বেলায়েত হুসাইন ।।
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট>
কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসলেই এ সংক্রান্ত বিভিন্ন মাসয়ালার পাশাপাশি- একইসঙ্গে আরো যে বিষয়টি নিয়ে সমাজে আলোচনা সৃষ্টি হয়- সেটি হলো, আকিকা। আকিকা আদায়ের মাসনুন সময় থাকলেও নানা কারণে অবিভাবকরা সেটি করেননা- ফলে ঈদুল আজহার সময়েই আমাদের সমাজে আকিকার আলোচনা ওঠে। প্রসঙ্গতভাবেই তখন প্রশ্ন ওঠে আকিকার নিয়ম-কানুন নিয়ে।
তো আকিকা সংক্রান্ত আলোচিত তিনটি প্রশ্ন নিয়ে আজকের প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে। প্রশ্ন তিনটির সমাধান দিয়েছেন দেশের বিজ্ঞ তিন আলেম।
চট্টগ্রামের জামিয়া মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারির মুহাদ্দিস ও একাধিক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলি নিজামপুরি এর নিকট জানতে চেয়েছিলাম- বকরি ভেড়া দুম্বা দিয়ে আকিকা দেয়ার বিষয়টি কমবেশি সবাই জানি কিন্তু জনমনে সবচেয়ে যে প্রশ্নটি বেশি ঘুরপাক খায়- সেটি হলো, বড় একইপশুতে (গরু, উট, মহিষ) একত্রে কোরবানি ও আকিকা বৈধ কিনা?
তিনি জানিয়েছেন, কোরবানি ও আকিকা আলাদাভাবেই করা উচিৎ। তবে একত্রে করলে আদায় হবে না তা নয়। একত্রে করলেও কোরবানী-আকিকা দুটোই আদায় হবে। কারণ আকিকাও এক ধরনের কোরবানি। হাদীস শরীফে আকিকার ওপরও ‘নুসুক’ শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। আর এখানে ‘নুসুক’ অর্থ কোরবানি। হাদীসের আরবী পাঠ এই:
سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن العقيقة، فقال : لا أحب العقوق كأنه كره الاسم، قالوا يا رسول الله! نسألك عن أحدنا يولد له، فقال من أحب منكم أن ينسك عن ولده فليفعل، على الغلام شاتان مكافأتان، وعلى الجارية شاة. (আবু দাউদ আকীকা অধ্যায় ২৮৪২)
সুতরাং আকিকাও যখন এক প্রকারের কোরবানি তখন একটি গরু বা উট দ্বারা একাধিক ব্যক্তির (সাত জন পর্যন্ত) আলাদা-আলাদা কোরবানি আদায় হওয়ার হাদিসগুলো থেকে কোরবানি-আকিকা একত্রে আদায়ের অবকাশও প্রমাণিত হয়। এটা শরীয়তের পক্ষ হতে প্রশস্ততা যে, গরু বা উটের ক্ষেত্রে একটি‘জবাই’ সাত জনের সাতটি জবাইয়ের স্থালাভিষিক্ত গণ্য হয়। একারণে একটি উট বা গরু সাতজনের পক্ষে যথেষ্ট হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির সমাধান জানতে চেয়েছিলাম রাজধানীর উত্তরার স্বনামধন্য দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালামের শিক্ষাসচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি মানসুর আহমাদ এর নিকট। প্রশ্নটি ছিল- আকিকার ক্ষেত্রে ছেলের জন্য দুইটি বকরি ও মেয়ের জন্য একটি, কিন্তু যদি গরু কিংবা সাতভাগী পশুতে আকিকা দেয়া হয় তাহলেও কি ছেলের দুইভাগ এবং মেয়ের একভাগ- এই নিয়ম মানতে হবে?
শিক্ষাবিদ এই আলেম জানান, আকিকার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হচ্ছে ছেলের জন্যে দু'টি ছাগল এবং মেয়ের জন্যে একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করা। সামর্থ না থাকলে ছেলের ক্ষেত্রেও একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করা যায়। এতে সমস্যার কিছু নেই। (সুনানে নাসায়ি: ৪২১২; সুনানে আবু দাউদ: ২৮৪৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ২৪৭৩১)
শরিয়তের বিধান অনুযায়ী "নুসুক" অর্থাৎ কোরবানি- আকিকা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি গরু সাতটি ছাগলের সমান। এই হিসাবে কেউ যদি কোরবানির গরুতে আকিকার অংশ নিতে চায় তাহলে সামর্থবান হলে ছেলের জন্যে দুই অংশ নেয়া উত্তম হবে। অক্ষম হলে এক অংশ নিলেও চলবে। (فى فتح البارى : ٩/٦٧٨
و الجمهور على إجزاء الإبل والبقر أيضا و فيه حديث عند الطبرانى وأبى الشيخ عن أنس رفعه: يعق عنه من الإبل والبقر والغنم و نص أحمد على اشتراط كاملة وذكر الرافعى بحثا أنها تتأدى بالسبع كما فى الأضحية. وفى بدائع الصنائع : ٥/٧٠ لأن البقرة بمنزلة سبع شياه.
মনে রাখতে হবে- কোরবানির জন্তুতে আকিকার অংশ নেয়া কেবল জায়েয, উত্তম নয়। উত্তম হচ্ছে আকিকা স্বতন্ত্রভাবে করা এবং সন্তান জন্মের সপ্তম দিনে করা। ওইদিন না পারলে চৌদ্দতম দিনে করা। তাতেও অপারগ হলে একুশতম দিনে করা। ওজর থাকলেই কেবল বিলম্ব করা যেতে পারে।
তৃতীয় প্রশ্নটি ছিলো- আকিকার গোশত খাওয়া ও বিতরণের কি বিধান? এর সমাধান দিয়েছেন রাজধানীর মিরপুরস্থ উচ্চতর ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ- ঢাকার পরিচালক ও ঐতিহ্যবাহী লালমাটিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমি।
তিনি বলেছেন, স্বাভাবিকভাবে আকিকা করা মুস্তাহাব। সাধারণ আকিকার পশুর ব্যবহার ঠিক কোরবানির পশুর মতই। ফলে তা তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক ভাগ পরিবার, এক ভাগ সাদাকা ও এক ভাগ হাদিয়ার জন্য। ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘মুস্তাহাব হলো আকিকার গোশত নিজেরা খাওয়া, গরিবদের মাঝে দান করা এবং বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে হাদিয়া পাঠানো। যেমন কোরবানির ক্ষেত্রে করা হয়’-(আল-মাজমু' শরহুল মুহাযযাব:৮/৫৩৬)।
তাছাড়া, আকিকার পশুর গোশত আকিকাদাতা স্বয়ং, যার জন্য আকিকা সে নিজে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই আহার করতে পারবেন। কাঁচা গোশত হাদিয়া দিতে পারবেন অথবা রান্না করেও খাওয়াতে পারবেন-(ই'লাউস সুনান:১৭/১২৬,ফতোয়ায়ে শামি:৫/২৩৬)।
-এটি