শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
৫ বছর আগের এই দিনে কী হয়েছিল মাওলানা আনসারীর জানাজায়? হজযাত্রীর জন্য চালু হচ্ছে হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, থাকবে অ্যাপ কুয়েট শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন- ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ  আইন করে ভারতে মুসলিমদের অধিকার হরণ করা যাবে না: জমিয়ত করাচি-চট্টগ্রাম রুটে নৌযান চলাচলকে স্বাগত জানিয়েছে দুই পক্ষ: পাকিস্তান ২৬ এপ্রিল জমিয়তের কাউন্সিল, প্রাধান্য পেতে পারে তরুণ নেতৃত্ব কওমি সনদ বাস্তবায়ন  করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব: ধর্ম উপদেষ্টা কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতেই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব: জামায়াত সেক্রেটারি গাজায় গণহত্যা ও ভারতে ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে জমিয়তের বিক্ষোভ ইয়েমেনে মার্কিন হামলায় নিহত অন্তত ৩৮

শিকলবাঁধা সেই বুড়ো: পাল্টে দিলেন ইতিহাসের মোড়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শায়েখ মাহমুদুল হাসান।।

আব্বাসী শাসনামল তখন। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশ। সারাদেশে জ্বলে ওঠে আগুন। ‘খলকে কুরআন’-এর মাসআলা নিয়ে- কুরআন কী মাখলুক, না গায়রে মাখলুক? সৃষ্টি, না স্রষ্টা? মু’তাযিলারা বলে কুরআন মাখলুক: সৃষ্টি। কিন্তু হক্কানী ওলামায়ে কেরাম বলেন, কুরআন গায়রে মাখলুক; স্রষ্টার কালামও স্রষ্টা। ফলে হক্কানী ওলামায়ে কেরামের ওপর চলে দমন-পীড়ন সরকারের তরফ থেকে। যেহেতু মু’তাযিলারা ছিল সরকারী ছত্রছায়ায়। সরকারের অনুগত। সরকারও তাদের কথায় হক্কানী ওলামায়ে কেরামের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়।

এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন খলীফা মু‘তাসিম বিল্লাহ এবং ওয়াসিক বিল্লাহ। তারা মু‘তাযিলাদের পক্ষ নিয়ে আহলে হককে জুলুমের নিশানা বানিয়েছিলেন। দরবারে মু‘তাযিলা নেতা ছিলেন আহমাদ বিন আবু দাঊদ। এ লোক সম্ভাব্য সব উপায়ে খলীফার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সাজার ব্যবস্থা করতেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মতো হাদীস ও ফিকহের অনন্য নক্ষত্রকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। শুধু এজন্য যে তিনি সরকারী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না।

জগতব্যাপী চলতে থাকা ফেতনার এ অশান্ত আগুন আল্লাহ এক বয়োবৃদ্ধ আলেমের মাধ্যমে নিভিয়েছেন। যিনি তাঁর ঈমানী দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, পর্বতসম অবিচলতা, বিশ্বাসের দৈবশক্তি আর একনিষ্ঠ আন্তরিকতার মাধ্যমে দরবারের চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন। সেটা ঘটেছিল আব্বাসী শাসনামলের নবম খলীফা আল ওয়াসিক বিল্লাহর যুগে। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ওয়াসিকের পুত্র চতুর্দশ খলীফা আল মুহতাদী বিল্লাহ। তিনি তৎকালীন আলেম শায়খ সালেহ বিন হাশেমীকে তা শুনিয়েছিলেন।

শায়খ সালেহ বিন আলী হাশেমী বলেন, একদিন আমি খলীফা মুহতাদীর দরবারে গেলাম। তিনি দুঃখী মানুষের করুণ কাহিনী শোনার জন্য; দুঃখের কথা, কষ্টের কথা শোনার জন্য, আসর বসিয়েছিলেন। আমি দেখলাম, যে কোনো সাধারণ ব্যক্তি বিনা বাধায় খলীফার কাছে ঢুকতে পারছে। আর যে সব বিপদগ্রস্ত নিজে আসতে পারেনি, তাদের পত্র খলীফার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। খলীফা তাদের অভাব-অভিযোগ দূর করার জন্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এ দৃশ্য আমার খুব পছন্দ হলো। যখন তিনি কোনো মানুষের কথা শুনতেন বা কারো পত্র পড়তেন তখন আমি অপলক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতাম। তিনি আমার দিকে তাকালে আমি চোখ নামিয়ে ফেলতাম। খলীফা আমার এ অবস্থা লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন-সালেহ! আমার মনে হয়, আপনার মনে কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। আপনি তা বলতে চাচ্ছেন।
-আমি ইতিবাচক জবাব দিলাম। তিনি দরবার শেষ করে নামাযের মুসল্লায় পৌঁছলেন। আমাকে বললেন: -আাপনার মনের কথা আপনি নিজেই বলবেন, না আমি বলব?
-আপনিই বলুন।
-আমার মনে হয়, এ আসর আপনার পছন্দ হয়েছে।
-জি হ্যাঁ। আমাদের খলীফা কতই না ভালো খলীফা! তবে তিনি যদি তার বাবার (ওয়াসিক বিল্লাহ) মতো ‘কুরআন সৃষ্ট’ মতবাদপন্থী না হতেন।
-এক সময় আমি উক্ত মতবাদপন্থীই ছিলাম। কিন্তু একদিন এক ঘটনায় আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল।
-কী সেই ঘটনা? জানতে পারি?

-বলছি, শুনুন। আহমাদ বিন আবু দাঊদ ছিল মু‘তাযিলা গোষ্ঠীর বড় পন্ডিত। সে ছিল খলীফা ওয়াসিকের ডানহাত। লোকটি সিরিয়া অঞ্চলের ‘উজনা’ নগরী থেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের এক বয়োবৃদ্ধ আলেমকে শুধু এ অপরাধে গ্রেফতার করে আনালো যে, তিনি ‘কুরআন মাখলুক’ আকীদায় বিশ্বাসী নন। বুযুর্গ শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ওয়াসিকের দরবারে পৌঁছলেন। লোকটি রাশভারী। তাঁর চেহারা গম্ভীর এবং আশ্চর্য রকম শান্ত। চমৎকার সৌম্য গঠন। তিনি বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে খলীফাকে সালাম করলেন। সংক্ষিপ্ত কোনো দোয়াও পড়লেন। আমি দেখতে পেলাম, বুযুর্গকে দেখে খলীফা ওয়াসিক লজ্জা পেয়ে গেলেন। তথাপি তিনি বললেন :
-শায়খ! আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন আবু দাউদের প্রশ্নের জবাব দিন।
-আমীরুল মুমিনীন! বিতর্কে আহমাদ বিন আবু দাঊদ বড়ই দুর্বল ও তুচ্ছ প্রমাণিত হবে।
আমি দেখলাম একথা শুনে ওয়াসিকের চেহারা মুহূর্তেই ক্রোধে রক্তবর্ণ ধারণ করল। তিনি বললেন: -কি বললেন? বিতর্কে আবু আব্দুল্লাহ দুর্বল ও তুচ্ছ প্রমাণিত হবে?

-আমীরুল মুমিনীন! উত্তেজিত হবেন না। অনুমতি দিলে আপনার সামনেই আহমাদ বিন আবু দাঊদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।
-অনুমতি আছে।

-আহমাদ! বলো, তোমরা কোন আকীদার প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছ?
বুযুর্গ আহমাদকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-কুরআন যে ‘মাখলুক’ এ আকীদার প্রতি।
-এ বিশ্বাস কি দীনের এমন অংশ, যা ছাড়া দীন অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়?
-হ্যাঁ।
-রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এ আকীদার প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছিলেন?
-না।
-আচ্ছা, তবে কি তিনি এ মাসআলা জানতেন না?
-অবশ্যই জানতেন।

-তাহলে তোমরা কেন মানুষকে এমন আকীদার প্রতি দাওয়াত দিচ্ছ যার প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত দেননি?
এ প্রশ্নের উত্তরে আহমাদ নিশ্চুপ থাকল। বুযুর্গ এবার ওয়সিককে উদ্দেশ্য করে বললেন:-আমীরুল মুমিনীন! এটা একটা পয়েন্ট। তারপর আবার আহমাদের দিকে ফিরে বললেন: -আচ্ছা আহমাদ, আমাকে কয়েকটি কথা বলো। কুরআন কারীমে তো বলা হয়েছে-
﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾
আজ তোমাদের দীন তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম। [সূরা মায়েদা: ৩]
অথচ তোমরা বলছ, যতক্ষণ না কুরআন সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করবে ততক্ষণ পর্যন্ত দীন পূর্ণ হবে না। এখন তুমিই বলো, তোমাদের সত্য মানবো, না আল্লাহকে?

আহমাদের কাছে এ প্রশ্নেরও উত্তর ছিল না। বুযুর্গ আবার বললেন: -আমীরুল মুমিনীন! এটি দ্বিতীয় পয়েন্ট। কিছুক্ষণ পর তিনি আহমাদকে উদ্দেশ্য করে আবার বললেন: -আহমাদ! আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন,
﴿يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ﴾
হে রাসূল! যে বিধান আপনার রাব্বের পক্ষ থেকে আপনার কাছে অবতীর্ণ করা হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা না করেন, তাহলে আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না। [সূরা মায়েদা : ৬৭]

আমার প্রশ্ন হলো, যে-আকীদার প্রতি মানুষকে তোমরা দাওয়াত দিচ্ছ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো তা উম্মতের কাছে পৌঁছাননি, একটু আগেই তুমি নিজেই তা স্বীকার করেছ। তার মানে কী দাঁড়ালো?

আহমাদ আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। বুযুর্গ এবার ওয়াসিকের দিকে ফিরে বললেন: -আমীরুল মুমিনীন! এটা আমার তৃতীয় পয়েন্ট। কিছুক্ষণ পর বুযুর্গ আহমাদকে বললেন, -আহমদ! হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কুরআন মাখলুক বলে জানতেন কিন্তু তারপরও মানুষকে বলেননি। তার মানে কি তাঁর জন্য এ বিষয়টি অগ্রাহ্য করা জায়েয ছিল? - হ্যাঁ জায়েয ছিল। তাহলে কি আবু বকর রা.-এর জন্যও জায়েজ ছিল? উমর, উসমান, আলী রা.-এর জন্যও? - হ্যাঁ।

এবার বুযুর্গ খলীফা ওয়াসিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,
-আমীরুল মুমিনীন! যে সুযোগ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছিল, তাঁর সাহাবাদের ছিল, তার মানে কি এই নয় যে, আল্লাহ আমাদের সুযোগটা থেকে বঞ্চিত করলেন?

-তাই তো, ঠিকই বলছেন। কোনো সুযোগ যদি আল্লাহর নবী ও তাঁর সাহাবাদের থেকে থাকে আর আমাদের না থাকে, তাহলে তো আমরা বঞ্চিত হলাম।

ওয়াসিক এ কথা বলে বুযুর্গের শিকল খুলে দেয়ার হুকুম দিলেন। রাজকর্মচারীরা শিকল খুলে নিয়ে যেতে চাইলে বুযুর্গ তা ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলেন। কর্মচারীদের হাত থেকে কেড়ে নিতে লাগলেন। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন: - কি ব্যাপার শায়খ! শিকল ছাড়ছেন না যে?
-আমি নিয়ত করেছি এ শিকল হেফাজত করে রাখব। মৃত্যুর সময় অসিয়ত করে যাব, যেন তা আমার সঙ্গে দেয়া হয়। তারপর আল্লাহকে বলব, হে আল্লাহ! তোমার বান্দাদের জিজ্ঞেস কর, কেন তারা আমাকে শিকলে বেঁধে আমার পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল?
ওয়াসিক কেঁদে ফেললেন। বুযর্গও অশ্রুসিক্ত হলো। দরবারে উপস্থিত অন্যান্যদের চক্ষুও ভিজে উঠল।

খলীফা কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,-শায়খ! আমাকে ক্ষমা করুন।

-আমি আপনাকে তখনই ক্ষমা করে দিয়েছি, যখন আমি ঘর থেকে বের হয়েছি। কারণ আমার অন্তরে সরদারে দো‘আলমের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আছে। আর তাঁর সঙ্গে আপনার আত্মীয়তার বন্ধন আছে।

এ কথা শুনে ওয়াসিকের চেহারা আনন্দে ঝলমল করে উঠল। তিনি বললেন:-শায়খ, আপনি আমার এখানে থাকুন। যেন আপনার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে আমরা ধন্য হতে পারি।

-সীমান্ত অঞ্চলে থাকাই আমার জন্য ভালো। আমি অশীতিপর বৃদ্ধ। তাছাড়া আমার অনেক অনেক সমস্যা আছে।
-তাহলে আপনার যা প্রয়োজন হয় চেয়ে নিবেন কিন্তু!-আমীরুল মুমিনীন! আমাকে সেখানে চলে যাবার অনুমতি দিন যেখান থেকে জালিম (আহমদ বিন আবু দাউদ) আমাকে বের করে এনেছে।

ওয়াসিক বুযুর্গকে যেতে অনুমতি দিলেন। তাঁকে কিছু উপহার দিতে চাইলেন। কিন্তু বুযর্গ তা গ্রহণ করতে সম্মত হলেন না।
খলীফা আল ওয়াসিক বিল্লাহ এ ঘটনা শুনিয়ে বললেন: -তখন থেকেই আমি কুরআন মাখলুক তথা সৃষ্ট বস্তু হওয়ার বিশ্বাস ত্যাগ করেছি। আমার ধারণা আব্বাজান খলীফা আল ওয়াসিক বিল্লাহও এ ভ্রান্ত বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছিলেন। [আল্লামা শাতিবী রহ. প্রণীত আল ই‘তিসাম : ১/৩২৪-২৭]

লেখক: বৃটেনের বাংলাদেশী ইসলামী স্কলার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

-এটি


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ