শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাসিনা ও তার দোসরদের পুনর্বাসনে কোনো সাফাই নয়: সারজিস

ইসলামে সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপকারী সাহাবি হজরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।

তিনি বিশিষ্ট সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)। হিজরতের ২৩ বছর আগে ৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে কোরাইশের বনু যোহরা গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। মাতা হামনা। যেহেতু তাঁর নানীর বংশ নবীজির বংশপরম্পরায় যোহরা বংশে ছিল, সে হিসেবে নবীজি (সা.) তাঁর মামা হন। নবীজি (সা.) অনেকবার নিজেও এই আত্মীয়তার কথা স্বীকার করেছেন।

জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি তিনি। ইসলামের সূচনালগ্নে তৃতীয় বা চতুর্থ নম্বরে ইসলাম গ্রহণ করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ইসলাম গ্রহণের খবর তাঁর মা জেনে গেল। সে ছিল চরম ইসলামবিদ্বেষী। তাই তাঁর ইসলাম গ্রহণে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। এমনকি পানাহার ছেড়ে দিল। আর বলল, তুমি যদি এই ধর্ম থেকে ফিরে না আস, তাহলে আমি পানাহার করব না। তার এ অভিমান ছিল সাদের জন্য কঠিন পরীক্ষা। তিনি ছিলেন মায়ের অনুগত সন্তান।

কিন্তু ঈমানকে মায়ের ভালোবাসার উপর অগ্রাধিকার দিলেন। অটল থাকলেন ইসলামের ওপর। মাকে লক্ষ করে বললেন, মা আমার! আপনার যদি হাজারটা প্রাণ থাকে। আর হাজারবার এ ধরনের কসম করেন, তারপরেও আমি আমার ধর্ম থেকে ফিরে আসতে পারব না। আল্লাহপাক খুিশ হয়ে তাঁর ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল করলেন, ‘যদি তারা আমার সাথে এমন বিষয়ের শরিক করার জন্য বল প্রয়োগ করে যার তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের আনুগত্য করো না আর দুনিয়াতে তাদের সাথে সৎভাবে সাহচর্য অবলম্বন কর।’ (সূরা লুকমান, আয়াত : ১৫)

ইসলাম গ্রহণ করার পর হিজরত পর্যন্ত মক্কাতেই অবস্থান করেন। কিন্তু মক্কার জমিন তাঁর জন্য সঙ্কুচিত হয়ে আসে। চলতে থাকে কাফের মুশরিকদের অবর্ণনীয় নির্যাতন।

মক্কায় কাফের মুশরিকদের জুলুম অত্যাচারে যখন মুসলমানগণ অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন। ভেঙ্গে গেল ধৈর্যের বাঁধ। তখন নবীজি (সা.) মুসলমানদেরকে মদিনা শরিফে হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। হজরত সাদ (রা.)ও নবীজির আদেশ শুনে চলে গেলেন মদিনায়।

তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামে তীর নিক্ষেপ করেন। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে রাসূল (সা.) কোরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য ৬০জন সাহাবির একটি টহলদল হিজাযের উপকলীয় নগরীতে পাঠান। সাদ (রা.) ছিলেন এ টিমের অন্যতম সদস্য। এ টহলদল ইকরিমা বিন আবু জাহেলের নেতৃত্বে কোরাইশদের একটি কাফেলাকে দেখতে পান। কোরাইশদের কেউ চিৎকার করে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে হজরত সাদ (রা.) তীর নিক্ষেপ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই কাফেরদের বিরুদ্ধে কোনো মুসলমানের ছোড়া প্রথম তীর।

দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মৃত্যুর প্রাক্কালে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য যে ছয়জন শূরা কমিটি গঠন করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের একজন। রাসূল (সা.) তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! সাদ যখন তোমার কাছে দোয়া করে তুমি তার দোয়া কবুল করো।’ (ইবনে হিব্বান : ৪৫০)

তিনি ইসলামের প্রতিটি যুদ্ধে নবীজি (সা.) এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দেন। জীবন বাজী রেখে অবতীর্ণ হন তুমুল যুদ্ধে। সাঈদ ইবনে আস সারাখিল কাফেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। ঐ কাফেরের যুল কাতিফা নামে একটি তরবারি তাঁর পছন্দ হওয়ার কারণে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গনিমতের বিধান তখনো নাজিল হয়নি এজন্য এটা যেখান থেকে আনা হয়েছিল সেখানে ফেরত দিতে বলা হয়।

এ যুদ্ধে হজরত সাদ (রা.) এর ভাই হজরত উমাইর (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। ভাইয়ের শাহাদাত এবং তরবারিটি রাখতে না পারার কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। আল্লাহ পাক তরবারির ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের সূরা আনফাল নাজিল করলেন। তারপর রাসূল (সা.) তাকে ডেকে তরবারি নিয়ে আসার অনুমতি দিয়ে দেন।

তৃতীয় হিজরিতে উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলমানদের পদসমূহ প্রকম্পিত হয়ে গিয়েছিল। আর সবাই নবী (সা.)-কে ছেড়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি দশ জনের চেয়ে কম লোক রাসূলের পাশে রইল তখন সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) তুনীর নিয়ে রাসূলকে রক্ষা করতে লাগলেন। প্রত্যেকটি তীরের আঘাতে তিনি একেকটা কাফেরকে হত্যা করতে লাগলেন।

রাসূল (সা.) তাঁকে এমনভাবে তীর নিক্ষেপ করতে দেখে উৎসাহ দিয়ে বললেন, সা‘দ! তুমি তীর ছুঁড়ে মার আমার পিতা ও মাতা তোমার জন্য উৎসর্গ হোক, তুমি তীর ছুঁড়ে মার।

এক কাফের মুসলমানদেরকে যুদ্ধে খুব পেরেশান করে রাখছিল নবীজি (সা.) তাকে নিশানা বানাতে নির্দেশ করলে তিনি তীরের ফলা ছিল না অথচ এমন একটি তীর ঐ কাফেরের কপাল বরাবর মেরে দেন। কাফের লোকটি সাথে সাথে জমিনে লুটে পড়ল। চলে গেল সোজা জাহান্নামে। নবীজি (সা.) তাঁর এই তীরন্দাজি দেখে হেসে ফেললেন। এমনকি তাঁর দাঁত দেখা গিয়েছে।

উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া, খায়বারসহ সব যুদ্ধেই তিনি বিরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের পরেও হুনায়ন যুদ্ধে রেখেছেন কঠিন ভূমিকা।

তায়েফ এবং তাবুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। হজরত ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে ঐতিহাসিক কাদেসিয়ার যুদ্ধেও পালন করেন সেনাপতির দায়িত্ব। দশম হিজরিতে নবীজি (সা.) বিদায় হজ্বের ইচ্ছা করলে তিনিও নবীজির সঙ্গী হন। কিন্তু মক্কায় গিয়ে তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন।

মদিনার প্রতি হজরত সা‘দ (রা.) এর এত ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল যে, মক্কাতে মৃত্যুবরণ করাও ছিল অপছন্দের। অসুস্থতা যতই বাড়ছিল ততই বাড়ছিল তাঁর পেরেশানিও। রাসূল (সা.) তাঁর এই পেরেশানি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে তোমার? তিনি আরজ করলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মহব্বতে যে দেশ ত্যাগ করেছিলাম, সেখানেই আবার মৃত্যু হয়ে যায় কিনা! নবীজি (সা.) তাকে সান্ত¦না দিলেন এবং তার কপালে হাত রাখলেন। এরপর হাতের স্পর্শ মুখমÐলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আর এভাবে তার জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সা‘দকে সুস্থ করে দাও! হে আল্লাহ! তুমি সা‘দকে সুস্থ করে দাও! তার হিজরতকে পূর্ণতা দাও এবং তাঁর হিজরতের স্থান মদিনাতেই তাঁর মৃত্যু দাও।’

রাসূলের দোয়া পেয়ে সুস্থ হয়ে গেলেন সা‘দ। সাথে সাথে নবীজি (সা.) তাঁকে এই সুসংবাদও দিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার থেকে এক কওমের উপকার এবং অপর আরেক কওমের ক্ষতি না হবে, ততক্ষণ তুমি মৃত্যুবরণ করবে না। রাসূলের এই ভবিষ্যদ্বাণী অনারবদের দেশগুলো বিজয়ের মাধ্যমে পুরা হয়েছে। যে যুদ্ধগুলোতে অনারব দেশগুলো তাঁর হাতে পরজয় বরণ করেছ এবং আরব জাতিগুলো তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছে।
পারিবারিকভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি বিয়ে করেছেন। বিবিগণ হলেন- ১. বিনতুশ শিহাব ২. বিনতে কায়স ইবনে মা‘দিকারিব ৩. উম্মে আমের বিনতে আমর ৪. যায়েদ ৫. উম্মে বেলাল বিনতে রবি‘ ৬. উম্মে হাকিম বিনতে কারিয ৭. গালমা বিনতে হাফস ৮. যায়্যা বিনতে আমের ৯. উম্মে হাজার।

তাঁর ৩৪ জন সন্তান ছিল। তন্মধ্যে ১৭জন হলো ছেলে এবং ১৭জন মেয়ে। ছেলেরা হলেন- ১. ইসহাক আকবর ২. উমর ৩. মুহাম্মদ ৪. আমের ৫. ইসহাক আসগর ৬. ইসমাঈল ৭. ইবরাহিম ৮. মুসা ৯. আবদুল্লাহ ১০. আবদুল্লাহ আসগর ১১. আবদুর রহমান ১২. উমাইর আকবর ১৩. উমাইর আসগর ১৪. আমর ১৫. ইমরান ১৬. সালেহ ১৭. উসমান।

মেয়েরা হলেন- ১. উম্মুল হাকিম কুবরা ২. হাফসা ৩. উম্মুল কসম ৪. কুলসুম ৫. উম্মে ইমরান ৬. উম্মুল হাকিম সুগরা ৭. উম্মে আমর ৮. হিন্দ ৯. উম্মুয যুবাইর ১০. উম্মে মুসা ১১. হামনা ১২. উম্মে উমর ১৩. উম্মে আইয়ুব ১৪. উম্মে ইসহাক ১৫. মিল্লা ১৬. আমরাহ ১৭. আয়েশা।

তথ্যসূত্র : মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল; সহিহ বোখারি; সহিহ মুসলিম; উসদুল গাবাহ; ইবনে সা‘দ তৃতীয় খÐ; সিরাতে ইবনে হিশাম; ফাতহুল বারী; তবাকাতে ইবনে সা‘দ; তাফসিরে তাবারি; ইবনে আসির; ইস্তিআব ২য় খণ্ড। রাসূলের বিশিষ্ট এই সাহাবি ৫৫ হিজরিতে (৬৭৩ খ্রিস্টাব্দ) মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ