ইশতিয়াক মু. আল-আমিন।।
১৪ ডিসেম্বর, সকাল ৯টা ২০মিনিটে জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমে জানাযা হয়ে গেল হেফাজতে ইসলামে মহাসচিব ও বারিধারা মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা নূর হোসেন কাসেমী রহ. এর।
গত ১ ডিসেম্বর শ্বাসকষ্ট হওয়ায় বর্ষীয়ান এ আলেমকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। রবিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্য হয়। তার মৃত্যুতে এদেশের ইসলামী অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। গত একযুগে বাইতুল মোকারমের খতিব আল্লামা ওবায়দুল হক থেকে শুরু করে প্রায় শ’খানেক প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ইনতিকাল করেন। তাদের ইনতেকালে ইসলাম ও মুসলমানরা অভিভাবক শূণ্য হতে থাকে। ওলামায়ে কেরাম হলো দ্বীনের ধারক বাহক। তাদের ইনতিকালে দেশ ও জাতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসুল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন হেদায়েতের বার্তাবাহক হিসেবে। সে ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ হেদায়েতের মশাল নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। তার ওফাতের মাধ্যমে নবুওতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। দুনিয়াতে আর কোনো নবী-রাসুল আসবেন না। তবে নবীজির রেখে যাওয়া সেই ‘নবুওতি দায়িত্ব’ পালন করবেন আলেম-ওলামাগণ। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ দিনার ও দেরহামের উত্তরাধিকারী বানান না।তারা ইলম ও জ্ঞানের উত্তরাধিকারী বানান।’ (আবু দাউদ: ৩৬৪১)
যাদের নবুওতের ইলম দেওয়া হয় তাদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেন।’ (সুরা মুজাদালা : ১১) আলেমরাই হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষ। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে তা শিখায়।’ (তিরমিজি : ২৯০৭)
ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে হেদায়েতের বাতিস্বরূপ। এই হেদায়েতের বাতি যে দিন বন্ধ হয়ে যাবে, সে দিন পৃথিবী অজ্ঞতার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওলামাদের দৃষ্টান্ত ওইসব তারকার মতো যাদের দ্বারা স্থলে ও জলের অন্ধকারে পথের দিশা পাওয়া যায়। আর যখন তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে যায় তখন পথচারীর পথ হারাবার সম্ভবনা থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/১৫৭)। অর্থাৎ ওলামায়ে কেরাম পৃথিবীতে না থাকলে মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। সুতরাং আলেমরা হচ্ছেন উম্মতের হেদায়েতের আলোকবর্তিকা।
একজন আলেমের মৃত্যু উম্মতের জন্য ধ্বংসের কারণ। কেননা একজন আলেমের মৃত্যুতে উম্মতের জন্য যতোটা দ্বীনি ব্যাপারে ক্ষতি হয় একটি গোত্রের সব মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও সেই ক্ষতি হয় না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আলেমদের মৃত্যু এমন মুসিবত যার প্রতিকার নেই এবং এমন ক্ষতি যা পূরণ হয় না। আর আলেম এমন এক তারকা যে (তার মৃত্যুর কারণে যেন পৃথিবী) আলোহীন হয়ে যায়। একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা একটি গোত্রের মৃত্যু অতি নগন্য।’ (বায়হাকি : ২/২৬৪)
সুতরাং আলেমরা দুনিয়াতে না থাকলে ইলমও দুনিয়াতে থাকবে না। কেননা আলেমদের দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া থেকে ইলেম উঠিয়ে নেন। আর ইলেম যদি দুনিয়াতে না থাকে তাহলে মানুষ হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোমরাহের দিকে ধাবিত হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা (শেষ জামানায়) ইলেমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন না যে, লোকদের অন্তর থেকে সম্পূর্ণ বের করে নেবেন বরং তিনি ইলমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন যে, এক এক করে ওলামায়ে কেরামদের উঠিয়ে নেবেন। আর যখন কোনো আলেম দুনিয়াতে অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা ওলামাদের পরিবর্তে অজ্ঞ ও মূর্খ ব্যক্তিদের নেতা বানিয়ে নেবে।’ (বুখারি : ১০০)
বর্তমানে না জানার কারণে আলেমদের অনেক সময় অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়। অথচ আলেমদের সম্মান আল্লাহর কাছে এত বেশি, আসমান ও দুনিয়ার সব মাখলুক আলেমদের জন্য দোয়া-মাগফেরাত কামনা করতে থাকে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আলেমদের ওপর স্বয়ং আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ এবং আসমান ও জমিনের সব মাখলুক এমনকি পিঁপড়া আপন আপন গর্তে এবং মাছ পানির ভেতর আপন আপন পদ্ধতিতে রহমতের জন্য সর্বদা দোয়া করতে থাকে।’ (তিরমিজি : ২৬৮৫)
খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের প্রতিশযথা একাধিক আলেম ইনতেকাল করেছেন যা জাতির জাতির জন্য দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। তাদের স্থান পূরণ করার মতো যোগ্য আলেম তৈরি হতে অনেক সময় দরকার। শুধু ২০২০ সালেই আমরা হেফাজাতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শীফ সহ প্রায় অর্ধ ডজন প্রখ্যাত আলেমদের হারিয়েছি। যাদের মধ্যে রয়েছেন- আল্লামা তাফাজ্জল হক হবিগিঞ্জি, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জিরি মাদরাসার মহাপরিচালক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা শাহ মুহাম্মদ তৈয়ব দা. বা., বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’র (বেফাক) সহ-সভাপতি আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ, চট্টগ্রাম নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা ইদ্রিস সাহেব,আল্লামা জুনায়েদ আনসারী, আল্লামা গোলাম সরোয়ার সাঈদী সহ অনেককে।
এছাড়াও গত একযুগের মধ্যে বাইতুল মোকররমের খতিব আল্লামা ওবায়দুল হক , খেলাফত মজলিশের আমীর শাইখুল হাদিস আল্লামা আযিযুল হক , চরমোনাইর প্রয়াত পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যানমুফতি ফজলুল হক আমিনী , মালিবাগ জামিয়া শারিয়ার প্রিন্সিপ্যাল মুফতি কাজী মুতাছিম বিল্লাহ, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সিনিয়র সহ-সভাপতি, জামিয়া শারঈয়্যাহ মালিবাগের প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আশ্রাফ আলী সহ অনেকেই ইনতিকাল করেন । এসকল ওলামাদের স্থান কখনোই পুরণ হবার মতো নয়। আল্লাহ তা’য়ালা এসব আলেমদে শূণ্যস্থান পূরণকরার জন্য যোগ্য ও তাকওয়াবান আলেম আলেম পদয়া করে দিন । আমীন!
লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক
-এটি