সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
চিকিৎসকরা বছরে দুইবারের বেশি বিদেশ যেতে পারবেন না ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে খুলনায় গেলো পরীক্ষামূলক ট্রেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা: প্রেস উইং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের

মক্তব-হেফজখানার অপ্রীতিকর ঘটনা রুখতে দরকার সিস্টেমের আমূল পরিবর্তন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফারুক ফেরদৌস: হেফযখানায় শিশু নির্যাতন নিয়ে গত দুই তিন দিন ধরে বেশ কথা বার্তা হচ্ছে। একজন আমাকে অনুরোধ করেছেন আমি যেন লিখি হেফযখানায় এত বেশি মার খাওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ে? এ থেকে উত্তরণের পথ কি তার একটা রূপরেখাও যেন দেই। আমি চুপ ছিলাম কারণ এই বিষয়ে আমার মতামত বেশ বিপদজনক। আমার মত অনেকেরই পছন্দ হবে না।

আমি মনে করি, হেফযখানা ঘিরে এত সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ কুরআন পড়া ও হিফযের যে পদ্ধতি ভারতীয় উপমহাদেশে অনুসরণ করা হচ্ছে তা রসূল সা. ও সাহাবীদের সুন্নাহের বিপরীত, অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক। এই পদ্ধতি নবীজি, সাহাবী, তাবেয়ী তাবে তাবেয়ী ও আয়েম্মায়ে মুজতাহিদীনের আমলের সুন্নাহের বিপরীত তো বটেই, এখনও উপমহাদেশ ছাড়া সারা পৃথিবীতে কোথাও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না।

কুরআন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ শুধু এর বিধানাবলী ও বক্তব্যের কারণে নয়। এর অসাধারণ সাহিত্য, লালিত্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় ভাষার কারণেও। শুধু সাহিত্য হিসেবে পড়লেও কুরআন পাঠ অত্যন্ত আনন্দময় কাজ। আর অন্তরে বিশ্বাস থাকলে সেই আনন্দ স্বর্গীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কিন্তু ভারতীয় হিফযখানাগুলোতে এই কুরআন পাঠই হয়ে ওঠে অত্যন্ত নিরানন্দের একটা কাজ, যেহেতু কুরআন বোঝার মতো ভাষাজ্ঞান না শিখিয়েই কুরআন হিফয করানো শুরু করা হয়। হেফযখানার ছাত্ররা কুরআন পড়ে অনাগ্রহ ও নিরানন্দ নিয়ে। কুরআনের প্রতি যথাযথ ভক্তিও তাদের অন্তরে থাকে না। কুরআনের আয়াত দিয়ে নানা রকম ছড়া বানায় তারা। আমার নিজের কাছেও হেফযখানায় কুরআন পড়া নিরানন্দের কাজ ছিলো। কুরআন আগ্রহের সাথে পাঠ করেছি, কুরআন পাঠের স্বর্গীয় আনন্দ পেয়েছি কুরআন বুঝতে শেখার পর।

যে কোনো স্বাভাবিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণ রীতি হলো, শিশু পড়বে নিজের আনন্দে ও আগ্রহে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য বেত রাখতে হয়। কিন্তু মূলত ওই পড়াশোনায় সে কিছুটা হলেও আনন্দ পায়, আগ্রহ বোধ করে। হেফযখানায় যেহেতু সেটা নাই, তাই বেতই হয়ে ওঠে সাধারণ রীতি। বেতের বাড়ি না খাওয়াটাই সেখানে অসাধারণ। বেতের ব্যবহার তো সব পড়াশোনায়ই কিছু কিছু থাকে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন মাদরাসার কিতাব বিভাগেও বেত্রাঘাত একটা ঘটনা। মানে কেউ বড় কোনো দোষ করলে বা ধারাবাহিকভাবে পড়া না পারলে কালেভদ্রে বেত্রাঘাতের ঘটনা ঘটে। আর হেফযখানায় বেত্রাঘাত হলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হেফযখানার সবচেয়ে ভালো ছাত্রটাও দিনে কয়েকটা করে বেতের বাড়ি খায়।

আরেকটা ব্যাপার হলো, একটা আট নয় বছরের শিশু দিনে কয় ঘণ্টা শিক্ষকের সামনে বসে পড়তে পারে? এই সময়টা বেশির বেশি আট ঘণ্টা হওয়া উচিত। তার খেলাধুলার পর্যাপ্ত সময় থাকা উচিত। তার বাসায় মা বাবার সাথে কাটানোর মতো পর্যাপ্ত সময় থাকা উচিত। সাধারণ সব শিক্ষা ব্যবস্থায়ই সেটা থাকে। কিন্তু হেফযখানায় একটা শিশুকে শুধু খাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া, বিকেল বেলার সামান্য সময় ছাড়া সারা দিন শিক্ষকের সামনে বসে থাকতে হয়। ফজরের পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। এই চাপ অনেকেই নিতে পারে না।

শিশুকে সারাদিন শিক্ষকের সামনে বসিয়ে রেখে ধারাবাহিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে খুবই নিরানন্দের একটা কাজ করতে বাধ্য করার প্রক্রিয়াটাই আসলে অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক। তাই শিক্ষককে যতোই প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক, যতোই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হোক এই অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

শিক্ষকরাও থাকে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে। একজন মানুষ সারাদিনে আট ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ বারো ঘণ্টা কাজ করতে পারে। বাকি সময় সে অবসর থাকবে, পরিবারকে সময় দেবে এটাই হলো স্বাভাবিক। একটা ব্যবস্থায় সব শিক্ষককে যদি মাসজুড়ে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে থাকতে বাধ্য করা হয়, পরিবার থেকে দূরে রাখা হয়, কিছু মানুষের মধ্যে সেইটার একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তো দেখা যাবেই।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণ চাইলে আরবী শেখানো শুরু করতে হবে অন্য সব ভাষার মতো। কোনো ছাত্র যখন আরবী পড়তে শিখবে, সে আরবী বুঝতেও শিখবে। আরবী পড়তে ও বুঝতে শেখার পর যাদের আগ্রহ ও কিছুটা এক্সট্রা অর্ডিনারি মেধা থাকবে তারা হিফয পড়বে। হিফয চলবে অনাবাসিক থেকে অন্য পড়াশোনার পাশাপাশি। মাদরাসার কিতাববিভাগের বহু ছাত্র কিতাব বিভাগের পড়াশোনার পাশাপাশি হাফেয হয়। এটাকেই একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আনা যায়। মসজিদে নববীতে শুধু বিকালে পড়ে মদিনার বহু ছাত্র হাফেয হয়। বাংলাদেশেও শুনেছি এরকম কিছু হিফয বিভাগ গড়ে উঠছে।

একটা কথা মনে রাখবেন, হাফেয হওয়ার জন্য কিছুটা এক্সট্রা অর্ডিনারি মুখস্থশক্তির দরকার হয়। সাধারণ পড়াশোনায় মেধাবী অনেক ছাত্রেরও ওই পরিমাণ মুখস্থশক্তি থাকে না। আমি এরকমও দেখেছি, একজন ছাত্র চার বছর হেফয খানায় বসে থেকে, প্রচুর মার খেয়েও হাফেয হতে পারেনি, কিন্তু আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে মার খাওয়া ছাড়াই খুবই ভালো পড়াশোনা করেছে, দাখিলে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। যে সহজে হিফয করতে পারবে, যার সেরকম আগ্রহ থাকবে, সেই হাফেয হবে। সহজে না হলে হিফযের জন্য শিশুর ওপর চাপ প্রয়োগ করা অনুচিত। গণহারে সবার হাফেয হওয়া দরকারি কিছু না। তারচেয়ে অন্যান্য দীনি ইলম শেখা বেশি জরুরী। কুরআন বুঝতে শেখা বেশি জরুরী।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ