মুহাম্মদ নাজমুচ্ছাকিব।।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ এক সেকেন্ড ও বাচতে পারে না। তাই বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টেটল বলেছেন, যে সমাজে বাস করে না, সে পশু না হয় ইশ্বর। এখন এই সমাজকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করার জন্য যুবকদের সামনের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য আমাদের যুব সমাজ পর্ণোগ্রাফি নামক এক মহা-ভাইরাস এ আক্রান্ত। যা আমাদের যুব সমাজকে তিলে তিলে নষ্ট করে দিচ্ছে।
যুবক হারাচ্ছে তার উদ্দিপনা, হারাচ্ছে তার যৌন উদ্দিপনা। যার ফলে আমাদের সমাজে নানান অসুবিধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। এই সমস্যার মুল কারন পর্ণোগ্রাফি। আমাদের যুব সমাজ পর্ণোগ্রাফি মাত্রাতিরিক্তভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে, যার ফলে আমাদের যুব সমাজের ভবিষৎ খুব বেশি ভালো নয়। আমাদের যুব সমাজকে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বের করে আনতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে পর্ণোগ্রাফি এর ক্ষতির দিক ও এ থেকে বের হয়ে আসার উপায় সম্পর্কে জানব।
পর্ণোগ্রাফি দেখতে শুরু করার সময়, কোনও ব্যক্তি দৃশ্যে সন্তুষ্ট হতে পারে। তবে তারা এতে আসক্ত হওয়ার সাথে সাথে ডোপামিন এর চাহিদা পূরণের জন্য মদের প্রয়োজন হয়। এ কারণেই বেশির ভাগ অশ্লীল আসক্তরা অপ্রাকৃত যৌন ক্রিয়াকলাপ, ধর্ষণ ও কালিয়াতির দিকে ঝুকে। বেশিরভাগ অশ্লীল ছবিতে মহিলাদের দেখতে ভালোবাসে। যে সকল পুরুষেরা প্রায়সই পর্নো দেখে, তারা মহিলাদের দিকে বেশি ঝুকে তাদের প্রতি নানান অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করে থাকে এবং এর ফলে অনেক পুরুষ অকালেই তার পৌরষত্ব হারাচ্ছে।
পর্নো আসল নয়। যখন ভালোবাসা আসে তখন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন হয়। গবেষণা অনুযায়ি দেখাগেছে, যারা পর্নো দেখেন তারা নিজের প্রেয়সীর সাথে প্রেমে নিজেকে অন্য জগত এর ভাবেন বিশেষ করে যারা মিলনে অংশ নেন না। MSNBC পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতি ৫ জন পুরুষ (পর্নো আক্রান্ত) এর ১ জন তাদের স্ত্রী ছেলে মেয়েদের দেওয়া সময় কেটে নিয়ে পর্নো দেখে পার করেন। নিজের ভিতরে একটি কল্পনার কারণে মানুষ তার বাস্তব জীবনে পরিপুর্ণতায় একটা অভাব দেখা দিতে পারে।
একটি ৪৫ মিনিট এর পর্নো ভিডিও তৈরি করতে প্রায় তিন দিন সময় লাগে। এবং এটা এডিট করে দর্শকের জন্য ছাড়বে বিরতিহীন ভাবে। পর্নো এর এই মিলন বাস্তব জীবনে অসম্ভব।
দুঃখের বিষয়, অল্প বয়স্ক যুবক-যুবতি বেশি পর্নে আসক্ত হয় এবং এটা তাদের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। যখন তারা যৌন সামগ্রী দেখেন তখন তারা বিশ্বাস করেন যে যৌন সম্পর্কের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত। তারা পরবর্তী জীবনে যৌনতার অদ্ভুত প্রত্যাশা নিয়ে থাকেন, যা তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রূপে হস্তক্ষেপ করে। যৌন সামগ্রীর এক্সপোজারের ফলে শিশুরা যৌনতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর যখন যৌনতা পর্নোগ্রাফির সাথে মিলে না তখন তারা মানসিক ভাবে সন্তুষ্ট হতে পারে না। পর্নোর মতো সুখ পেতে বিবাহের আগেই একের পর এক সম্পর্ক ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলতে থাকে। ৩০ বছর ধরে পর্নো আসক্তদের সাথে কাজ করা মনোবিজ্ঞানী ‘গ্যারি ব্রুকস’ একবার বলেছিলেন, “যত বেশি পর্ণোগ্রাফি ব্যাবহার করা হয় মানুষ ততো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে”।
এখন আমরা পর্ন কেন ছাড়তে হবে এ বিষয়ে আরো কিছু কারণ আলোচনা করব:
পর্নের সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার হচ্ছে এটা মানুষকে সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিতে ভোগায়। এসব পর্নে যা দেখানো হয় সেগুলা বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। বেশি পর্ণ দেখার ফলে বাস্তব মিলন তখন মানুষের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় না। দেখা দেয় অপ্রাপ্তির বিষণ্ণতা, মনোমালিন্য ও সম্পর্কের টানাপোড়ন। পর্নে যা দেখানো হয় সবটুকুই অতিরঞ্জিত অভিনয় যার সাথে বাস্তবতার কোন, মিল নেই।
বাইরে থেকে দেখলে কোকেন আর পর্ন একই জিনিস নয় কিন্তু এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাদক্ক সেবনের ফলে যে হরমোন নিঃসৃত হয়ে আনন্দের অন্যভূতি দেয়, পর্নের ফলে সেই একই হরমোন নিঃসৃত হয়। যার ফলে মানুষ ধীরে-ধীরে মাদক এর দিকে ঝুকে পড়বে। পর্ন আসক্তি বেশ ভয়ানক। নিজেকে টিকে রাখতে এ আসক্তি ক্রমে ক্রমে ডাল-পালা বিছিয়েই চলেছে। প্রতিবার পর্ন দেখে আগের থেকে বেশি আনন্দ পাওয়ার জন্য হার্ডকোর পর্ন দেখার প্রয়োজন পড়ে। ফলে তার চেতনা ও বোধ শক্তি দিন দিন ভোতা হতে থাকে। এক পর্যায়ে পর্ন দর্শকরা এমন সব দৃশ্য দেখে আনন্দ পায় যা আগে তাদের কাছে জঘন্য লাগত। কড়া ধাচের পর্ন গুলা দেখতে দেখতে সে খুব খারাপ কাজকেও স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে। পর্ন মানুষের আদর্শ নষ্ট করে বিবেককে ধ্বংশ করে।
পর্নে মেকাপ, সার্জারি, এডিটিং, অভিনয়- এসব ব্যবহার করে মানবদেহ ও যৌনতা নিয়ে অনেক ভুল ও অবাস্তব ধারণা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দর্শক নিজের অজান্তেই যা দেখছে তার সাথে নিজেকে তুলনা করতে থাকে। নিজের শরীর ও জীবন নিয়ে হতাশা, হীনমন্যতায় ভোগে। পর্ন আসক্তি থেকে মুক্তি আপনার সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেবে, আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। পর্ন যৌন অক্ষমতা ও যৌন অতৃপ্তির মূল কারণ।
পর্ন দর্শকদের জরিপ নিয়ে জানা গিয়েছে, পর্ন দেখতে দেখতে একসময় ব্যক্তি তার স্বাভাবিক যৌনতাকেই ধ্বংস করে ফেলে । জানা গেছে, নিয়মিত পর্ন দেখার ফলে মস্তিষ্কে এমন পরিবর্তন আসে যার ফলে বাস্তবে সহবাস করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায়। পর্ন আসক্তি একজন পুরুষের উত্তেজিত হবার ক্ষমতাকেই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু এটা তারা টের পায় অনেক দেরিতে। এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো পর্ন ও মাস্টারবেশনের মতো বাজে অভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়া। স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসা।
সব পর্ন একরকম না হলেও বেশিরভাগ পর্নেই নারীদের মৌখিক ও শারীরিকভাবে অপমান করা হয়, গালাগালি করা হয়। আর দর্শক এর দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত হয়। লাঞ্ছিত না করা হলেও পর্নগুলোতে পুরুষকে দেখানো হয় শক্তিশালী রুপে, শিকারি হিসেবে- আর নারীকে দেখানো হয় দুর্বল, ভোগের বস্তু, শিকার হিসেবে।
কাউকে লাঞ্ছিত বা আক্রমণ করা হলে সেও পাল্টা আক্রমণ করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ৯৫% পর্নে নারীরা আক্রমণের বিরোধিতা করা তো দূরে থাক, উল্টো ভুক্তভোগী নারীকে এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অথবা এসব উপভোগ করে দেখানো হয়। ফলে দর্শকদের মনে এ বিশ্বাস জন্মে যে, জবরদস্তি বা আক্রমণাত্মক আচরণ মেয়েরা পছন্দ করে, ছেলেরা চাইলেই মেয়েদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। ফলস্বরুপ এসব দর্শকরা নিজেদের স্ত্রীদের কষ্ট দিয়ে থাকে।
আর এভাবে এদের সম্পর্কগুলোও বিষাদময় হয়ে উঠে। সমাজে বাড়তে থাকে ধর্ষণ ও খুনের পরিমাণ। আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন যে পর্ন আপনার অজস্র সময় নষ্ট করেছে। পর্ন দর্শক প্রতিদিন কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা সময় এসব ক্ষতিকর দৃশ্য দেখে নষ্ট করে। যারা ঘন ঘন পর্ন দেখে তারা জানে সময়ের সাথে সাথে তারা আরও কড়া ধাঁচের পর্ন আরও বেশি সময় ধরে দেখছে। ভেবে দেখুন, যদি আপনি দিনে মাত্র ১০ মিনিট সময় পর্ন দেখেন, তাহলে বছরে ৬০ ঘণ্টা সময় আপনি পর্ন দেখে নষ্ট করলেন। এই লম্বা সময়টা আপনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা ভালো কাজে লাগাতে পারতেন। সময় অনেক মূল্যবান।
সময়কে কাজে লাগান। ভালো কাজ করুন। সময়কে এমন স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে তুলুন যেগুলো দীর্ঘস্থায়ী, এমন দৃশ্য দিয়ে নয় যেগুলো এক ক্লিকেই হারিয়ে যায়। পর্ন বৈশ্বিকভাবে ৯৭ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের একটি ইন্ডাস্ট্রি যার ১২ বিলিয়ন ডলার আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আপনি পর্নের জন্য কত টাকা খরচ করেছেন? যদি খরচ নাও করে থাকেন, তাহলে এভাবে চিন্তা করুন- আপনি যে সময়গুলো পর্ন দেখে নষ্ট করেছেন সেগুলো দুইভাবে কাজে লাগাতে পারতেন। যেমন, ১) অর্থ উপার্জনে অথবা ২) কর্মক্ষেত্রে আরও ভালো করে সেখানে এতদিনে আরও বেশি উপার্জন করে। কথায় বলে, ‘Time is money’, সময়ই অর্থ। পর্ন দেখে সেই মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে আপনি নিজেকে কতটা নিষ্কর্মা হিসেবে গড়ে তুলছেন সেকথা ভেবে দেখেছেন?
পর্ণ আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকে নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। প্রথমেই আপনার সংগ্রহে থাকা পর্ণ ভিডিওগুলো ডিলিট করুন। কারণ এ ব্যাপারে আসক্তদের সংগ্রহশালা বেশ উন্নত এবং পরিবর্ধনশীল!
নিয়মিত যেসব সাইটে ভিজিট করে আপনি আসক্ত হয়েছেন সেসব সাইট ব্লক করুন।
আপনার পরিবারের সদস্যদের পর্ণ জগতের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে রাখতে হলে Parental Controls ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে Settings > Control Panel > Family Safety > Manage settings on the family safety websites। তারপর প্রয়োজন মতো বাকি কাজ নিজের মতো করে করবেন। কিংবা আপনি চাইলে বাচ্চার কম্পিউটার টেবিল বাসার এমন জায়গায় সেট করতে পারেন যেখান থেকে তার মনিটর দেখা যায়। এতে আপনার সন্তান কিছুটা হলেও এর থেকে রেহাই পাবে।
অনেক আসক্তদের কিছুক্ষণ পর পর পর্ণ দেখতে হয় কিংবা কাজের মাঝামাঝি সময়ে পর্ণ দেখতে হয়। আপনি যদি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হন তবে পর্ণ ছাড়া আপনার পছন্দের কোনো সখ বা বিনোদনের উৎস খুঁজে বের করুন। কাজের মাঝে মাঝে পর্ণ না দেখে সেই পছন্দের কাজ করুন কিংবা গান শুনতে পারেন অথবা ৫ মিনিট হেঁটে আসতে পারেন বাহিরের মুক্ত বাতাসে। এতে আপনার মস্তিষ্ক এবং দেহ থাকবে সতেজ এবং ফুরফুরে।
নিয়মিত পর্ণ দেখে যাদের অভ্যাস কিংবা ১০-১৫ বছরের পুরনো অভ্যাস পর্ণ দেখা, তাদের জন্য আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। এখন থেকে একটি রুটিন তৈরি করুন, চাইলে গুগল ক্যালেন্ডারের সাহায্য নিতে পারেন। আজকের তারিখ থেকে ১ দিন পর পর ১৫-২০ মিনিট পর্ণ দেখুন। এভাবে ৭ দিন চলবে। তারপর ধীরে ধীরে ২ দিন পর পর দেখবেন এবং সেটাও ৭ দিন নিয়মিত। অতঃপর ৪, ৪, ৬, ৬ দিন পর পর দেখুন। ৬-৮ মাস পর নিজের দিকে ফিরে তাকাবেন দেখবেন কত্ত বদলে গেছেন আপনি। চাইলে এই অভ্যাস স্ত্রীর কড়া শাসনেও করতে পারেন কারণ আপনি একজন আসক্ত।
পর্ণের কালোজাদুর মোহ থেকে বেরিয়ে এসে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একজন সুন্দর মনের মানুষ উপহার দিন। পাঠকের মনে হতে পারে এই পোস্ট শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য লেখা উচিত কিংবা রোয়ারের মতো প্ল্যাটফর্মে যেখানে কম বয়স্ক পাঠকরাও রয়েছেন সেখানে এমন পোস্ট দেয়া উচিত নয়। তাদের জন্য বলছি, পর্ণের কালোজাদুর মোহে আপনার শিশু সন্তানও অন্ধকারের পথে পা বাড়াতে পারে।
যে পর্ণ দেখে, তার এই লেখা বোঝারও বয়স হয়েছে। আমাদের দেশে যদিও যৌনতা এখনও ট্যাবু। কিন্তু এই ট্যাবু ভেঙ্গে বাবা- মা, শিক্ষক এবং বয়স্কদের উচিত শিশু কিশোরদের সঠিক তথ্য জানানো। আশাকরি পারিবারিক সচেতনার মাধ্যমে আমরা পর্নগ্রাফি থেকে বের হতে পারব।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
-এটি