে কঠোরতা কিছুতেই কল্যাণকর নয়।

আহ্! জানি না কত অজুহাতে আর বিপুল সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটবে? সম্ভাবনাগুলোর নির্দয় অপচয় দেখে অন্তত আমরা কিভাবে খুশি হতে পারি! আমাদের মন তো বলে, সচেতন আলেম সমাজ এই চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় স্বার্থান্বেষী ইসলামবিদ্বেষীরা লুফে নিয়েছে সুযোগটাকে। পশ্চিমাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মেয়েকে ছেলের জায়গায় দাঁড় করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে মুসলিম মেয়েরা ধর্মহীন উচ্চশিক্ষার নামে সর্বস্ব হারিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের চির অভিশাপ কুড়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের এ সম্ভাবনাকে মুছে ফেলার কুফলেই আজ থানভি, বুখারি জন্ম নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

তাইতো দ্বিধাহীন কণ্ঠে আওয়াজ তুলি, মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শিক্ষা নিশ্চিত করুন। অন্তত পারিবারিক জীবনে নারীর ইসলামি অধিকার জীবন্ত করুন। শতশত বুখারি, থানভি পয়দা হওয়ার স্থানকে উন্মোচিত করেন। মেয়েদের জন্য দ্বীন প্রচারের কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করুন। স্বয়ং কুরআনে আল্লাহ পাক মহীয়সী নারী মারিয়াম আ. সম্পর্কে বলেন, ছেলেটি ওই মেয়ের মতো নয়। আল ইমরান: ৩৬

মেয়েদের ইলমি অঙ্গনে ফের জাগরণ উঠুক। খুলে যাক সম্ভাবনার সকল বদ্ধ দুয়ার।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ