মুফতি জাবের কাসেমী।।
মুফতি ও মুহাদ্দিস
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও কোরবানির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অনেকে বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন।আমাদের দেশে বহুলোক প্রতি বছর কোরবানি করে থাকেন। ইসলামের অন্য অনেক আমলের মতো কোরবানিও মানুষ স্বউৎসাহে আদায় করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো এক্ষেত্রে অনেকে বিভিন্ন ভুল করে থাকেন। যার দরুন সোয়াব তো দূরে থাক তাদের কোরবানি বিশুদ্ধই হয় না। এজন্য কোরবানির কিছু ভুল দিক নিয়ে লেখা হলো আজ।
১. কোরবানির ব্যাপারে নিজের ধ্যান- ধারণা পরিস্কার রাখা
কোরবানির ব্যাপারে দু ধরনের ধারণা পাওয়া যায়।। একটি ইসলামি ধারণা। অপরটি জাহেলী ধারণা। জাহেলী ধারণা হলো, কোন মূর্তি বা দেব-দেবীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রাণী উৎসর্গ করা। কিংবা জিন-শয়তান ও কোন অশুভ শক্তির আকস্মিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের নামে কোন কিছু উৎসর্গ করা। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কুসংস্কার, শিরক ও হারাম। ইসলাম ধর্মে এর কোন সুযোগ নেই। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পূর্বে আরবে বিভিন্ন প্রতিমার নামে পশু উৎসর্গ করার প্রথা ছিলো। ইসলাম আসার পর এসবে নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাব্বুল আলামিন কুরআন শরিফে বলেন, “আল্লাহ তাআলা বাহিরা, সায়েবা, ওসীলা, ও হামীকে শরীয়তসিদ্ধ করেননি।” (সূরা মায়েদা, আয়াত: ১০৩)
ক) বাহিরা: ঐ প্রাণী যার দুধ প্রতিমার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো। খ) সায়েবা: প্রতিমার নামে উৎসর্গ করা সে উটনী যার উপর সাওয়ার হওয়া, পশম কাটা, দুধ পান করা নিষেধ।
গ) ওসীলা: ঐ বকরী যা প্রতিমার উদ্দেশে ছেড়ে দেওয়া হতো। ঘ) হামী: প্রতিমার উদ্দেশে ছেড়ে দেয়া পুরুষ উট।
ইসলাম জাহেলী যুগের এসব কু-প্রথাকে বিলোপ করে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছে। আর ইসলামি ধারণার কোরবানির অর্থ হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্হায় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোন প্রিয় বস্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা ও শরীয়ত নির্দেশিত পন্হায় তার ব্যবহার করা। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, “তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ো ও কোরবানি করো।” (সূরা কাউছার, আয়াত: ২) এ আয়াতে নামাজ ও কোরবানিকে এক সঙ্গে উল্লেখ করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নামাজ যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে পড়া যায় না; কোরবানিও অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা যায় না। এজন্য কোরবানির ক্ষেত্রে আমাদের জাহেলী ধারণা বাদ দিতে হবে। ইসলামি ধারণা গ্রহণ করতে হবে।
২. নিয়ত বিশুদ্ধ করা
আমরা বিভিন্ন নিয়তে কোরবানি করে থাকি। কেউ কোরবানি করি সামাজিক মর্যাদা হিসাবে। সমাজে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, সুতরাং কোরবানি না দিলে মর্যাদা থাকবে না; এমন মনোভাব থাকে কারো কারো। কেউ কোরবানি করি চক্ষু লজ্জা থেকে বাঁচতে। কেউ কোরবানি করি গোস্ত খেতে। এ জাতীয় উদ্দেশ্যে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। বরং আমি ছোট ও বড় যে পশুই কোরবানি করি তা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়, অন্য কোন উদ্দেশ্যে যেন না হয়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজীদে ঘোষণা করেন, “এগুলোর গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।” ( সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
৩. আল্লাহর নামে কোরবানি দেওয়া
সাধারণত আমাদের সমাজে ব্যক্তির নামে কোরবানির কথা বলা হয়। যেমন অমুকের নামে, বাবার নামে অথবা মায়ের নামে কোরবানি দিবো। এমনটি বলা ঠিক নয়। কারণ কোরবানি একটি আর্থিক ইবাদত, যা হবে আল্লাহর নামে, ব্যক্তির নামে নয়। এজন্য বলা যেতে পারে অমুকের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি। যদিও কারো নামে কোরবানির দ্বারা তার পক্ষ থেকে আদায় করা উদ্দেশ্য হয়, তারপরও এমনটি বলা উটিত নয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেন, “তোমরা তা ভক্ষণ করো না যেগুলো আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে যবাই করা হয়।” (সূরা আনআম, আয়াত: ১২১)
৪. হাসিল ছাড়া কোরবানি করা
অনেকে মনে করেন হাসিল না দিলে কোরবানি হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। হাসিল হাটের ভাড়া। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেওয়া হয় । তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গোনাহ হবে।
৫. পশু জবাই করার জন্য ধারাল ছুরি ব্যবস্থা করা
আমরা কোরবানির পশু জবাই করার জন্য হুজুরদের ছুরির দিকে তাকিয়ে থাকি। তার ছুরি তো একটা। এজন্য প্রথমে যেগুলো জবাই করেন সেগুলি যত সুন্দর ভাবে জবাই হয় পরের গুলো তেমন হয় না। এজন্য কোরবানির অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর সাথে ধারাল ছুরির ব্যবস্থা করা। নবি করিম সা. ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব , যখন তোমরা (কাউকে শরীয়ত মোতাবেক হদ বা কিসাস হিসাবে) হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন জবাই করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবাই করো। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে। যেন জবাইয়ে প্রাণীর বেশি কষ্ট না হয়।
(সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৫৫)
৬. নিজের পশু নিজেই জবাই করা
অনেকে মনে করেন ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্র দ্বারা জবাই করা জরুরি। আসলে বিষয়টি এমন নয়। বরং নিজে জবাই করা মুস্তাহাব। অক্ষম হলে অন্য কোনো মুসলমান দিয়ে জবাই করা যেতে পারে। তবে ইমাম, উলামায়ে কেরাম ও ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসার কারণে তাদের দ্বারা কোরবানি করালে দোষের কিছু নেই। হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূল সা. দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কোরবানি করেছেন ও বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন। (সহীহ বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫৫৫৮)
৭. কোরবানির সময় দাতাদের নাম পাঠ করা জরুরি মনে করা
কোরবানির সময় দাতাদের নাম কাগজে লিখে হাতে নিয়ে পাঠ করাকে অনেকে জরুরি মনে করেন। অথচ কোরআনও হাদিসে এর কোন ভিত্তি নেই। বরং যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি হচ্ছে তা আল্লাহ তাআলা ভালো করে জানেন। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়।” (সূরা আ’লা, আয়াত: ৭)
৮. জবাইয়ের পূর্বে লম্বা দোয়া পড়া জরুরি মনে করা
অনেকে এ অজুহাতে কোরবানির পশু জবাই করি না যে, আমার তো দোয়া মুখস্থ নেই। অথচ জবাইয়ের পূর্বে হাদীসে বর্ণিত দোয়াটি পড়া উত্তম; জরুরি নয়। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে জবাই করলে পশু জবাই শুদ্ধ হয়ে যাবে। (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫২৩৮)
৯. জবাইকারী ও তার সহযোগীদের বিসমিল্লাহ পড়া জরুরি
জবাইকারী ও তার সাথে সহযোগীরা যদি জবাইয়ের সময় ছুরিতে হাত লাগায় তাহলে প্রত্যেককে বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এদের কেউ যদি ইচ্ছাপূর্বক জবেহ এর সময় বিসমিল্লাহ না পড়ে তাহলে পশু কোরবানি হবে না। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪) আমরা অনেকেই এ মারাত্মক ভুল করি।
১০. জবাইয়ের সময় পশুর চারটি রগের তিনটি কাটা নিশ্চিত করা
অনেক সময় জবাইকারী একটু জবাইয়ের পর কসাই ভাইয়েরা ছোট ছুরি দিয়ে পশুর গলায় জোরে আঘাত করেন; এটি সম্পূর্ণ নাজায়েয ও গর্হিত কাজ। এতে পশু জবাই হলো না বরং আঘাতে হত্যা করা হল। এজন্য প্রাণীর চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটা নিশ্চিত করতে হবে। চারটি রগ হলো শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি রক্তনালি বা শাহরগ।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া মাহমুদিয়া ইসহাকিয়া মানিক নগর, ঢাকা-১২০৩
এমডব্লিউ/