মিনহাজ উদ্দীন আত্তার
পুরুষের শুক্রানু গিয়ে মহিলার জরায়ুতে, ডিম্বানুর সাথে মিলিত হয়ে আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হয় জমাট রক্তে, এরপর রূপান্তরিত হয় গোস্তের টুকরায়। তারপর রূপান্তরিত হয় অস্তিতে। এরপর আল্লাহর হুকুমে সঞ্চালিত হয় প্রাণ। দীর্ঘ দশ মাস দশ দিন গর্ভে থাকার পর ভ‚মিষ্ট হয়ে দুনিয়াতে আগমন করে এক নবাগত বাচ্চারূপে। শিশুকাল পেরিয়ে প্রতিটি জীবন শুরু হয় শৈশবের মাধ্যমে, আসে কৈশর, অনুভব ও চাহিদার নতুন মাত্রা যোগ হয়, খেলাধূলায় আসে পরিবর্তন। তারুণ্যের উচ্ছলতা, দুর্বারগতি, উদ্যম ও সৌন্দর্যবোধ তখন জীবনের ধারাক্রম চালিত করে, আসে নতুন প্রেরণা ও চেতনা। গন্তব্য তাকে হাতছানি দেয় বাধার বিন্ধাচল পেরিয়ে যেতে।
শক্তি, গতি আর মনোবল তখন হয়ে যায় দুর্বিনীত। আকাশ বাতাস সাগর অরণ্য সবই যেন তার হাতের মুঠোয়, সত্বর চলে আসে পৌরত্ব, বুদ্ধি, বিবেক ও জ্ঞানে নতুন মাত্রা যোগায়। চঞ্চলতার ডাল পড়ে কৌশল ও প্রজ্ঞা তখন সে স্থান দখল করে যৌবনকাল। যৌবনকাল হলো মানবজীবনে ভরা বসন্ত। শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জীবন সাহারায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই যৌবনকাল। শারীরিক ক্ষমতা, সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা, স্বপ্নের প্রাচুর্য আর প্রতিযোগী চিন্তার জোরে একজন যুবক এমন অনেক অসাধ্য সাধন করে বসতে পারে যা সে কৈশোরে ভাবেনি আর বার্ধক্যে যার স্মৃতি মন্থনে কেঁপে ওঠে শরীর। যৌবনে এই দৃঢ়তা স্বপ্নচারিতাই মূলতঃ মানব জীবনের প্রতিষ্ঠা ও সফলতার সিঁড়ি যদি আল্লাহ সহায় হোন।
সম্ভবত এ কারণেই যুগ-যুগান্তরের সকল বিল্পবী মহামানবেরাই তাদের দর্শনচিন্তা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন এই যুব সম্প্রদায়কে। কারণ, যৌবনদীপ্ত এই মানব কাফেলার উচ্ছল শক্তি, অঙ্গীকার, নির্ভীক পদচারনা আর সাহসী হুঙ্কারে সদা কম্পিত আলোড়িত তটস্থ থাকে তার চারপাশ। তাই কোন সমাজকে নিরুপদ্রপ, অহিংস, শান্তিস্নাত, সমৃদ্ধ ও আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমে ঢেলে সাজাতে হবে সে সমাজের যুব শক্তিকে। অঙ্গীকারে অবিচল, পদক্ষেপে সাহসী, বিশ্বসে অনড়, চিন্তায় দূরদর্শী, চেতনায় সদা উদ্যমী এই যুব সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কিংবা উপেক্ষা করে সুস্থ এবং সমৃদ্ধ সমাজ নির্মানের কথা চিন্তা করা মানেই অলসের স্বপ্নবিলাস।
দুই
আজ দেশময় বরং বিশ্বময় সে অস্থিরতা, নৈরাজ্য আর জঘণ্যতার প্রতিযোগিতা চলছে এর মূল ও মৌলিক কারণ হলো যুব শক্তির অধঃপতন। এ-ও লক্ষ্যণীয়, এই আধুনিক সময়কালের নাটের গুরু সকল নষ্ট মিডিয়ার লক্ষ্য হলো এই যুব সম্প্রদায়। তাই আধুনিক সংস্কৃতি ও ফ্যাশনের নামে রুচি, স্বভাব, চরিত্র ও আদর্শের রক্ষিত নিবাস থেকে রীতিমত তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই যুব সম্প্রদায়কে বেহায়াপনা, অসভ্যতা, পাশবিকতা আর কাম-ভোগের অন্ধপথে। পরিণামে জ্বলছে সমাজ, জ্বলছে হাজার বছরের লালিত সভ্যতা, জ্বলছে মানবতা, জ্বলছে নারী, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ। তথাকথিত প্রগতির শ্লোগানে কম্পিত এই ধরা এখন সভ্যজনদের বিচারে এক ভয়ঙ্কর হাবিয়া দোযখ। মেকি মানবতাবাদীরা ত্রাসে উৎকন্ঠিত, রক্তাক্ত আবিশ্ব মানবগোষ্ঠী, শাশ্বত মানবগোষ্ঠী।
তিন
আজকের পৃথিবীতে উ™£ান্ত, আদর্শচ্যুত, লক্ষ্যহীন কিংবা ভুল লক্ষ্যে আকন্ঠ নিমগ্ন যুব সমাজকে সঠিক পথে উঠে আসতে হলে অনুসরণ করতে হবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আলোকময় উসওয়াতুন হাসানকেই। আর সেই লক্ষ্যেই এই প্রয়াস।
চার
যুদ্ধ-বিগ্রহের জ্বলন্ত পরিবেশেই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম। কিন্তু তারপরও স্বভাবজাতভাবেই তিনি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, নির্যাতিত, নিপড়িত; শোষিত মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অসামান্য। অসহায়দের প্রতি সাহায্যদান ছিল হৃদয়ের আবেদন। সমকালীন হেজায অঞ্চলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্ব, বংশীয় মর্যাদা ছিল বর্ণনাতীত। কিন্তু তারপরও তিনি জীবিকার জন্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য করেছেন, অন্যের অধীনে রাখালীও করেছেন। কারণ, রাখালী একটি পেশা।
আর কোন পেশাই কারও জন্যই মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ববিরোধী হতে পারে না। বরং সহস্তে উপার্জিত জীবিকার প্রশংসায় তিনি এরশাদ করেছেন, “নিজের হাতে উপার্জিত খাবারই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ খাবার।” আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ.) নিজের কামাই দ্বারা আহার করতেন। অথচ মেকি প্রেস্টিজ রোগে আক্রান্ত আজকের যুবশক্তি সর্বাধিক যে কারণে অন্যায় পথে বাড়িয়ে সমাজ-সংসারকে রক্তাক্ত কলুষিত করেছে তা হলো অসীম বেকারত্ব এবং এই বেকারত্বের একটি বড় কারণ হলো, তাদের মিথ্যা ব্যক্তিত্ববোধ। তারা নিজেদের জন্য ব্যক্তিত্বের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে রেখেছে।
এবং সেই মাত্রার জন্য কিছু কাজ ও পেশাকেও চিহ্নিত করে রেখেছে। তারা মনে করে এর বাইরে অন্যকোন কোন কাজ তারা করতে পারে না। সমাজে আর তাদের মুখ রক্ষা হবে না। অতঃপর যখন তাদের হাতে নির্ধারিত কর্ম ও পেশা আরও করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন ক্ষুধা ও কামের নির্দেশে নির্বিচারে ঘটিয়ে চলে ভয়ঙ্কর যত অঘটন। আশ্চর্য, তখন কিন্তু তাদের প্রেস্টিজবোধে একবিন্দু ঝাঁকুনি লাগে না। সময় এসেছে, আজকের যুব সম্প্রদায়কে সবিশেষ মুসলিম যুবশ্রেণীকেই এই মিথ্যা প্রেস্টিজের সংকীর্ণতা থেকে প্রকৃত সভ্যতার বিশাল প্রাঙ্গনে উঠে আসার।
যে যৌবন, যুবকের যে পেশীবল ছিল সৃষ্টি ও নির্মাণের লক্ষ্যে, অনর্থক অহংকারে প্রেস্টিজ ও মেকি শ্রেণী বিভাজনের পথ পরিহার করে স্বীয় মেধা, শক্তি, চিন্তা, বিদ্যা, অভিজ্ঞতা ও সামর্থ দিয়ে স্বীয় দেহ, উম্মাহ ও সমাজকে বলিষ্ঠ, সুশীল, সমৃদ্ধ ও গতিশীল করে গড়ে তোলা এবং এটাই প্রকৃত গৌরব, মর্যাদা ও সম্মানের পথ। এ পথ যে ভাবে ব্যক্তি থেকে সমাজকে আন্তনির্ভরশীল, স্বাবলম্বী ও মর্যাদাকর তেমনি যুবসমাজকে সাহায্য করে নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা ভাবতে, সে পথে অগ্রসর হতে। তাছাড়া চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানীর মত সর্বজন ধিকৃত অন্ধকার থেকে উঠে আসার সরল পথ তো এটাই। আর চাঁদাবাজিতো ভিক্ষাবৃত্তিরই জঘণ্যতম রূপ মাত্র।
পাঁচ
চরিত্র হলো মানবতা ও পাশবিকতার ফারাক চিহ্ন। মানুষের চরিত্র থাকে, পশুর কোন চরিত্র থাকে না। এ-ও সত্য, এই চরিত্র নামক শ্রেষ্ঠতম সম্পদের প্রধান শত্রæ হলো যৌনক্ষুধা ও কামতারল্য। আর এ থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র সুশীল-সভ্য মাধ্যম হলো বিবাহ। অধিকন্তু, এই বিবাহের মাধ্যমেই একজন সুপুরুষ তার পৌরষের পূর্ণমাত্রা জয় করতে সক্ষম হয়। আর এ কারণেই সুস্থ, সুন্দর, সাবলীল এই পথ পরিহার করলে জীবন যেমন হয়ে পড়ে চ‚ড়ান্ত অস্থির, তেমনি তখন চরিত্র বলতেও কিছু থাকে না মানুষের। তখন মানুষের সমাজ আর জঙ্গলের বন্যদের জীবনাচারের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না।
বরং মানুষের সমাজ হয় পশুর সমাজ। যার কুৎসিত চিত্র বর্তমানে প্রতিটি পদে পদে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এখন বিয়েতে ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দিয়ে অবিবাহিত লিখতে হবে। বিয়ের কাবিননামা থেকে ‘কুমারী’ শব্দ বাদ দিয়ে অবিবাহিত যোগ হচ্ছে। বিষয়টি খুব পরিষ্কার যে, ‘কুমারী’ শব্দ প্রয়োগের বেলায় মেয়েদের মান-ইজ্জত ফুটে উঠে। কিন্তু যখন অবিবাহিত প্রয়োগ করা হবে তখন মেয়েদের সতীত্বকে খুবই হালকা করে দেখা হচ্ছে বলে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। আসলে এরা চাচ্ছে বিয়ের আগে মেয়েদের সতীত্ব হারানোর গল্পটাকে খুবই স্বাভাবিক চোখে দেখা। যা একটা জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে।
যে জাতির “মা” সভ্য হয় না, সে জাতি সভ্য সমাজ উপহার দিতে পারে না। সভ্যতার এ পথে আরেকটি অন্যতম বাধা হলো সেই মিথ্যা প্রেস্টিজ। যেখানে বিয়ে ছিল মানবিক চরিত্র রক্ষার একটি অনিবার্য প্রয়োজন। যে প্রয়োজন পূরণের পথ-নির্দেশ করতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে বিবাহে কম খরচ সে বিবাহই অধিক বরকতপূর্ণ।” অথচ আজ আমাদের সমাজে কুরবাণীর গরুর হাটের মত বড় মোটা অংকের দাম হেঁকে অপরদিকে মেয়ের বাবার উপর দীর্ঘ ফিরিস্তির যৌতুকের ট্যাক্স বসিয়ে বিবাহের মত একটি অতি প্রয়োজণীয় চাহিদা ও কর্তব্য এমন কঠিন করে ফেলা হয়েছে যে, যুবক-যুবতী উভয় শ্রেণীই অনেক ক্ষেত্রে বিপথগামী হতে বাধ্য হয়।
অবস্থার এই জঘণ্যতা থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক সুস্থতা ও সন্তানের সবল সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে যথাযথ গুরুত্বসহ এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদেরকেও।
ছয়
বর্তমানকালের যুবসমাজের পতন, চারিত্রিক বিনাশ ও পচন যে এইডসের মত জঘণ্যরূপ পরিগ্রহ করেছে এর মূল কারণ হলো প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত যুবকের জীবন-চরিত্র রক্ষার পথ পরিহার করে অন্ধপথে যাত্রা।
সাত
সবশেষে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, চরিত্রের দৃঢ়তা, অসামান্য কর্ম-পরায়ণতা, সমাজ ও মানুষের প্রতি অসাধারণ দরদ, লেনদেনের স্বচ্ছতা ও সর্বজনবিদিত সমাজহিতৈষী চিন্তা ও অবদানের অতীত ঐতিহ্যের ভিত্তিতেই যুদ্ধ-প্রতিজ্ঞায় প্রত্যয়ী লড়াইপ্রিয় আরব সম্প্রদায়গুলো একবাক্যে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিচারক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই তারা বিশ্বাস করতো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সংঘাতপূর্ণ এই রক্তগ্রন্থি উম্মোচনের নিশ্চয়ই কোন সুন্দর সুন্দর যুক্তিপূর্ণ উত্তম সমাধান পেশ করবেন।
কারণ, নেতৃত্বের ও বিচারকের আসন অলংকৃত করার মত সকল গুণই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের প্রতি বুকভরা দরদ, কথার ও অঙ্গীকারের দৃঢ়তা, সততা, সাধুতা, স্বভাব ও চরিত্রের পবিত্রতা, মানবমন্ডলীর প্রতি ভরাট প্রেম, হিত কামনা, তাদের প্রতি কল্যাণকর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের আলোকিত গুণাবলী তাঁকে এই আসনের জন্যে উপযুক্ত করে রেখেছিল সমকালীন সকলের দৃষ্টিতেই।
লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
-কেএল