মুহাম্মদ ইশরাক
মা বাবা, আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক। অসহনীয় কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে তারা আমাদের জীবনকে করে তোলেন প্রাণবন্ত। তাদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের ভিত্তিপ্রস্তরেই নির্মিত হয় আমাদের সকল সুখ ও সমৃদ্ধির গল্প। জন্মের সময় মা'কে ভোগ করতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট ও বেদনা।
'তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে।' (সূরা লোকমান:১৪)
হযরত ইয়াহিয়া (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, সে মায়ের অনুগত এবং উদ্ধত ও নাফরমান নয়।'(সূরা মারয়াম:১৪)
হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, এবং (আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে) জননীর অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি।'(সূরা মারয়াম:,৩২)
কোরআন হাদিস ও সাহাবিদের (রা.) আমল পরোক্ষ করলে এ বিষয়টিই প্রতীয়মান,পিতামাতার খেদমত ও তাদের সেবা- শুশ্রূষা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য বিষয়। তাই আসুন,জেনে নিই আমরা কোরআন হাদিসের আলোকে কীভাবে এই খেদমত আঞ্জাম দিব, ১. তাদের কথা মেনে চলবো।তাদের কোন কথা অমান্য করবো না। আবুদ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,'তার কাছে একজন লোক এসে বলল, আমার এক স্ত্রী আছে। আমার মা আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাকে তালাক দেয়ার জন্য।
আবু দারদা (রাঃ) বললেন, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, জান্নাতের সর্বোত্তম দরজা হচ্ছে বাবা। তুমি ইচ্ছা করলে এটা ভেঙ্গে ফেলতে পার অথবা এর রক্ষণাবেক্ষণও করতে পার।(জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস:১৯০০)
তবে শরীয়ত বিরোধী কাজ হলে ভিন্ন কথা পিতামাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না।'(সূরা লোকমান:১৫)
২.তাদের সামনে মাথা নত হয়ে থাকা। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও' এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।ইসরা-২৪
৩.তাদের কাজকর্মে সহযোগীতা করা। স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল।'(সূরা বাকারা:১২৮)
তাফসীরে আছে, বাবা ও ছেলে পারষ্পরিক সহযোগিতায় ভিত্তি স্থাপিত হয়।তারপর উভয়ে মিলে দোয়া করেছিলেন। ৪. তাদের আহবানে তাৎক্ষণিক সাড়া দেয়া। ইব্রাহিম (আ.) ছেলেকে জবেহের কথা জানালে তিনি তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, 'আব্বাজান"!আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন।'(সূরা সাফফাত:১০২)
৫. তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো তাহলে তোমাদের সন্তানরাও তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে।'(হযরত জাবের রা.থেকে হাকিম বর্ণনা করেছেন) ৬. দোষ করলে তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। ইউসুফ( আ.) এর ভায়েরা বললেন, 'বাবা আমাদের অপরাধ ক্ষমা করান। নিশ্চয় আমরা অপরাধী ছিলাম।'(সূরা ইউসুফ: ৯৭)
৭.তাদের জন্য দোয়া করা। এবং বল,হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।'(সূূরা ইসরা:২৪)
তাদের মনে কষ্ট না দেয়া এবং মিষ্টি ভাষায় কথা বল। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।
৯ বার্ধক্যে উপনীত হলে দেখাশোনা করা।'(সূরা ইসরা:২৪) আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,' নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক, আবারও নাক ধূলিমলিন হোক। জিজ্ঞেস করা হলো, কোন ব্যক্তির, হে আল্লাহর রসূল?
তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে বার্ধক্যাবস্থায় পেল অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না।'(সহিহ মুসলিম, হাদিস :৬৪০৪)
১০. মারা গেলে তাদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করা। আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, 'যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত 'আমাল বন্ধ হয়ে যায় তিন প্রকার 'আমল ছাড়া। ১. সদাকাহ্ জারিয়াহ্ অথবা ২. এমন 'ইল্ম যার দ্বারা উপকার হয় অথবা ৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার জন্যে দু’আ করতে থাকে।(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪১১৫)
১১.মরহুম পিতামাতার জন্য দান সদকা করা। এক ব্যক্তি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললো মরহুমা মায়ের জন্য কিছু দান করলে সে সওয়াব পাবে কি? নবীজি বললেন,হ্যাঁ পাবে।'
পিতামাতার খেদমতে দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে বহুবিধ ফায়দা।নিচে কিছু উল্লেখ করা হলো, ১. জীবন যাত্রায় বরকত লাভ হয়।
আনাস রা. বলেন,'যে চায়যে তার বয়সে বরকত হোক এবং রিজিকে বরকত আসুক সে যেন পিতানাতার খোতমত করে আর আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।(মুসনাদে আহমদ:১৩৪০১)
২. বালা মসিবত থেকে হেফাজত হয়। তিন ব্যক্তি একটি গুহায় আটকা পড়লে একজন মা বাবার খেদমতের ওসিলায় দোয়া করলে আল্লাহ তাদেরকে সেখান থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন।(বুখারী:৫৯৭৪)
৩.আল্লাহর মাগফেরা লাভ হয়। ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট একজন লোক এসে বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (লসাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আমি একটি কাবীরা গুনাহ্ করে ফেলেছি। আমার তাওবাহ করার সুযোগ আছে কি?
তিনি প্রশ্ন করেন, তোমার মা কি বেঁচে আছেন? সে বলল, না। তিনি আবার প্রশ্ন করেন, তোমার খালা কি বেঁচে আছেন? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন,তার সাথে উত্তম আচরণ কর। (জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস:১৯০৪)
৪.জান্নাত লাভ হয়।
ইমাম বায়হাকী ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন,রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে পিতা মাতার অনুগত হয়ে সকাল যাপন করলো। তার জন্য জান্নাতের দুই দরজা উন্মুক্ত করা হবে। একজন হলে একটা দরজা। আর যে ব্যক্তি পিতামাতার অবাধ্য হয়ে সন্ধ্যা পার করলো তার জন্য জাহান্নামের দুই দরজা খোলা হবে৷ একজন হলে একটা।
নাসাঈতে উল্লেখ আছে, এক সাহাবী নবীজির কাছে এসে বললো, আমি জিহাদে যেতে চাই। আপনার কাছে পরামর্শের জন্য আসলাম। নবীজি বললেন, তোমার মা আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবীজি বললেন, তবে মায়ের খেদমতেই থাকো। কারণ তার পায়ের কাছে জান্নাত।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পিতামাতার হক যথাযত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন!
-এটি