আওয়ার ইসলাম: মাদরাসাছাত্রী মিস নিশো। বর্তামন নাম বিজ্ঞানী ড. নিশা মোহাম্মদ রফিক। বয়স (৩২)। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক। সম্প্রতি তিনি মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। এসব গবেষণার মধ্যে মস্তিষ্কের অ্যালঝেইমার রোগও আছে।
তিনি বলেন, ‘যে সব ব্যক্তির অ্যালঝেইমার রোগ আছে তারা পাগলের মতো আচরণ করে। সিংগাপুরে ‘মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে’ খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ, দেশটিতে প্রচুর বৃদ্ধ মানুষ আছে। আমি আমার কাজকে এমন একটি স্তরে নিয়ে যেতে চাই যার মাধ্যমে অন্যদের উপকার হয়। আমি কোনো মৌলিক বিজ্ঞান তৈরী করতে চাই না, যা মানুষকে আনন্দ দিবে বা তাদের কৌতুহল নিবারণ করবে। কিন্তু আমি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন কাজ করতে চাই যার ফলাফল হবে যুগান্তকারী।’
বিজ্ঞান সম্পর্কে তীব্র আগ্রহ থাকার কারণে তিনি তার মতো বিজ্ঞানপ্রেমী লোকদের সমবেত করেন এবং মাদরাসা ওয়াক তানজংয়ে প্রথম একটি বিজ্ঞান ক্লাব গঠন করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ড. নিশা যখন তেমাশেক পলিটেকনিকে ‘বায়োক্যামিকাল সাইন্স’ নিয়ে পড়া শুরু করেন তখন তিনি ভেঙে পড়েন। কারণ, তিনি আরবি সাহিত্যকে খুব ভালোবাসতেন, আর তার মন চাচ্ছিল মাদরাসায় ফিরে গিয়ে আরো পড়াশোনা করতে এবং মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে পড়তে।
এসব সত্ত্বেও তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সফলতা লাভ করেন। ড. নিশা যখন ‘জীববিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যার ওপর’ তার ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তখন তিনি সর্বোচ্চ নম্বর (এ*স্টার) পেয়ে সরকারি স্কেলারশিপ পান এবং আরো আনেক পুরস্কার পান। তিনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এনইউএস) থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন এবং পর পর দুবার তাকে বিদায়ী বক্তৃতা দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়।
ড. নিশার মতে, তিনি পড়াশোনার প্রতিটি স্তরে অনেক বিজ্ঞ পরামর্শদাতার সন্ধান পান যা তার সফলতাকে ত্বরান্বিত করে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন মাদরাসায় ছিলাম তখন সেখানকার প্রিন্সিপাল আলমাহরুম উসতাজ মুহাম্মদ নুর আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সেটাই করো যেটা তুমি পছন্দ করো’। তাছাড়া যখন আমি পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই এবং সেখানে কাজ করি তখন আমি অনেক পরামর্শদাতা পেয়েছি। যারা খুব ভালো লোক ছিলেন, চমৎকার সহযোগী ছিলেন,’ বলেন তিনি।
উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন পল থমাস মাটসুদাইরার নাম। জানান, “যখন আমি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন যে ব্যক্তি আমাকে ‘মেক্যানোবাইলজিতে’ পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়ে উৎসাহিত করেন তিনি হলেন পল থমাস মাটসুদাইরা, যিনি একজন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞানের প্রধান ছিলেন।”
‘আমি যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি তখন তিনি আমাকে একটি ছবি দেখান। ওই ছবিতে তিনি একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছিলেন। এ ছবি দেখিয়ে তিনি আমাকে উৎসাহিত করেন। ওই সময় আমি বুঝতে পারলাম, কর্মক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট লোকের আবির্ভাব হবে যারা জানে তরুণ হিসেবে আপনি কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন,’ বলেন ড. নিশা।
যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার কি কখনো মনে হয়েছে বিজ্ঞান ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। ড. নিশা এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘তিনি যতই বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেছেন ততই সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মের প্রতি তার বিশ্বাস পোক্ত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শরীরের কোষগুলো নিজেরাই বিশ্বের এক বিস্ময়। তাদের নিজেদেরই একটি জগত আছে। আমি এটা কল্পনা করতে পারছি না কিভাবে মানুষ এটা তার শরীরে পেল। এ ছাড়া আমি পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি খুবই কৌতুহলী। আমি এতে খুব অবাক হয়েছি যে সূরা ইয়াসিনে বলা হয়েছে- সময় হলো আপেক্ষিক। যখন আমি মাধ্যমিকে পড়ি তখন আমার শিক্ষক আমাকে উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্ক দিয়েছিলেন করতে। কারণ, আমার মনে হয়, তিনি জানতেন, আমি এ বিষয়ে আগ্রহী। এভাবে আমি আপেক্ষিকতা সম্পর্কে জেনেছি। তখন আমি মাধ্যমিকের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি।
ড. নিশার শিক্ষা জীবনেও উত্থান-পতনও আছে। তিনি বলেন, ‘গবেষণার সবচেয়ে কঠিন অংশ হলো যখন আপনি দেখবেন যে, আপনার পরীক্ষা/গবেষণা পদ্ধতি অনুসারে কাজ হচ্ছে না।’ পিএইচডি ডিগ্রির জন্য সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বৃত্তি নিয়ে তিনি যখন লন্ডনের কিংস কলেজে ছিলেন তখন তার গবেষণা সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলো তিন-চার মাস ধরে কাজ করেনি।
তিনি বলেন, “সে সময় আমি আমার মাকে ফোন দিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি যদি এখানে থাকতে।’ তিনি আমাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘তুমি সাফল্যের আর মাত্র কয়েকটি ধাপ পেছনে আছো। তুমি এত চিন্তিত হচ্ছো কেন? পরে আমি আবার গবেষণায় ফিরে এলাম এবং আবার নতুন করে শুরু করলাম। আমি আবার নতুন করে পরিকল্পনা করে শুরু করেছিলাম। এক সময় আমার গবেষণা সংক্রান্ত পরীক্ষাগুলো খুব ভালোভাবে বাস্তবেও কাজ করতে শুরু করল।”
একজন উচ্চপর্যায়ের পরামর্শদাতা হিসেবে ইবতেদায়ি (প্রাথমিক স্কুল সমমান) মাদরাসাছাত্রদের জন্য তার পরামর্শ হলো, “কখনো ভেবো না যে এ ব্যাপারটা ‘উখরাবি’ আর এটা ‘দুনিয়াবি’। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাদরাসায় প্রচুর ভালো ছাত্র আছে। তারা যদি চেষ্টা করে, তাহলে তাদের সাথে অন্যদের কোনো পার্থক্য থাকবে না। আমি যদি আবারো শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে আমি আবার একজন মাদরাসাছাত্রী হতে চাইতাম।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, তরুণরা ভদ্র হবে এবং সব সময় আরো বেশি জানার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। তার মতে, ‘যদিও এটা তোমার কাছে প্রথম কয়েক বছর খুবই কঠিন বলে মনে হবে। তবু, তুমি নিরাশ হবে না। এটা তোমার কাছে খুবই কঠিন লাগবে। তোমরা সেটাই জানা উচিৎ যেটা তুমি পছন্দ কর এবং এটার সাথে লেগে থাকো। আমি যদি নিজেকে তরুণদের হিতাকাঙ্ক্ষী বলে মনে করি। আমি তাদের বলতে চাই- ব্যর্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা আপনাকে একজন সফল ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করবে। তরুণদের কখনোই পিছুহটা উচিৎ নয়।’
ড. নিশা সব সময় রাসূল সা. এর তায়েফে থাকাকালীন সময়ের কথা স্মরণ করেন, যখন তাঁকে নিয়ে উপহাস করা হচ্ছিল, তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। হজরত মোহাম্মদ সা. ১৩ বছর মক্কায় ছিলেন। ওই সময় তিনি তায়েফে থাকাকালীন সময়ের মতো একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরে তিনি মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। ১৩ বছর তিনি কতই না কষ্ট করেছেন। সেই বিষয়টিকেই আমি আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে মনে করি। সূত্র : মুসলিম ডট এসজি