মাদরাসা শিক্ষার মূল স্টেয়ারিং শিক্ষাসচিবের হাতে। তিনিই পড়াশোনার মান উন্নয়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। আর সাধারণত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সচিব যিনি হোন, তিনি অনেক চৌকান্না ও খুব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হোন। আর সেটা যদি হয় দেশের বড় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাহলে সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সচিব কেমন যোগ্যতাসম্পৃন্ন, চৌকান্না ও অভিজ্ঞতার অধিকারী হবেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ কথা বলেছিলাম এমনি একজন নাজিমে তালিমাতের সাথে। যিনি প্রায় ২৫ বছর যাবত অত্যান্ত সুুনাম ও সুখ্যাতির সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি মুফতি মকবুল হোসাইন। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী দা. বা. প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসার দীর্ঘদিনের শিক্ষাসচিব তিনি। তার সাথে কথা হয় একজন আদর্শ শিক্ষাসচিবের পরিচয় ও করোনা সংকটে মাদরাসা শিক্ষার ক্ষতি পোষানার বিষয়ে। মুফতি মকবুল হোসাইন কথা বলেছেন ছাত্রদের পড়াশুনায় মনোযোগী হওয়া নিয়েও। তার মুখোমুখি হয়েছে আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম সাংবাদিক মোস্তফা ওয়াদুদ
মোস্তফা ওয়াদুদ: একজন আদর্শ নাজেমে তালিমাত এর পরিচয় কী?
মুফতি মকবুল হোসাইন: একজন আদর্শ নাজেমে তালিমাত তো হবেন তিনি। যিনি তার শিক্ষা বিভাগীয় কার্যক্রমকে সুস্ঠুভাবে পরিচালনা করবেন। সাথে সাথে ছাত্রদের আমল আখলাকের উন্নতির ব্যবস্থা নিবেন। ছাত্রদের সর্বদিকে নজর দিবেন। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি দেখেন তাহলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবেন। এটাতো হলো মূল কাজ। অর্থাৎ ইলম ও আমল উভয়টাকে যে সমন্বয় করে চালাবেন তিনি হলেন একজন আদর্শ নাজিমে তালিমাত বা শিক্ষাসচিব।
মোস্তফা ওয়াদুদ: নাজিমে তালিমাতের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
মুফতি মকবুল হোসাইন: শিক্ষা বিভাগের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দরস-তাদরিস বা পঠন-পাঠন। অর্থাৎ যারা শিক্ষক হবেন তারা নিয়মিত দরস দান করবেন। প্রতিদিন ক্লাস করাবেন। ছাত্রদের পড়া আদায় করবেন। ছাত্রদের পড়ালেখার প্রতি খেয়াল রাখবেন। এসবের মাঝে যেনো কোনো ধরনের ত্রুটি না হয়। সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দিবেন। এগুলো একজন শিক্ষকের মূল ও প্রধান দায়িত্ব। আর প্রতিষ্ঠানের নাজিমে তালিমাত বা শিক্ষাসচিব যিনি হবেন তার অন্যতম আরেকটি কাজ হবে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ তাদের দায়িত্বকে সঠিকভাবে আদায় করছে কিনা তা নিজের জিম্মাদারীতে তদারকি করা।
মোস্তফা ওয়াদুদ: শিক্ষক বা মাদরাসার প্রধান গুণ হওয়া উচিত দূর্বল ছাত্রদের সবল করা। তো এক্ষেত্রে একজন শিক্ষাসচিব কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
মুফতি মকবুল হোসাইন: দূর্বল ছাত্রদের ব্যাপারে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ প্রথমেই খেয়াল করবেন তার কী কী বিষয়ে দূর্বলতা রয়েছে। সেসব দূর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর চিহ্নিত হওয়া দূর্বলতাগুলো দূর করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন কর্তৃপক্ষ।
প্রথমত প্রাইভেট কোনো শিক্ষকের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। যিনি দরসের বাইরে ছাত্রকে নিয়ে মেহনত করবেন। ছাত্রের নাহু-সরফের দূর্বলতা থাকলে সেসব দূর্বলতা কাটিয়ে দিবেন। তার হাতের লেখার কোনো ত্রুটি থাকলে সেটাও কোনো নেগরান উস্তাদের সাহায্যে হাতের লেখার দূর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করবেন। যেসব ছাত্রদের পড়ালেখায় অমনোযোগিতা আছে। অথবা মেবাইলের আসক্তি আছে। কিংবা বাসাবাড়িতে যাওয়ার প্রবণতা আছে। তাদের জন্য একজন শিক্ষককে নেগরানির দায়িত্ব দিয়ে দেয়া। যিনি তার নেগরানিতে রেখে তার উপরোক্ত ত্রুটিগুলো দূর করার চেষ্টা করবেন।
মোস্তফা ওয়াদুদ: এবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনি বারিধারা মাদরাসায় কত বছর ধরে নাজিমে তালিমাতের দায়িত্ব পালন করছেন?
মুফতি মকবুল হোসাইন: আসলে আমি বারিধারা মাদরাসায় ১৯৯০ সন থেকেই আছি। আর সে সময় থেকে আনুমানিক চার বা পাঁচ বছর যাবত পদবি ছাড়াই তালিমাতের কাজ করেছি। মূল দায়িত্বে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী হাফিজাহুল্লাহ ছিলেন। আর আমি কাজ করেছি। এরপর পদবি আসছে। অর্থাৎ ১৯৯৫ সাল থেকে আমি এ পদে পদবিধারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
মোস্তফা ওয়াদুদ: দীর্ঘ এ ২৫ বছরে আপনার তালিমাতের স্বতন্ত্রতা কী?
মুফতি মকবুল হোসাইন: আমি প্রথম থেকেই যেটা চেষ্টা করেছি সেটা হলো সবকের পাবন্দি করা। কারণ একজন নাজিমে তালিমাত যদি নিজে সবকের পাবন্দি করেন তাহলে এটা অন্যদের জন্য আদর্শ হয়। অন্য উস্তাদদের বলা যায় যে, আপনারাও সবকের পাবন্দি করেন। আর যদি নাজিমে তালিমাত তার নিজের মাঝে কোনো ত্রুটি থাকে তাহলেতো তিনি অন্যকে বলতেও ইতস্ততবোধ করবেন। তো সেক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই আমি আমার সবকের হক আদায় করে ছাত্র গঠন করার। অর্থাৎ আমি একান্ত জরুরত ছাড়া কখনোই সবক মিস দেইনি আলহামদুল্লিাহ। অনেক বছর এমনও আছে যে, সারাবছর আমার একদিনও সবক পড়ানো মিস হয়নি। সব সময়ই ছাত্রদের হক আদায় করে সবক পড়িয়েছি।
আরেকটা হলো পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে। নাজিমে তালিমাতের অন্যতম একটি দায়িত্ব হলো সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা নেয়া। পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারেও আমি চেষ্টা করেছি সুশৃঙ্খলভাবে পরীক্ষা নেয়ার। কোনো ছাত্র যাতে কোনো ধরনের অসত উপায় অবলম্বন না করে সে ব্যাপারে যথেষ্ট তদারকি করেছি। আর এ তদারকির ফলে ছাত্ররা বোর্ডপরীক্ষায় কোনো ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করেনা এবং বোর্ড পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে।
মোস্তফা ওয়াদুদ: এবছর শিক্ষাবছরের চারমাস অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে মাদারাসগুলো কোন পদ্ধতিতে এগুলে এ ক্ষতি থেকে পুষিয়ে উঠতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
মুফতি মকবুল হোসাইন: এখানে আমাদের দুটি চিন্তা। একটি হলো মাদরাসার পরীক্ষা। অন্যটি হলো বোর্ড পরীক্ষা। আমাদের মাদরাসাগুলোর বছরে পরীক্ষা সাধারণত তিনটি হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সাময়িক পরীক্ষা। কিন্তু এবছর আমরা পরীক্ষা নিবো দুটি। অর্থাৎ বছরের মাঝখানে পরীক্ষা একটাই নিবো। সেটা রবিউল আউয়ালের শেষেও হতে পারে। আবার রবিউস সানীর শুরুতেও হতে পারে। এখানে একটি পরীক্ষা কমে যাওয়ার কারনে আমাদের তিন সপ্তাহ সাশ্রয় হবে।
দ্বিতীয় চিন্তা হলো বোর্ডপরীক্ষা নিয়ে। গতবছর বোর্ডপরীক্ষার তারিখ ধার্য করা হয়েছিলো রজব মাসের ২৮ তারিখ থেকে। এবছরও মুরুব্বিরা হয়তো সেটাই চিন্তা করবেন। অর্থাৎ বোর্ড পরীক্ষা শবে বরাতের পরে নেয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। আর শবে বরাতের পরে যদি বোর্ডপরীক্ষা নেয়া হয় তাহলে এখানেও আমরা অতিরিক্ত অন্তত দু’সপ্তাহ পেয়ে যাবো। আর ঐদিকে পরীক্ষা একটা কমে যাওয়ায় পেলাম তিন সপ্তাহ। এই মোট পাঁচসপ্তাহ পেলাম। এই পাঁচ সপ্তাহ সবক পড়ালে অনেক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে মাদরাসাগুলো। এরপর হলো মাদরাসার অন্যান্য ছুটিছাটা যাতে কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। আর নিয়মিত যাতে সবক চালু থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখা। এমনকি কিছু ক্লাস শুক্রবারেও নেয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি। এসব প্রক্রিয়ায় ক্ষতিটা পােষানোর চিন্তা করা যেতে পারে।
মোস্তফা ওয়াদুদ: একজন তালিমাত হিসেবে ছাত্রদের উদ্দেশে যদি কিছু বলতেন।
মুফতি মকবুল হোসাইন: ছাত্রদের উদ্দেশে বলবো, যে সময়টা এখন আমাদের হাতে আছে সেসময়টা যেনো ছাত্ররা ছুটিছাটা না কাটায়। নিয়মিত সবকের মাঝে উপস্থিত থাকে। মেহনত করে পড়ে। তাহলে কম সময়ে বেশি পড়তে পারবে। আর এর মাধ্যমে পড়ার হকটাও আদায় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
এমডব্লিউ/