মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ খোদায়ী বিধান ও ঈমানদার বান্দাদের জন্য অনেক বড় ইবাদত। কোরবানি ইসলাম ও মুসলমানের মর্যাদা। আল্লাহতায়ালার অনেক প্রিয় ও পছন্দনীয়। কোরবানি ঐ আমল যার মাধ্যমে বান্দা সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করে। মর্যাদা ও মাহাত্মের কারণে একে নামাজের সাথে সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সূরা কাউসার, আয়াত : ২) প্রসিদ্ধ তাফসির অনুযায়ী এখানে নামাজ দ্বারা ঈদুল আজহার নামাজ উদ্দেশ্যে।
বিষয়টির গুরুত্ব হেতু এর বিধানগুলো জানা আমাদের একান্ত কর্তব্য। এ ধরনের কয়েকটি মাসয়ালা নিয়ে আজকের আলোচনা।
কোরবানির পশু জবাই করার পদ্ধতি: কোরবানির পশু জবাই করার সময় পশুকে কেবলামুখী করে শুইয়ে দেবে। তারপর এই দোয়া পড়বে : ‘ইন্নি ওয়াজজাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়া আনা মিনাল মুশরিকিন, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, লা শারিকা লাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা।’
তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করবে। কোরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া পড়া আবশ্যক নয়। যদি অন্তরে নিয়ত করে নেয়, আমি কোরবানি করছি এবং মুখে কিছু না বলে শুধু বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করে, তাহলেও কোরবানি হয়ে যাবে। যদি মনে থাকে, তাহলে ওপরে উল্লেখিত দোয়াটি পড়া উত্তম।
জবাইয়ের মধ্যে রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরি। জবাইয়ে পশুর চারটি রগের (শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও দুটি রক্তনালী) মধ্য থেকে যেকোনো তিনটি কাটা আবশ্যক। চারটি কাটাই উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক ৮/১৯৩) প্রিয় নবী (সা.) বলেন, যা রক্ত প্রবাহিত করে, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তা তোমরা খাও। তবে যেন (জবাই করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়।’ (মুসনাদে আহমদ)
জবাইকারীর সঙ্গে আরো কেউ ছুরিতে ধরায় অংশগ্রহণ করলে উভয়েই বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করতে হবে। ইচ্ছাকৃত কেউ বিসমিল্লাহ ছেড়ে দিলে পশু হালাল হবে না। তবে ভুলবশত কোনো সমস্যা নেই। (আল বাহরুর রায়েক ৮/১৯৩)
কোরবানির পশু যেহেতু আল্লাহর শিয়ার (নিদর্শন) এজন্য এর প্রতি যত্ন নেওয়া একান্ত কর্তব্য। জবাইয়ের পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা কোনো অঙ্গ কাটা মাকরুহ। জবাইয়ের সময় কম কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতিপ্রসূত।’(সূরা হজ, আয়াত : সূরা হজ, আয়াত : ৩২)
ইসলামী বিধানে পশুর সকল অধিকার সংরক্ষণ করে জবাইয়ের সময় তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ বর্জন করে ইহসান করতে বলা হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত শাদ্দাদ ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহতায়ালা সকল বস্তুর ওপর ইহসান ফরজ করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন উত্তম পন্থায় হত্যা করবে আর যখন জবাই করবে, তখন উত্তম পন্থায় জবাই করবে। আর তোমাদের প্রত্যেকেরই ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া উচিত এবং জবাইকৃত জন্তুকে ঠাণ্ডা হতে দেওয়া উচিত।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৪১১)
পশু-পাখি জীবিত থাকাবস্থায় তার কোনো অঙ্গ কর্তন করা যাবে না। এ মর্মে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয়, সেটা মৃত তথা হারাম হয়ে যাবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৪৮০) এমনিভাবে এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৫/৮০)
কোরবানির পশু কে জবাই করবে?
নিজের কোরবানি নিজের হাতে করা উত্তম। যদি নিজে জবাই করতে না জানে, তাহলে অন্য কারো মাধ্যমে জবাই করিয়ে নেবে। এক্ষেত্রে জবাইয়ের সময় পশুর সামনে দাঁড়ানো উত্তম। যদি কোনো নারীর নামে কোরবানি করা হয়, সে পর্দার কারণে সামনে এস দাঁড়াতে না পারলেও সমস্যা নেই। (মুসনাদে আহমদ : ২২৬৫৭)
কোরবানির পশু জবাই করে বিনিময় নেওয়া যাবে?
হাঁ, কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। এটা জবাইকারীর হক। তবে জবাইকারীকে বা জবাইয়ের সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে বা তরকারি দেওয়া যাবে। (কিফায়াতুল মুফতি ৮/২৬৫) পশুতে অংশীধার কেউ জবাই করে অন্য শরিকদের থেকে জবাইয়ের পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নেই। (আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫১৮)
সময়ের পর জবাই করলে: কোরবানির দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১)
তাই আসুন, ইসলামের বিধানুনাযায়ী পশু কোরবানি করে আল্লাহর একত্ববাদ ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করি এবং মহান ইবাদতের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করি।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ
ওআই/আব্দুল্লাহ আফফান