রফিকুল ইসলাম জসিম ।।
মণিপুরের প্রভাবশালী রাজা খাগেম্বা (১৫৯৭-১৬৫২) আমলে মুসলমানদের এক বড় বাহিনীর মণিপুরে প্রথম আগমন হয়৷ ইতিহাস পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন যে, কারা এ মুসলমান বাহিনী ও কোথা হতে আগত ৷ এই সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ সানী৷
যে ক’জন ক্ষণজন্মা পুরুষ ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো শেখ মোহাম্মদ শানী। বিরল ব্যাক্তিত্ব, বীর যোদ্ধা, মহান পুরুষ শেখ মোহাম্মদ সানী, যিনি ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে কাছাড় রাজার অনুরোধে মণিপুরি অভিযানে তরফ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন৷ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তৎকালীন তরফ নবাবের ভ্রাতা ছিলেন৷ তাঁর সততা, দক্ষতা, সময়ানুবর্তিতা, দেশপ্রেম ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মণিপুর রাজা খাগেম্বা তাঁকে মুসলিমদের রাজা হিসাবে অভিহিত করেছিলেন৷
শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন।
প্রিয় নবীর হাতে মুসলমান না হলেও উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন, নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তরসূরী’রাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন। এমনিতে অন্য ধর্মের লোকের কাছে মুসলমান মানেই শেখ বা সেক। কেউ কেই শেখ কেউ সেক কিংবা কেউ বা শেখ এর রূপান্তর শাইখও ব্যবহার করে থাকেন।
বংশগত মণিপুরি মুসলিমদের শেখ, সৈয়দ, পাঠান, মুঘল, বলা হলেও তাদের পেশা, কর্ম, বীরত্ব, ও অবস্থান বিবেচনায় বিভিন্ন সময়ে মণিপুরের রাজা কর্তৃক বংশের নামকরণ হয়।
যুগের পরিবর্তন এবং প্রয়োজনের তাগিদের নতুন বংশ সংযোজন হলে সামাজিক গোত্র সংখ্যার অাধিক্য কিছুটা লক্ষ করা যায়৷ তাই নিম্নে কয়েকটি বংশের আলোচনা করা হলো :
মোইজিং: শেখ সম্প্রদায়ভূক্ত এ গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ মোহাম্মদ ১৬০৬ সালে মুসলিম বাহিনীর সদস্য হিসেবে মণিপুরে আগমন করেন। তিনি মোইজিং পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করলে তার বংশধারাকে মইজিং মায়ূম বা বংশ নামকরণ করা হয়।
থৌবাল: শেখ বংশ। তাদের প্রথম বংশধর হচ্ছেন জনাব ঈব্রাহিম মিয়া। তিনি শেখ মোহাম্মদ সানীর সিপাহী ছিলেন। মণিপুরের থৌবাল নদীর তীরে প্রথম বসতি স্থাপনকারী হিসেবে *থৌবাল বংশ নামকরণ করেন রাজা খাগোম্বা (১৫৯৭-১৬৫২)
ইফাম: পাঠান বংশধর। জনাব মুন খান এর বংশধর। মোহাম্মদ সানীর সহযোদ্ধা এবং একজন সেনাপতি ছিলেন৷ মহারাজা খাগেম্বার শন বাগান দেখাশুনা করতেন (ই-গী হিঙ্গোল শেন্নহানখি) বলে রাজা ইফাম বংশধর হিসেবে নামকরণ করেন৷
সাজবম: শা আচৌবা ( শরীল মোটা বিশিষ্ট এক ব্যক্তির বংশ সাজবৌম / সাজবম। মহারাজা খাগেম্বা এই নামকরণ করেন৷
কোন্থা: শেখ বংশধর। জনাব ইশাক আলী মোল্লার বংশধর। লেখক জনাব খৈরুদ্দিন খুল্লাকপাম এর ধারনা পাঠান বংশধর এবং (ইয়াদ দাশট কর্মী ই নামা) তে শেখ বংশ বলে উল্লেখ করেছেন। মণিপুরের কোন্টা নামক স্থানে প্রথম বসবাসকারী ব্যক্তি হিসেবে রাজা খুঞ্জাওবা (১৬৫২-১৬৬৬) কোন্থা বংশ বলে অভিহিত করেন৷
য়ুমখাম: শেখ বংশধর৷ জনাব ঔলাদ অষ্টে কসকে (তুয়া আকানবা)এর আদি বংশধর। মোহাম্মদ সানির ১৬ জন্য সেনা সরদারের অন্যতৃ সদস্য। তিনি দুই সহোদর কুন্দর খান
কৈথেল ইংখোল: মোহাম্মদ আলীর ছোর ভাই কৌরিক শেখ, যিনি বাজার এর কাছে বসবাস করতেন ও বিভিন্ন জিনিসপত্র বেচা-কেনা করতেন। তাই তার বংশকে কৈথেল ইংখোল নামে অভিহিত করা হয়।
কৈনৌ: শেখ বংশধর। জনাব উখা দৌলৎ এর বংশধর । ১৬৭২ সনে সিলেটের দমছড়া নামক স্থান হতে মণিপুরের বিষ্ণুপুর অঞ্চলের
কৈনৌ নামক স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করায় রাজা পাইখোম্বা ( ১৬৬৬-১৬৯৭) কৈনৌ বংশ বলে নামকরণ করেন৷
মোইনাম: বংশটি শেখ বংশের অধিকারী। জনাব জান মোহাম্মদ হচ্ছে এ বংশের আদি ব্যক্তি। কাছাড়ের প্রতাপ গড়ের নবাব মোহাম্মদ সানির সহযোদ্ধা এবং বড় সিপাহী হচ্ছেন জান মোহাম্মদ। সিলেটের তরফ অঞ্চলের মাহুর নামক স্থানের লোক বলে রাজা খাগেম্বা (১৫৯৭-১৬৫২) মাহুর মায়ুম অর্থাৎ মাহুর বংশ হিসেবে অবহিত করেছেন৷ পরবর্তীতে রাজাকে ময়না পাখি উপহার প্রদান করায় রাজা খুশি হয়ে মোইনাম বংশ পুনরায় নামকরণ করেন৷
শাংগমশুম্বা: শেখ বংশের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম বংশধর উমর শেখ। তিনি মুহাম্মদ সানির সহযোদ্ধা ছিলেন। দুধ(শাংগম) দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মজার জিনিস মহারাজা খাগেম্বাকে উপহার দেওয়ার রাজা খুশি হয়ে শাংগমশুম্বা বংশ নামকরণ করেন।
-এটি