আন্দমান নওশাদ: মোঘল আমলের স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে দুটি মসজিদ। একটি বড় সোনা মসজিদ। অন্যটি ছোট সোনা মসজিদ। বড় সোনামসজিদ রয়েছে ভারতের মালদহে। আর রাজশাহীর পাশের জেলা চাঁপাইনবাবঞ্জের পশ্চিমে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজায় রয়েছে ছোট সোনামসজিদ।
ঢাকা থেকে ছোট সোনা মসজিদের দূরত্ব ৩১৭ কিলোমিটার। উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে দূরত্ব মাত্র ৮২ কিলোমিটার। এর প্রাচীন স্থাপত্যকলা আজও দর্শনার্থীদের টানে। প্রতিদিন বসে দর্শকদের মিলনমেলা। তবে চাইলে যে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঘুরে আসতে পারেন- ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদে।
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। রাজশাহী থেকে পৌনে ২ ঘণ্টা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই ছোট সোনামসজিদ। এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনেও যাওয়া যাবে রাজশাহী। সেখান থেকে সোনামসজিদ।
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ এবং ঈদের প্রধান জামাতও অনুষ্ঠিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক এই মসজিদে।
প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী হেরিটেজের সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী জানান, বড় সোনামসজিদ রয়েছে ভারতের মালদহে। আর রাজশাহীর পাশের জেলা চাঁপাইনবাবঞ্জের পশ্চিমে শিবগঞ্জ থানার ফিরোজপুর মৌজায় রয়েছে ছোট সোনামসজিদ। এটি সুলতানী আমলের স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন।
এর প্রাচীন গঠনভঙ্গির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এই মসজিদের গম্বুজগুলির মধ্যস্থলে কেন্দ্রীয় গম্বুজ হিসেবে বাংলাদেশে প্রচলিত চৌচালা বাড়ির চালের মতো পরস্পর তিনটি গম্বুজ সংযোজিত রয়েছে। এছাড়া দুই সারিতে তিনটি করে দুই পাশে রয়েছে আরও ১২টি গোলাকৃতির গম্বুজ। মোট ১৪টি গম্বুজ ছোট সোনামসজিদের অপরূপ শোভা ধারণ করে রেখেছে আজও।
এই মসজিদের ভেতরটা গৌড়ের আদিনা মসজিদের অনুরূপ। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র ছাদ বা মঞ্চ প্রস্তর স্তম্ভের ওপর স্থাপিত রয়েছে এবং সেখানে যাতায়াতের জন্য উত্তর দেয়ালে একটি সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি সংলগ্ন একটি মিনারও রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য। ভেতরের ওই ছাদটির একটি প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরিত হয়ে নিকটস্থ হজরত শাহ্ নেয়ামত উল্লাহর সমাধি প্রাঙ্গণে নীত হয়েছে। কারুকার্য খচিত মেহরাব রয়েছে মসজিদে।
গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, মসজিদটির দৈর্ঘ ৮২ ও প্রস্থ ৫২ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং এর চার পাশে অষ্টকোণ বিশিষ্ট সুউচ্চ চারটি বুরুজ আছে। মসজিদটি মূলত ইটের ইমারত হলেও দেয়ালের বাইরের অংশ পাথর আবৃত।
ভেতরের দিকেও দেওয়ালের বেশ অংশ জুড়ে পাথর আবৃত। সামনের দেয়ালে সমমাপের ৫টি দরজা রয়েছে। এছাড়া মসজিদের গায়ে নানা প্রকার লতাপাতার কারুকার্য তো আছেই। মধ্যবর্তী দরজার চারপাশের কারুকাজ অধিকাংশই পাথরে খোদিত। স্থানীয় লোকেরা গৌড়ের বড় সোনামসজিদের সঙ্গে তুলনা করে একে ‘ছোট সোনামসজিদ’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
কিছু সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী এই মসজিদের সাজ-সজ্জার পরিকল্পনা বা নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে এ গম্বুজগুলি সোনালি রঙে গিল্ট (সোনায় বাঁধানো) করা হলে এটি সোনামসজিদ নামে অভিহিত করা হয়। বঙ্গের গৌরবময় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খৃস্টাব্দ) ৮৯৯ থেকে ৯২৫ হিজরীর মধ্যে জনৈক আলীর ছেলে ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক ১৪ রজব ছোট সোনামসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। যা মসজিদের সামনের কারুকার্য খচিত দরজার ওপরের অংশের একটি পাথরে উৎকীর্ণ আরবি শিলালিপি থেকে জানা যায়।
মসজিদের ভেতরের আয়তন ৭১ ফুট ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৪০ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ। ৩ সারিতে বিভক্ত। প্রত্যেক সারিতে ৫টি করে পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। কতটা গোলাকৃতি অথচ একটু লম্বা ৫টি মেহরাব আছে। কিন্তু মেহরাবের কারুকার্য খচিত শ্বেত পাথরগুলো বর্তমানে নেই। ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের বহুলাংশ ভেঙে পড়ে। ১৯০০ সালে তা ইট দিয়ে মেরামত করা হয়। আর এই ছোট সোনামসজিদের আঙিনায় শুয়ে আছেন বাংলার ৭ বীরের এক বীর, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
তোহাখানা: চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদের অদূরেই অবস্থিত তোহাখানা। ১৬৫৫ সালে শাহ সুজা এটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে, তাপনিয়ন্ত্রিত ইমারত হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। এর পাশেই রয়েছে মোঘল আমলের মসজিদ ও হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহর মাজার। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দর্শনীয় স্থান এটিও।
থাকার ব্যবস্থা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর ও শিবগঞ্জ উপজেলা শহরে থাকার জন্য রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেল। অল্প খরচের মধ্যেই। এগুলোতে খুব নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দেই থাকা যায়।
আবাসিক হোটেল স্বপ্নপুরী, আলহেরা ও নাহিদসহ অন্যান্য সব আবাসিক হোটেলের সিঙ্গেল অথবা ডাবল বেডের ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যেই। আর থাকার জন্য এসি, ননএসি দুই ধরনের রুমেরই ব্যবস্থা রয়েছে।
এমডব্লিউ/