মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
পবিত্র কোরআনের সূরা আদিয়াত এর প্রথম পাঁচটি আয়াতে মহান আল্লাহ স্থলজ প্রাণী ঘোড়ার কতিপয় অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং শপথ করে বলেছেন যে, মানুষ পালনকর্তার প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ। পক্ষান্তরে ঘোড়া মনিবের কত কৃতজ্ঞ! সে নিজের জীবন বিপন্ন করে কত কঠোর খেদমতই না আনজাম দিয়ে থাকে। বিশেষত যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া কত ত্যাগ-তিতীক্ষা শিকার করে।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘শপথ ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান ঘোড়াসমূহের, অতঃপর ক্ষুরাঘাতে অগ্নি বিচ্ছুরক ঘোড়াসমূহের, অতঃপর ভোরবেলায় আক্রমণকারী ঘোড়াসমূহের, যারা সে সময় ধূলি উৎক্ষেপন করে, অতঃপর যারা শত্রæদলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে।’ (সূরা আদিয়াত : আয়াত : ১-৫)
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে অসংখ্য নেয়ামত মানুষের জন্য রেখেছেন। তন্মধ্যে একটি নেয়ামত হলো ঘোড়া। অনেক দামি প্রাণী এটি। হাজার বছর যাবত এই ঘোড়া মানুষের সঙ্গী হয়ে আছে। ঘোড়াকে সম্ভ্রান্ত জীব বলা হয়ে থাকে। যে কোনো স্থানে পৌঁছে দিতে ঘোড়া মানুষের সহযোগিতা করে আসছে। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ঘোড়ার কদর কমে যায়নি।
ঘোড়া অনেক বিস্ময়কর প্রাণী। জন্মের একঘণ্টা পরই ঘোড়া দৌঁড়াতে পারে। পৃথিবীতে ৩০০ জাতেরও বেশি ঘোড়া আছে। ঘোড়া দাঁড়িয়ে ও শুয়ে উভয়ভাবে ঘুমাতে পারে। কারণ, তার দেহের কাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, পা মুড়ে বসতে পারে না। তার পা মুড়ে বসার প্রয়োজনও হয় না। আর এতে ঘোড়ার কোনো কষ্ট বা ক্ষতিও হয় না।
জেনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, ঘোড়ার শরীরে সাধারণত ২০৫টি হাড় থাকে। মানুষ আর ঘোড়ার ছাঁচে গলার নিচের হাড়টি শুধুমাত্র পার্থক্য। ঘোড়ার মধ্যে এই হাড়টি থাকে না।
ঘোড়াকে পৃথিবীর চতুর্থ পছন্দনীয় পশু হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ঘোড়ার দাঁত দেখেই স্ত্রী ও পুরুষ ঘোড়া শনাক্ত করা যায়। পুরুষ ঘোড়ার ৪০টি দাঁত থাকে এবং স্ত্রী ঘোড়ার থাকে ৩৬টি।
অনেকগুলো ঘোড়া একসাথে কখনোই শুয়ে থাকে না। অন্তত একজন সজাগ থাকে আর সঙ্গীদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে। ঘোড়ার দৃষ্টিশক্তি অনেক প্রখর। রাতে মানুষের চেয়ে ভালো দেখে। তবে আলো থেকে অন্ধকারে বা অন্ধকার থেকে আলোতে অ্যাডজাস্ট করতে মানুষের চেয়ে ঘোড়ার বেশি সময় লাগে। ঘোড়া দৈনিক ২৫ গ্যালন পানি পান করে। গরমের সময় আরো বেশি পান করে।
ঘোড়া সামাজিক প্রাণী তাই একা থাকলে নিঃসঙ্গ অনুভব করে এবং সঙ্গীর মৃত্যুতে শোকগ্রস্থ হয়।
ঘোড়ার প্রশিক্ষণ
রাসূল (সা.) নিজে ঘোড়ার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) হাফইয়া থেকে সানিয়্যাতুল বিদা পর্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়াসমূহের এবং সানিয়্যা থেকে বনী যুরাইকের মসজিদ পর্যন্ত প্রশিক্ষণবিহীন ঘোড়াসমূহের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করিয়েছেন। ইবনে ওমর (রা.) ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯১)
ঘোড়া পোষার ফজিলত
ঘোড়া পোষার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে এবং এর কপালের লম্বা চুলের মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯৩) এখানে ঘোড়ার কপালের লম্বা চুল বলে ঘোড়াকেই বুঝানো হয়েছে। ঘোড়াই ছিল তৎকালীন যুদ্ধের প্রধান বাহন। ঘোড়ার সংখ্যা ও শক্তিই যুদ্ধক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের মুখ্য বিষয় ছিল।
জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে নিজের আঙ্গুল দিয়ে একটি ঘোড়ার কপালের চুল মুড়াতে দেখেছি। আর তিনি বলেছেন, ঘোড়ার কপালের লম্বা চুলে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ দান করা হয়েছে। জিহাদের জন্য লালন-পালনের সওয়াব এবং গণীমত লাভ এর অন্তর্ভুক্ত।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬৯৫)
জান্নাতেও ঘোড়ায় চড়া যাবে একবার এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জান্নাতে কি ঘোড়া থাকবে? রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ যদি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান তাহলে এতে লাল ইয়াকুত পাথরের যে ঘোড়ায় চড়তে চাও, সে তোমাকে নিয়ে জান্নাতের যেখানে যেতে চাও সেখানে উড়ে নিয়ে যাবে।
উত্তম ঘোড়া
হজরত আবু কাতাদা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, উত্তম ঘোড়া হলো যার রং কালো। যার কপাল ও নাকের কাছে অল্প শুভ্রতা আছে। অতঃপর ঐ ঘোড়া উত্তম যার ডান হাত ছাড়া হাত-পা ও কপাল সাদা। অতঃপর যদি কালো রঙের না হয় তাহলে ঐ গুণবিশিষ্ট কালোর দিকে ধাবমান লাল ঘোড়া উত্তম। যার কান কালো সেটাও এর মতো।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৬৯৬)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)ও নবীজি (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘লাল রঙের ঘোড়ার মধ্যে বরকত আছে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৪৫)
মুসলমান হিসাবে আমাদের ঘোড়ায় আরোহন বিদ্যা শেখা, ঘোড়া লালন-পালন করার আগ্রহ থাকা উচিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে-এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রæকে, তোমাদের শত্রæকে এবং এতদ্বতীত অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা ব্যয় করবে এর পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সূরা আনফাল, আয়াত : ৬০)
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, ৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ সদর, নারায়ণগঞ্জ।