শেখ খালিদ সাইফুল্লাহ ।।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা কালে দীর্ঘ আট মাস পাঠদান শেষ,কওমি অঙ্গনে এখন চলছে রীতিমতো ব্যস্ততা,ছাত্র শিক্ষক সবাই নিজ অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে ব্যস্ত।শিক্ষকরা নেসাব বা নির্ধারিত পাঠ্যসূচীর দরস যথা সময়ে সম্পন্ন করতে সচেষ্ট থেকে কেন্দ্রীয় ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহনে ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।
অপরদিকে খাহেসাতে জিন্দেগীর সকল লোভ-লালসা ত্যাগ করে আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে অহীর সুধা পানে কওমি অঙ্গনের তালিবে ইলমরা বার্ষিক মূল্যায়ন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক চুড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহনে মাথা বেঁধে মুতালা'য়া আত্মনিয়োগ করছে।নবী কাননের পুষ্প থেকে মধু আহরণে তাদের প্রতিটি প্রহর কাটছে মৌমাছির গুঞ্জনে৷ প্রত্যেকেই ইলমে ওহীর অমিয় সুধা আস্বাদনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
সকলেই খুঁজছে তারা সফলতার সুগম্য রাজপথ।আজ কওমি আঙ্গিনাগুলো কোকিলাকন্ঠে গুনগুন শব্দে সরব।যার নজির বা অনুরূপ দৃশ্য অন্য কোন শিক্ষাঙ্গনে পাওয়া দুষ্কর। অপরদিকে জাগতিক শিক্ষায় এর বাস্তবতাও উপলব্ধি হয়না। সত্যিই প্রতিটি মাদ্রাসার এ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ জাতিকে অনুপ্রাণিত করছে। বছর শেষে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অসংখ্য নাইবে নবী ইলমে ওহীর ধারক বাহক হয়ে সমাজে দ্বীনের খেদমতে বেরিয়ে পড়বে। তবে জেনে রাখা ভাল যে, আপনাদের এ অন্বেষণ শেষ হওয়ার নয়।
এর পরিপক্বতা সাধনে ছুটে যেতে হবে দেশ থেকে দেশান্তরে৷নিজেকে শরিয়তের অনুকরণে নবীর আদর্শে গড়ে তুলতে বন্ধুর পথে অর্জন করতে হবে ইলমে অহীর অনেক প্রায়োগিক নিদর্শন।এর পরও তা শেষ হবার নয়,সেটাকে যথাযথ আমলে পরিণত করা ছাড়া পরিপূর্ণতা আসবে না।আর এ পরিপূর্ণতা তখনই উপলব্ধিতে আসবে যখন কোন আলেম ইলম অনুযায়ী আমল করে পরিতৃপ্তি হাসিল করবে৷
এব্যাপরে একদা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. তাঁর ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘ইলমের অর্থকী?’ কেউ বলল, জানা। কেউ বলল, চেনা।এছাড়াও একেকজন একেকটা বলল। হযরত চুপ করে শুনছিলেন। কিছুক্ষণ পর এক তালেবে ইলম বলল, হযরত আপনিই বলুন। বড়দের কথাও বড়হয়। তিনি অপূর্ব এক কথা বললেন।
তিনি বললেন— ‘ইলম এমন একটা নূর, যা অর্জিত হওয়ার পর আমল না করা ছাড়া স্বস্তিতে থাকা যায় না। অবস্থা যদি এমনই হয়-যে আমল করলে স্বস্তি অনুভব হয় তবেই সেটা ইলম, না করলে অস্বস্তিবোধ মনে হয় ,তবে সেটা কেবল বোঝা।’ তা আল্লাহ প্রদত্ত ইলম নয়। (মাওলানা যুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী—এর বয়ান সংকলন থেকে সংগৃহিত)
খতীব বাগদাদী রহ তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন- অর্থাৎ ইলম এমন একটি জিনিস,সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণনা তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ করবে।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ইলমের জন্য যেমন পিপাসা থাকা প্রয়োজন ঠিক তেমনি ভাবে প্রয়োজন অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের। ইলমের পথে কোন শটকাট বলতে কিছুই নেই। এ পথ দীর্ঘ। কন্টকাকীর্ণ। বন্ধুর এপথে পরিক্ষা দিতে হয়। ধৈর্য ও কষ্টের পরীক্ষা। ইলমের প্রতি আকুলতা ও ভালবাসার পরীক্ষা।
ইলম মানেই অজানা বিষয়ের জ্ঞান। এই জ্ঞান বাড়তে থাকলে নিজের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে।দু:খের বিষয় হলো আজ এ ইলমের জন্য নিবেদিত লোকের
সংখ্যা খুবই কম।বর্তমান এ ফেতনার জামানায় চারিদিকে জাহালাতের ছড়াছড়ি।আলেমরাও এসব ফেতনায় জড়িয়ে পড়ছেন পর্যাপ্ত ইলম অর্জনের অভাবে। সাধারণ মানুষের অবস্থা তো আরও করুণ। যুবক ভাইদের অবস্থাও দু:খজনক।ফলে তাদের অনেকেই অব্যাহত ইলম অর্জনে হন বাধাগ্রস্ত, এমনকি অর্জিত জ্ঞানের স্বাদ আস্বাদনেও হন ব্যর্থ ৷
পাঠকের জ্ঞাতার্থে কিছু প্রবণতা উল্লেখ করছি-
১. যুবক ভাইদের মধ্যে একটি মারাত্মক সমস্যা চোখে পড়ে তা হলো- কোন বিষয়ের গভীরে না যাওয়া। ইলমের পথে তার সময় ব্যয় হয়তো দু’মাসের কিংবা দু’বছরের। দু’মাস বা দু’বছর কী ইলমের জন্য যথেষ্ট? অনেককে তো দেখা যায় দু’একজন শায়খের দু’একটি লেকচার থেকেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যান।
অথচ বিষয়টি এতটা সহজ নয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এটি অহংকারে রূপ নেয়। যাদের মধ্যে ইলমের অহংকার ঢুকে যায়,এদের জন্য ইলম রহমত হয় না;এটি তার ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। কথায় আছেনা? 'অল্প বিদ্যা ভয়ংকর '৷ খুব সামান্য জেনেও অহংকারী আচরণ করা,এটা খুবই দু:খজনক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে 'অল্পতে তুষ্টি' কথাটি ধর্তব্য নয়৷ সুতরাং ইলমের গভীরতা উপলব্ধিতে সচেষ্ট হওয়া চাই৷তেমনি অনেক বড় জ্ঞানী হলেই এই অহংকার আসবে, বিষয়টা এমনও নয়। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো,যিনি যতো বড় জ্ঞানী,তাঁর বিনয় ততো বেশি হওয়া উচিত।
২. অনেকের মধ্যেই একটা বিশেষ প্রবণতা দেখা যায়। নিজের ইলমকে যথেষ্ট মনে করা ও আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলা। ভাবেন, আমি তো অনেক জেনে ফেলেছি, আমার মতো আর কে আছে। এই ধরণের আত্ম-প্রবঞ্চনা ইলমের পথে অন্যতম অন্তরায়। নিজের ইলমকে সবসময় বড় বড় আলেমদের সামনে পেশ করা এবং নিজের অবস্থানকে সর্বদা যাচাই করতে থাকা খুবই জরুরী।বাস্তবতা হলো, আমাদের জানার তুলনায় অজানা বিষয় বেশি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'তোমাদেরকে খুব সামান্য ইলম দেয়া হয়েছে'।
এই সামান্য ইলমের অধিকাংশও আমাদের অজানা। সুতরাং এত বড় অজ্ঞতা থাকা সত্বেও নিজ জ্ঞানের পুর্ণতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা আসলেই বোকামী।
৩. যুবক ভাইদের মধ্যে একটা ভয়ংকর রোগ দেখা যায়। তারা এ আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ছোয়ায় ভিডিও ও অডিও নির্ভর হয়ে যাচ্ছেন,মূল কিতাব পড়ার প্রতি আস্তে আস্তে তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে, এটা সত্যিই ভয়ংকর একটা বিষয়। সত্য কথা হলো, অডিও-ভিডিও কখনও কিতাবের বিকল্প হতে পারে না; কখনও নয়। প্রয়োজনের খাতিরে অডিও-ভিডিওর সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে, তবে প্রকৃত ইলমের জন্য কিতাব অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই।
৪. দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের সাধারণ ভাইয়েরা যখন ইলমের পথে অগ্রসর হোন,সামান্য জেনেই অন্যদেরকে হেয় করতে থাকেন। বড় বড় আলেমদেরকে নিয়েও কথা বলেন। আপনি যে বিষয়ে কথা বলছেন, সেটা হয়তো আলেমের অজানা,বা আলেমের বুঝের ভুল, কিন্তু সেই আলেমকে তাচ্ছিল্য করাটা আপনার জন্য শোভনীয় নয়।যারা বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে পাশ করে দ্বীনের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দেন,তাদের কেউ ইলম অর্জনে পরিপক্কতা হাসিল না করতে পারলেও সে যথেষ্ট সময় ব্যয়ে করেছে ইলমের পেছনে। এক্ষেত্রে সে বড় বড় আলেমের দরসে বসার সুযোগ পেয়েছে দীর্ঘ সময়।
তার যোগ্যতা কম হলেও এসব দরসের বিশেষ বরকতের কারণে তার মধ্যে এক ধরণের বুঝ তৈরি হয়। আলেমদের সান্নিধ্যে অর্জিত এ বুঝটি তার সারা জীবনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। এধরণের সাধারণ পর্যায়ের আলেমও বিভিন্ন ফেতনা থেকে সহজে মুক্ত থাকতে পারে।পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এধরণের সুযোগ খুবই কম। আলেমদের সান্নিধ্যে গিয়ে ইলম অর্জনের সুযোগ তেমন হয় না। এ কারণে তাদের মধ্যে এই বুঝ আসতে সময় লাগে। দ্বীনের প্রকৃত বুঝ অর্জনে আলেমদের সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই।
বর্তমান জামানায় সাধারণ মানুষের সামনে হাজারও ফেতনার দরজা উন্মুক্ত। সেকুলারিজমের দাওয়াত তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। অধিকাংশ দাওয়াতের পেছনে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত। অন্যান্য সকল জামানার তুলনায় বর্তমান সময়ের মুসলমানদের ইলমের প্রতি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হওয়া প্রয়োজন। ইলম থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই এসব ফেতনায় আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। এজন্য সর্বদা ইলম শেখার পেছনে সময় দিতে হবে, দীর্ঘ সময় ব্যায় করে ইলম শিখতে হবে। বলা হয়-“দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিদ্যার্জন কর”। তাই আলেমদের সান্নিধ্যে গিয়ে ইলমের গভীরতা অর্জন করতে হবে।
ইলমের পথে আপনার এই যাত্রা অব্যাহত থাকুক আমৃত্যু।আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সেই তাফাক্কুহ দান করুন, যার মূলে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। আপনার এ পথের যাত্রা শুরু হবে দুনিয়ায়। এ পথের শেষ মঞ্জিল জান্নাত। রাসূল সা. বলেন-যে ইলমের পথে যাত্রা শুরু করবে, আল্লাহ তায়ালা তার জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন। (বোখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম)। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে ইলমের জন্য কবুল করুন। আমীন।
শিক্ষক ঢাকাদক্ষিণ দারুল উলুম হুসাইনিয়া মাদ্রাসা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
-এটি