খাদিজা ইসলাম।।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাঠমারচর গ্ৰামে ইমরানের বসবাস।পড়াশোনা করে ঢাবিতে।গ্রামটি ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দূ্র্যোগের সম্মুখীন হয়। তাদের জীবনযাত্রা মানবেতর হয়ে উঠে। টোঙের ভেতর একই পরিবারের নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং সকল সদস্যরা মিলে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।
তাদের কোনো আয়ের উৎস ছিল না এবং খাবারের কোনো ব্যবস্থা তখন ছিল না। নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য এসব টোঙগুলি প্রতিনিয়তই এক ভয়ানক চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছিল। চারিদিকে শুধু লোনাপানি থাকার কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ছিল অঞ্চলের মানুষ। গ্রামের মানুষের চরম দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ঢাবির শিক্ষার্থী এ ইমরান হোসেন।
কাঠমারচর গ্রামের শেখ আমিরুল ইসলাম ও লুৎফুন্নেসা বেগমের সন্তান ইমরান। উপকূলে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই এসব দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি দেখে এসেছেন ইমরান। উপকূলে পানির অভাব না থাকলেও নিরাপদ সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থা নেই। মৎস্য শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এই উপকূলবাসীরা দুর্যোগের সময় খুবই অবহেলিত এবং চ্যালেঞ্জিং জীবনযাপন করেন। উপকূলের নারীদের দুর্যোগকালীন সুরক্ষার বিষয়টি সবসময় অবহেলিত থেকেছে।
২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা হয় তখন ইমরানের বয়স মাত্র নয় বছর। সেই ছোট বয়সে ইমরান গ্রামের নারীদের অসহায় অবস্থাটি পরিলক্ষিত করেছিল। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের জন্য ত্রাণের ট্রলার আসতো। কিন্তু সেই ত্রাণের মধ্য নারীদের সুরক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থাই থাকত না। এছাড়া মানবিক সহায়তা এতটাই কম ছিল যে অধিকাংশ নারীরা না খেয়ে জীবনযাপন করেছে। সেই সময়ের বিষাদময় অভিজ্ঞতা থেকে তারুণ্যের উজ্জল দিপ্ত ইমরান এখন নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে বদ্ধ পরিকর।
আমফানের তাণ্ডবের পর তার গ্রামের নারীরা যখন এ রকমই দুর্দশাগ্রস্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছিল ঠিক তখনই ইমরান তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইমরানের সবচেয়ে শক্তি জায়গা তার ফটোগ্রাফি। বন্যাকালীন তিনি ছবি এবং ভিডিওর মাধ্যমে তার গ্রামের মানুষের এবং নারীদের দুর্দশার চিত্রটি ফেসবুকের মাধ্যমে পুরো দেশকে জানাতে সক্ষম হয়েছিল। তার প্রত্যেকটি ছবি এবং ভিডিও যেন জীবন্ত হয়ে এসব দুর্যোগ কবলিত অসহায় নারীদের দুর্দশার চিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিল।
দুর্যোগকালীন গ্রামীণ নারীদের সুরক্ষায় এবং নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ইমরান ইতিমধ্যেই গ্রামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তার সংগঠনের মাধ্যমে তিনি গর্ভবতী নারীদের সুরক্ষা এবং নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এছাড়া উপকূলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার শুরু করেছেন। তার এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি উপকূলের কিশোরীদের শতভাগ শিক্ষার হার বাড়াতে চান এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে চান। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে মানবিক ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুর্দশাগ্রস্ত দূরদশাগ্ৰস্থ প্রায় গ্রামের ১৫০ পরিবারকে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছিলেন।
এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে প্রায় পাঁচ স্তরের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের পাশে থেকেছেন।
তার মানবিক সহায়তা কার্যক্রমগুলোতে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের পাশাপাশি গ্রামের প্রতিটি নারীকে সেনিটারি ন্যাপকিন দিয়েছেন। এছাড়া দুর্যোগ কবলিত এসব গ্রামীণ নারীদের সচেতনতার উদ্দেশ্য ইতিমধ্যেই এ বিষয়ক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন।
এছাড়া ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, ফনি এবং বুলবুলের সময় তিনি বিভিন্ন সচেতনতামূলক লিফলেট এবং দুর্যোগের সিগনাল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। দুর্যোগের সময় অসুস্থ নারী এবং বৃদ্ধদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামের তরুণদের নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
করোনা মহামারির সময়ে তার গ্রামের তরুণদের সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি গ্রামের দুর্দশাগ্রস্ত গরিব মানুষের পাশে থেকেছেন। প্রতিনিয়তই গ্রামীণ নারীদের অধিকার এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইমরান। তার মতে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হতে পারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এজন্য তিনি গ্রামীণ এসব নারীদের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার দিকে জোর দিয়েছেন।
নিজের পরিবারের সংকট মুহূর্ত থাকা সত্ত্বেও তাকে কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি। লোনাপানির সমুদ্রে বাস করেও তার গ্রামের মানুষের পাশে থেকেছেন এবং তাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। করোনা মহামারীর সময় যখন সব স্কুল বন্ধ!ঠিক তখন তার গ্রামের ঝরেপড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে গ্রামের কিছু অভিভাবকদের সহায়তায় বিনা বেতনে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন, 'আমরা সবাই রাজা' নামের একটি ভ্রাম্যমান স্কুল। তার স্কুলে বর্তমানে ৩৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং জীবাণু নাশকের মাধ্যমে তাদের সুরক্ষা দিকটিও নজর দিয়েছে । ইমরানে বক্তব্য, তারুণ্য কখনও মাথা নোয়াবার নয় সেটা বরাবরই প্রমাণ করেছে তরুণরা। অজ্ঞতা, মূর্খতা, কুসংস্কার দূর করে গ্রামের মানুষ কে স্বনির্ভর করেছেন! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার এক অংশ ইমরানরা। এলাকাবাসী ইমরানকে তাদের মাঝে পেয়ে অনেক খুশি। ইমরানের স্বেচ্ছাসেবাকে সাধুবাদ জানিয়েছে ।
লেখক- শিক্ষার্থী, সরকারী তিতুমীর।
-কেএল