নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
মানুষ দুনিয়ার জীবনে উত্তম থেকে উত্তম জীবন-যাপন, পার্থিব সব রকমের আরাম-আয়েশের জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকে। চেষ্টার অন্ত থাকে না। ইচ্ছা হয় দ্রুততম সময়ে যেন বেশির চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক উপকারিতা অর্জন করা যায়। যাতে স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে অভিজাত জীবন-যাপন করা যায়।
এ সকল ইচ্ছা পূর্ণ করা বাহ্যিকভাবে শ্রম ও উপার্জন ছাড়া সম্ভব নয়। যেহেতু সব মানুষই কোনো না কোনো ব্যাপারে জীবন-যাপন ও মনমতো সহজ পন্থা অর্জনে পেরেশান থাকে। এজন্য একেকজন উপার্জনের একেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করে কিন্তু সুস্থরুচিবোধ সম্পন্ন ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ পার্থিব প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য হালাল উপার্জনকে প্রাধান্য দেয়।
তারা সব সময় উত্তম পবিত্র হালাল রিযিক উপার্জন পছন্দ করে। এ মহান লোকদের সম্পদে আল্লাহ তায়ালা কল্যাণ ও বরকত ঢেলে দেন। তাদের অন্তরে প্রশান্তি দান করেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনগণ জুমুআর দিনে যখন নামাযের আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর।
এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমুআ, আয়াত : ৯-১০)। আয়াতটিতে মহান সৃষ্টিকর্তা হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রেও নীতিমালা বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! বিশেষকরে জুমুআর দিন যখন তোমরা বেচাকেনা তথা কারবার অথবা জীবিকা উপার্জনে রত থাক আর এরই মধ্যে মুয়াযযিন তোমাদের নামাযের জন্য আহ্বান করতে থাকে তখন সব ব্যস্ততা ছেড়ে দিয়ে মসজিদে অভিমুখী হও। এ আমল তোমাদের জন্য কল্যাণ ও বরকতের কারণ। যদি তোমরা বুঝ তাহলে এটাই তোমাদের জন্য উত্তম।
অথচ যদি একনিষ্ঠভাবে প্রাকৃতিক দৃষ্টিাকোন থেকে দেখা হয় তাহলে বাহ্যত লেনদেন বা কারবার বন্ধ করার দ্বারা ক্ষতি হচ্ছে বুঝা যায়। কিন্তু মহান প্রভু সব রকমের ব্যস্ততা বন্ধ রেখে ফরয নামায আদায় করাকে উত্তম আখ্যা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর মধ্যে প্রভুত কল্যাণ রয়েছে। মুমিন বান্দা মহান আল্লাহর এই ওয়াদার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে মসজিদে চলে যায়। তখন আল্লাহও এমন বান্দাদের বিফল করেন না; বরং তার সততার মাধ্যমে হালাল উপার্জনের জন্য করা শ্রমের মধ্যে রহমত ও কল্যাণের উপকরণ দিয়ে ভরপুর করে দেন। এ ধরনের লোক বাহ্যত অল্প-স্বল্প পুজি খাটিয়েও ভালো আয় করে। প্রশান্ত ও সুখী জীবন-যাপন করে।
পক্ষান্তরে হারাম উপার্জনের দ্বারা মানুষ যদিও অঢেল টাকা-পয়সা কামাতে পারে কিন্ত অন্তরের প্রশান্তির দৌলত ভাগ্যে জোটে না। হারাম সম্পদের কারণে মানুষের অন্তর শক্ত ও অন্ধকার হয়ে যায়। আল্লাহর ভয় অন্তর থেকে বের হয়ে যায়। যার কারণে এ ধরনের মানুষের নেক আমলের শক্তি খতম হয়ে যায়। অন্তরে দুর্গন্ধযুুক্ত ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি হয়ে যায়। সব সময় তখন কুপ্রবৃত্তির বিজয় হয়। সৎচরিত্র ধ্বংসের কারণ হয়। অবৈধ সম্পদ উপার্জনকারী ব্যক্তি মিথ্যা, গিবত, অহংকার হিংসার মতো খারাপ গুণগুলোতে চরমভাবে লিপ্ত থাকার কারণে নিজেও কষ্টে থাকে এবং অন্যকেও কষ্ট দেয়। দুনিয়ার লোভ-লালসা আখেরাতের চিন্তা-চেতনার ওপর ছেয়ে যায়। যার কারণে এমন লোক মানুষের দৃষ্টি থেকে পড়ে যায়।
হারাম উপার্জনকারীর দোয়া কবুল হয় না। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, বহু লোক দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকে, ইয়া পরওয়ারদেগার! ইয়া রব!’ কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহার সামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহিত, এমতাবস্থায় তার দোয়া কি করে কবুল হতে পারে? মুসলিম।
আরেক হাদীসে এসেছে, মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (জামে তিরমিযী) হারাম উপার্জনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো এতে করে মানুষ চিন্তা-পেরেশানিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদ পুরাই ধ্বংস। কোনো কল্যাণ নেই এতে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে নবীজী (সা.) বলেন, ‘যে বান্দা হারাম সম্পদ অর্জন করে, যদি তাকে সদকা করে দেয় তবে তা কবুল হবে না। আর যদি খরচ করে তাহলে তাতে বরকত নেই। মৃত্যুর পর রেখে গেলে তবে জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণ।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
হারাম উপার্জন করা এবং এর থেকে দান-সদকা করা, নেক কাজ করা আল্লাহর কখনই পছন্দ নয়; বরং এ সব কিছু অনর্থক বলে গণ্য হবে। এমনকি এটা মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হবে। যেহেতু হারাম সম্পদ অপবিত্র ও নিকৃষ্ট, তাই এটা কোনোভাবেই পাপ-পঙ্কিলতাকে পাক-সাফ করতে পারবে না। সুফিয়ান সাওরী (রহ.) কত সুন্দর বলেছেন! ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় হারাম সম্পদ ব্যয় করে, এর দৃষ্টান্ত এমন যেমন নাকি অপবিত্র কাপড়কে প্রশ্রাব দ্বারা পবিত্র করা।’ (ইহয়াউল উলূম) এ কথা স্পষ্ট যে, অপবিত্র কাপড়কে পবিত্র কাপড়ই পবিত্র করতে পারে। ঠিক তেমনি পাপ-পঙ্কিলতাকেও শুধুমাত্র হালাল উপায়ে উপার্জিত দান-সদকাই পবিত্র করতে পারে।
আর সব সময় ভয়-ভীতি কাজ করে যে, কখন জানি এ সম্পদ আবার সরকার ও দুদকের নজরে এসে যায়! কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়তে হয়!
সূরা জুমুআর আয়াতটিতে আরও বলা হয়েছে ‘যখন নামায শেষ হয়ে যাবে তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়’ অর্থাৎ মহান প্রভুর অনুগ্রহ তালাশ কর। রিযিক অর্জনে কাজকর্মে মগ্ন হয়ে যাও।
কিন্তু মনে রাখবে, কাজে থেকেও আল্লাহর নাম বেশি বেশি স্মরণ রাখবে, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। দুনিয়া আখেরাতের সফলতা লাভ করতে থাক। উদ্দেশ্য হলো কারবার, লেনদেন ও সব রকম ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর নাম স্মরণ রাখা। যখন আল্লাহর নাম সব সময় হৃদয়ে জাগরুক থাকবে তখন একজন মুমিন বান্দা কিছুতেই অবৈধ উপার্জন করতে পারবে না, বিবেক তাকে বাধা দেবে। কৃত্তিমভাবে পণ্য গুদামজাত করে মূল্য বাড়াবে না। মুমিন বান্দার দৃষ্টিতে যখন কেবল সৃষ্টিকর্তা মহান প্রভুর সত্ত্বা বিরাজমান থাকবে তখন সে কোনো গ্রাহককে না জানিয়ে ভেজাল পণ্য বিক্রি করবে না। কর্মস্থল, চাকুরিস্থলে কোনো ধরনের আত্মসাৎ করবে না। বিন্দুমাত্র অসততার পরিচয় দেবে না।
কোম্পানির মাল চুরি করবে না। ঘোষের সঙ্গে জড়িত হবে না। বরং সব সময় মহান আল্লাহর ভয় অন্তরে থাকার কারণে সব লেনদেনে শুদ্ধতার পরিচয় দেবে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ বিষয়টিকে খুব স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তোমরা তো মানুষ। তোমাদের রিযিক তো আল্লাহই দেবেন, কারণ তিনিই তো মহান রাব্বুল আলামীন।
শুধু তোমরা নও; বরং তোমরা যাদের রিযিক দাও না সে সকল সৃষ্টজীবকেও তিনি রিযিক পৌঁছিয়ে দেন । মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার উপকরণ সৃষ্টি করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের অন্নদাতা তোমরা নও।’ (সূরা হিজর, আয়াত : ২০)। আয়াতটি দ্বারা বুঝা যায়, প্রত্যেক প্রাণীর রিযিকদাতা আল্লাহ তায়ালাই। চিন্তার বিষয় হলো, মহান আল্লাহ কত সিষ্টেমে সৃষ্টজীবের রিযিকের ব্যবস্থা করেন! পাখির দিকে তাকালেই বুঝা যায়, মহান প্রভু কিভাবে এদের রিযিক পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন! চতুষ্পদ জন্তুগুলোর দিকে তাকালেও বুঝা যায়, যাদেরকে আমাদের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন, কত সুন্দরভাবে এদের রিযিক পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন! বন-জঙ্গলের পশু-পাখি, পোকা-মাকড়, কিট-পতঙ্গ কোথা থেকে তাদের রিযিক নিয়ে নিচ্ছে।
এরা সবাই মহান আল্লাহ থেকে রিযিক পেয়ে যায়। সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করে। এদের রিযিক যদি আল্লাহ এভাবে দিয়ে দেন তাহলে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের রিযিক কি তিনি বন্ধ করে দেবেন? না! কখনোই এটা হতে পারে না। তিনি মানুষের জন্য রিযিক উপার্জনের মাধ্যম ও উপকরণ সৃষ্টি করেন। অবশ্য এ রিযিক উপার্জন করার জন্য পবিত্র ও হালাল পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ করেছেন এবং হারাম থেকে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের এমন এক সময় আসবে যে, রুজি হালাল উপায়ে উপার্জিত হচ্ছে, নাকি হারাম উপায়ে উপার্জিত হচ্ছে সে এটা পরওয়া করবে না।’ (সহীহ বুখারী)।
তাই হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকা জরুরি, এমনিভাবে সন্দেহযুক্ত উপার্জন থেকেও বেঁচে থাকা জরুরি। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের সবাইকে সত্যিকার অর্থে হালাল উপার্জন করার তাওফীক দান করেন।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ