রিদওয়ান হাসান।।
বাংলাদেশ মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমীর মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিযাহুল্লাহর মতো একজন মহীরুহের মূল্যায়ন সহজ কাজ নয়। আকাবেরদের আল্লাহ তাআলা এমন বহুমুখী গুণে ভরে রাখেন যে, পর্যবেক্ষণ যত বাড়ে, কামালাতের নতুন সব দিগন্ত ততই খুলতে থাকে।
মুহিউস সুন্নাহ হযরতকে যারা কাছে থেকে দেখে, তারা জানে অন্যদের থেকে তিনি কতটা আলাদা। তার ব্যক্তিত্বে এমন কিছু স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যেগুলোতে সালাফের স্মৃতি জেগে ওঠে। প্রত্যেক বুজুর্গের কিছু একান্ত বৈশিষ্ট্য থাকে, যা অহরহ অন্যদের মধ্যে দেখা যায় না। এই পোস্টে মুহিউস সুন্নাহ হযরতের ব্যতিক্রমী কয়েকটি গুণবৈশিষ্ট্যের কথাই তুলে ধরতে চাচ্ছি।
১. ইহতিয়াত
দ্বীনি বিষয়ে ইহতিয়াত বা সতর্কতা একটি প্রশংসনীয় গুণ। হাদিস শরিফে সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। ‘দা- মা ইয়ারিবুকা ইলা মা লা ইয়ারিবুকা’- তিরমিজি শরিফের এই হাদিস বেশ প্রসিদ্ধ। সাহাবায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের জীবনে ইহতিয়াতের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়।
মুহিউস সুন্নাহ হযরতের মধ্যে ইহতিয়াতের গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তিনি মাদরাসার যে কামরাটিতে থাকেন, মাসে মাসে তার ভাড়া মাদরাসার ফান্ডে জমা দেন। মাদরাসায় থাকাকালে সাধারণত তিনি ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় বাইরে থেকে আনা খাবার খান। তবে প্রায়ই মেহমান থাকে বলে মাদরাসার বোর্ডিং থেকেও একটি খাবার জারি রেখেছেন, তার মূল্যও তিনি নিয়মিত পরিশোধ করেন।
সাধারণত মাদরাসাগুলোতে চুক্তিভিত্তিক বেতনপদ্ধতি চালু থাকলেও মুহিউস সুন্নাহ হযরত মনে করেন, দ্বীনি কাজের বেতন শ্রমভিত্তিক হওয়া উচিত। দ্বীনি কাজের বিনিময় নেয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে যে মতভেদ রয়েছে, তার আওতা থেকে বাঁচতেই মূলত এই সতর্কতা। তাই অন্যান্য মাদরাসার মতো তার মাদরাসায় উস্তাদদের মাসিক ছুটির বরাদ্দ নেই। কেউ একদিন অনুপস্থিত থাকলেও বেতন কাটা যাবে। ওদিকে উস্তাদদের প্রয়োজন বিবেচনা করে তিনি বেতনে কিছু অতিরিক্ত অংক ধরে রেখেছেন, যাতে দুয়েকদিনের অনুপস্থিতির কর্তন ওই অতিরিক্ত থেকেই হয়ে যায়। এভাবে ইহতিয়াত ও উস্তাদদের প্রয়োজনের সুন্দর সমন্বয় করেছেন তিনি।
মাদরাসার জন্য অনুদান গ্রহণেও তিনি অত্যন্ত সতর্ক। যদি বুঝতে পারেন, কেউ প্রভাব-বিস্তার বা এমন কোনো দুরভিসন্ধি থেকে মাদরাসায় দান করতে চাচ্ছে কিংবা তার দান গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা হতে পারে, তাহলে ওই দান তিনি গ্রহণ করেন না। এজন্যই সরকারি এতিম ফান্ড বা বিদেশি সংস্থার দান গ্রহণ করেন না তিনি।
শরয়ী মাসায়েলের ব্যাপারে তিনি আপসহীনতার প্রতিমূর্তি। ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা নিয়ে নানা মত এবং ওলামায়ে কেরামের একাংশের এ নিয়ে শিথিলতা থাকলেও তিনি ছবির হুরমতের ব্যাপারে অটল। সাংবাদিকের ছবি তোলার আশংকায় অনেক প্রয়োজনীয় সভা বা বৈঠকও তার বর্জন করতে হয়। ছবির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে তিনি বাংলা ও আরবি উভয় ভাষায় কিতাব লিখেছেন। ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়েও তিনি কঠোর। প্রচলিত ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ব্যাপক জোয়ার সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, শতভাগ ইসলামি শরিয়া তাতে অনুসৃত হয় না। তাঁর এই সাবধানী অবস্থানের সঙ্গে অন্যান্য মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম একমত হয়েছেন।
দাওয়াতুল হকের কাজে বা বিভিন্ন দ্বীনি প্রোগ্রামে সারাদেশে মুহিউস সুন্নাহ হযরতের সফর করতে হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, তিনি কোথাও বয়ান করে টাকা-পয়সা নেন না। এমনকি আয়োজকদের খাবারের দাওয়াতও কবুল করেন না।
২. গায়রত
দ্বীনের ব্যাপারে গায়রত বা আত্মমর্যাদাবোধ ইসলামের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় একটি গুণ। মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, ‘মুমিন আত্মমর্যাদাবোধ-সম্পন্ন হয়।’ মুহিউস সুন্নাহ হযরতের মধ্যে গায়রতের যথেষ্ট উপস্থিতি দেখা যায়। সবকাজেই তিনি আলেমানা গাম্ভীর্য ও আত্মমর্যাদাবোধ বজায় রাখেন। দেখা যায়, তার সঙ্গে দেখা করতে সমাজের নানাশ্রেণীর গণ্যমান্য মানুষ নিজেরাই ছুটে আসে তার দরবারে। একান্ত প্রয়োজন বা হেকমত ছাড়া তিনি কারও বাসায় যান না।
মুহিউস সুন্নাহ হযরত যার-তার সঙ্গে বসে গল্পগুজব করেন না। যেখানে-সেখানে দাঁড়ান না। মাদরাসায় নিজের কামরা, মসজিদ ও দরসগাহ ছাড়া অন্য কোথাও তাকে দেখা যায় না। এক আশ্চর্য শ্রদ্ধাজাগানিয়া ভাব চেহারায় ফুটে থাকে সবসময়। সবাই তার কাছে যেতে সাহস পায় না।
আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তিনি কখনোই মাদরাসার জন্য কালেকশন করেন না। ‘আপনারা যে যা পারেন, মাদরাসা-মসজিদে সাহায্য করেন’-এমন কথা কোনোদিন শোনা যায়নি তার মুখে। কোনো প্রয়োজন মানুষের কাছে না বলে সরাসরি আল্লাহর কাছে বলতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। শুধু নিজের ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিক ওলামায়ে কেরামের মর্যাদাহানি হয় বা কেউ তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পায়, এমন কাজ তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেন।
৩. তায়াক্কুয
বলা হয়ে থাকে, ‘যে নিজের যুগ সম্পর্কে অবগত নয়, সে জাহেল।’ সচেতনতা ও চিন্তাশীলতা ওলামায়ে কেরামের একটি অপরিহার্য গুণ। এই গুণটি মুহিউস সুন্নাহ হযরতের মধ্যে এত অধিকমাত্রায় বিদ্যমান যে, তুলনা মেলা কঠিন। সমকালীন বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তার সুস্পষ্ট ও দূরদর্শী চিন্তাধারা রয়েছে। নানা মত ও পথের রাজনীতিকরা প্রায়ই তার কাছে আসেন পরামর্শের জন্য। মুসলিম বিশ্বের ভালোমন্দ নিয়ে মুহিউস সুন্নাহ হযরত প্রচুর ভাবেন। ভাবেন দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও। ‘বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয়’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছেন ইতোমধ্যে।
নিজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তার কাছে পরিষ্কার। ইলম, ওলামায়ে কেরাম ও তালেবে ইলমদের বিষয়ে সুস্পষ্ট চিন্তাধারা রয়েছে তার। ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে তার নসিহত শুনলে একজন আলেমের হিম্মত অনেকখানি বেড়ে যায়। চোখে নতুন স্বপ্ন ভাসে। ছাত্ররাও তার সুচিন্তিত উপদেশ শুনলে মুগ্ধ হয়। মুহিউস সুন্নাহ হযরতের ফিকর অত্যন্ত উন্নত। হীনম্মন্যতা, হতাশাবোধ বা স্থবিরতা তার মধ্যে নেই।
৪. শাগাফে ইলম
শাগাফে ইলম বা ইলমি নিমগ্নতা আলেমের সবচেয়ে বড় শোভা। মুহিউস সুন্নাহ হযরতের শাগাফে ইলম অতুলনীয়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইলম ও কিতাবের ‘পোকা’। পাকিস্তানের নিউটাউনে পড়াকালে উস্তাদরা, বিশেষ করে খাস উস্তাদ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রহ. তার মুতালায়ার ঝোঁক দেখে মুগ্ধ হতেন। কত অসংখ্য কিতাব যে তিনি মুতালায়া করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। শুধু মুতালায়াই নয়, কিতাব-সংগ্রহেও তার ঝোঁক রয়েছে সেই শুরুকাল থেকেই। নিজ টাকায় শত শত কিতাব কিনেছেন। যাত্রবাড়ি মাদরাসার উলুমুল হাদিস বিভাগ চালু হওয়ার সময় হযরতের নিজস্ব কিতাবগুলো ছিল মূল ভরসা। তাহলে বুঝুন, একজন ব্যক্তির কিতাবে চালু হয়েছে একটি উচ্চতর বিভাগ! বহু দূর্লভ ও প্রাচীন-ছাপা কিতাবের শুরুতে হযরতের স্বহস্তে লেখা নাম দেখে ছাত্ররা চমকে যায়।
এই বিস্তৃত অধ্যয়নের ফলে বহু দূর্লভ বিষয়বস্তু হাওয়ালাসহ তার স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে। তিনি যখন আলোচনার মাঝে মাঝে ওইসব হাওয়ালা দেন, নাদের কোনো কিতাব থেকে যখন জরুরি বিষয় তুলে আনেন, শ্রোতারা বিস্মিত না হয়ে পারে না।
মুতালায়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ইলমি বিষয়ে নিজেও ভাবেন। নতুন কোনো তাওজিহ বা নুকতা উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। হাদিসের শরাহর ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী শারিহীনের কথার পর নতুন কিছু হতে পারে কি না- ভেবে দেখেন। এগুলো সবই তার ইলমি শাগাফের অংশ। হযরতের উদ্ভাবিত নতুন তাওজিহাত সংকলিত হলে সবাই উপকৃত হবে।
ইলমি নিমগ্নতা তার অত্যন্ত প্রিয়। ইলমের ক্ষতি হবে বিবেচনায় তিনি রাজনীতিতেও যোগদান করেননি। নিজ মাদরাসায় দেন নি কোনো সাংগঠনিক তৎপরতার অনুমতি। বহির্গত কর্মকাণ্ডে মাদরাসার সবকের ক্ষতি হবে- এটা তার চরম অপছন্দ।
৫. পাবন্দিয়ে নেযাম
মুহিউস সুন্নাহ হযরত শৃঙ্খলা খুব পছন্দ করেন। রুটিনমতো কাজ করার অভ্যাস তার মজ্জাগত। সময় নষ্ট করা যেন তার স্বভাবেই নেই। তার কামরায় গেলে দেখা যায়, মুতালায়া, লেখালেখি বা কাউকে সাক্ষাৎদান- কিছু একটা অবশ্যই করছেন। এমনি বসে থাকতে বা অনর্থক কাজে সময় খরচ করতে তাকে কখনও দেখা যায় না।
রুটিনমতো প্রতিদিন প্রায় একই সময় তিনি মাদরাসায় আসেন। কোনো প্রোগ্রাম বা জরুরত না থাকলে বাদ ইশা বাসায় ফেরেন। এই সারাদিনের নির্দিষ্ট রুটিন রয়েছে তার। দরস, মুতালায়া, লেখালেখি, মাদরাসার পরিচালনা-সংক্রান্ত দায়িত্ব, সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎ প্রদান, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত পরামর্শকামনা-মূলক বা তরবিয়তি চিঠিপত্রের জবাবদান ইত্যাদি কাজে তার সময় কাটে। প্রত্যেক কাজের রয়েছে নির্ধারিত সময়।
মাদরাসার অন্যান্য কাজে নেযামের ব্যত্যয় দেখলেও তিনি নাখোশ হন। সবাইকে নেযামের প্রতি যত্নবান হতে আদেশ দেন। মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে তিনি পারতেন যখন খুশি মাদরাসায় আসতে, যখন খুশি যেতে বা ইচ্ছে হলে কোনোদিন সবক না পড়াতে। কিন্তু নেজাম যার স্বভাবগত, তিনি কি পারেন, ক্ষমতার জোরে অনিয়ম করতে! তার সুশৃঙ্খল ও সময়ানুবর্তী কাজ, নিয়মিত সবকপ্রদান, মাদরাসায় পূর্ণসময় বরং তার চেয়েও বেশি অবস্থান ইত্যাদি দেখে মনে হবে, যেন তিনি মুহতামিম নন, অন্য কারও অধীনে দায়িত্ব পালন করছেন!
৬. শওকে ইসলাহ
আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে মুহিউস সুন্নাহ হযরত একেবারেই আপসহীন। উম্মতের ইসলাহের ফিকিরে তিনি পুরো জীবনই উৎসর্গ করে দিয়েছেন। তার তরবিয়তি কার্যক্রম মজলিসে দাওয়াতুল হকের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রসারিত হয়েছে। মানুষের ওজু-নামাজ, আজান-ইকামত, সালাম-মুসাফাহা, কাফন-দাফন- এসবের ইসলাহে তিনি অক্লান্ত মেহনত করে যাচ্ছেন।
তার ইসলাহের আরেকটি বড় ময়দান তাযকিয়ার জগত। দেশ-বিদেশের হাজার-হাজার আলেম ও তালেবে ইলম তার হাতে বাইয়াত অথবা তার পরামর্শ মেনে চলেন। প্রতিদিন তার বহু ইসলাহি চিঠির জবাব দিতে হয়। মুতায়াল্লিকীনের প্রতি মুহিউস সুন্নাহ হযরতের শফকত অতুলনীয়। তার মূল্যবান দিক-নির্দেশনায় অনেকের জীবনের মোড় ঘুরেছে, অনেকের জীবন হয়েছে সার্থক। মুহিউস সুন্নাহ হযরত নিয়মিত ওলামা-তলাবার বিভিন্ন মজলিসে বয়ান করেন। এসব বয়ানে তাদের জন্য জরুরি হেদায়াত থাকে। এভাবে দেশের ইলমি জগতে তার মুসলিহানা কর্মকাণ্ডের বিরাট প্রভাব গড়ে উঠেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন ওলামায়ে কেরামের অন্যতম প্রধান মুসলিহ, বর্তমান বিশ্বের ইসলাহে উম্মতের অন্যতম রাহবার।
মুহিউস সুন্নাহ হযরতের তরবিয়তের ক্ষেত্র এত বিস্তৃত যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা ও শিল্পপতিরাও তার আওতাভুক্ত। গুলশানের জুমার বয়ানে তিনি এই শ্রেণির ইসলাহের যথাসাধ্য প্রয়াস চালান। তাদের অনেকে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগও রাখেন। হযরতের বরকতময় সোহবতে অনেকেই ধীরে ধীরে দ্বীনদার হয়ে যান।
আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের ক্ষেত্রে মুহিউস সুন্নাহ হযরত কারও পরোয়া করেন না। তিনি তখন টিকাটুলি জামে মসজিদের ইমাম। এরশাদের আমল। একবার এরশাদ সাহেব তার মসজিদে যান। সঙ্গে ক্যামেরা হাতে সাংবাদিক। ছবির ব্যাপারে হযরত সবসময়ই কঠোর। শোনা যায়, ওই সাংবাদিক ছবি তুলতে নিবৃত না হওয়ায় তিনি তার ক্যামেরা ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সামনে তার এই সাহসী পদক্ষেপে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
তখনকার টিকাটুলির এক মুসল্লির মুখে শুনেছি, একবার এরশাদ সাহেব ওই মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। হযরত তাকে বললেন, ‘কোন বিষয়ে বলতে চান? দুনিয়ার বিষয়ে না আখেরাতের? দুনিয়ার বিষয় হলে মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা জায়েয নেই।’
বিভিন্ন মাদরাসা বা ওয়াজ-মাহফিলে যখন তাশরিফ রাখেন, সেখানে কোনো উসুলবিরোধী কাজ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তাম্বীহ করেন। ফলে তার আগমন উপলক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের বেশ হুশিয়ার থাকতে হয়। মুহিউস সুন্নাহ হযরতের অনেক কিংবদন্তিতুল্য সাহসী উচ্চারণ দীর্ঘদিন মানুষের মতে জাগরূক থাকবে।
৭. কুওয়তে বয়ান
আল্লাহ তাআলা মুহিউস সুন্নাহ হযরতকে এমন উপস্থাপনা-শক্তি দিয়েছেন যে, এককথায় বিস্ময়কর। তার বয়ানের সম্মোহন অসাধারণ। সর্বশ্রেণীর মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা মুগ্ধ হয়ে তাঁর বয়ান শোনে এবং ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। আরও আশ্চর্য যে, বয়ানে তিনি ক্লান্ত হন না। একাধারে পাঁচ-ছয় ঘন্টা বয়ানের ঘটনাও তার রয়েছে।
মুহিউস সুন্নাহ হযরতের বাককৌশলের কথা সর্বজনবিদিত। তার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা দুষ্কর। ভ্রান্ত আকিদা বা ভুল মতবাদের লোকেরা তার সামনে লাজওয়াব হয়ে যায়। একজন সংশয়বাদী একবার প্রশ্ন করেছিল, সৃষ্টিকর্তা নাকি একজন, তাহলে বিজ্ঞান যে কৃত্রিম মানুষ বানানোর প্রায় সাফল্যপর্বে। তারা মায়ের গর্ভে বীর্য নিষিক্তকরণ ছাড়াও মানুষের জন্ম ঘটাতে পারছে। তাহলে সৃষ্টিকর্তা এক হয় কি করে? তিনি বলেছিলেন, এই যে আমরা অনেক পণ্যের কৌটাতে নকল হইতে সাবধান লেখা দেখি। এটা যদিও বিজনেস পলিসি। কিন্তু এতে একটা কথা পরিষ্কার যে, এর একটা মূলপণ্য রয়েছে। আমরা যে কৃত্রিম মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া দেখাচ্ছি। সেটা তো সেই নকল প্রোডাক্টই। বিজ্ঞান কি পারবে, নাক ছাড়া একটা মানুষ বানিয়ে দেখাতে? এতো শুধু একটা বাহ্যিক অঙ্গের কথা বললাম, শরীরের ভেতরে তো আরো অনেক কিছুই আছে। সেগুলো প্রতিস্থাপন ছাড়া কি নব আবিষ্কৃত মানুষ সৃষ্টি করে দেখাতে পারবে? সব কিছু নতুনভাবে সৃষ্টি করে মানুষ বানিয়ে দেখাতে পারবে? লোকটি নিরুত্তর হয়ে গেল।
৮. তলাবাদের প্রতি শফকত
ছাত্রদের প্রতি রয়েছে তার অগাধ মহব্বত, বারবার তাকে বলতে শুনেছি সকল ছাত্ৰরা আমার সন্তানতুল্য। জামিয়ার ছুটির সময়টা তার জন্য সবচেয়ে কষ্টের মূহুৰ্ত। ছাত্ৰদের দেখতে পাবে না বলে তার মনটা খারাপ থাকে, কবে জামিয়ার ছুটি শেষ হবে, মৌমাছির গুঞ্জনে বাগান মুখরিত হবে সে প্ৰতীক্ষায় থাকেন। ছাত্রদের হকের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত যত্নবান। যত ব্যস্ততাই থাকুক যতদূরেই থাকুক ছাত্ৰদের একটি সবক পড়ানোর জন্য প্রয়োজনে বিমানে করে জামিয়ায় উপস্থিত হয়ে সবক পড়িয়ে যান।
৯. ওস্তাদদের প্রতি খায়েরখাহ
জামিয়ার আসাতিযায়ে কেরামদের তিনি অত্যন্ত কদর করেন। তাদের বেতন-ভাতা ছাড়াও তিনি সকল প্রয়োজনে সর্বাত্মক সহায়তা করেন। প্রতি বছর জামিয়ার আসাতেযায়ে কেরামদের থেকে কমপক্ষে একজনকে নিজ খরচে হজ্বে পাঠান। জামিয়ার বহু উস্তাদ এমনও আছেন, যারা অনেক আগে ইন্তেকাল করেছেন, কিন্তু মুহিউস সুন্নাহ হযরত তাদের পরিবারকে মাসিক বেতন ভাতা এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। যাত্রাবাড়ি মাদরাসার শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ভবন রয়েছে, তাতে নামমাত্র ভাড়া দিয়ে ওস্তাদরা মাদরাসার কাছেই যেন থাকতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি যাত্রাবাড়ির কাজলায় ওস্তাদদের জন্য ৭তলা ভবন নির্মাণ করেন এবং নামমূল্যে তিন ফ্ল্যাট প্রদান করেন। মাত্র ২০ লাখ টাকায় প্রায় ৯০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কি এই যুগে ভাবা যায়?
মুহিউস সুন্নাহ হযরত আগে এপার্টমেন্ট নির্মাণ করেছেন, তারপর ওস্তাদরা বুকিং দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত ওস্তাদরা কিস্তি আকারে (জিরো ইন্টারেস্টে) অনধিক ৫ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ মালিকানা বুঝে পেয়েছেন। বাকি টাকার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদও ধরেননি। যখন টাকা হয়, তখন দেওয়ার ভিত্তিতে তিনি শিক্ষকদের জন্য এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
১০. মুহিউস সুন্নাহ লকব
সুন্নতে নববীর প্রচার-প্রসারে তার সুখ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সর্বত্রই তিনি সুন্নতের দাওয়াত নিয়ে চষে বেড়ান। দাওয়াতুল হকের ব্যানারে সারাবিশ্বে নববী সুন্নাত জিন্দার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট থেকে ছোট সুন্নাতের প্ৰতি তার এত পাবন্দি, যা সত্যি বিস্ময়কর। তাকে বারবার বলতে শুনেছি, আমার একটি দাঁড়ি কাটার বিনিময় যদি সাড়াবিশ্বে খেলাফত প্ৰতিষ্ঠা হবে বলা হয়, তারপরও আমি দাড়ি কাটবো না। তাকে যারা চিনে তারা বলে, ‘তিনি তো নববী আদৰ্শের পূৰ্ণ প্ৰতিচ্ছবি’। তাকবীরে উলার প্ৰতিও তার যারপরনাই পাবন্দি। আমি তাকে যদ্দুর দেখেছি, কখনো তাকবিরে উলা ছুটতে দেখিনি।
তার দীনের বিভিন্ন অঙ্গনে দীর্ঘ দিনের সাধনা অবদান ও ভূমিকার জন্য দেশবাসীর নিকট বরেণ্য ও সমাদৃত। বিশেষ করে ধর্মীয় অঙ্গনের নানাপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, জাতীয় পর্যায়ের ওলামা-মাশায়েখ ও বুজুর্গানে দীনের নিকট তিনি বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। নতুন প্রজন্মের ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও তলাবাদের মাঝে তিনি সর্বজনমান্য ও প্রিয় ব্যক্তিত্বরূপে বিশেষভাবে বরিত। ‘মুহিউস সুন্নাহ’ উপাধি তাদের ভালোবাসার বিনম্র বহিঃপ্রকাশ।
হারদুয়ীর হযরতের (রূহানী বসিরত ও ফারাসাত) আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শীতার ফলে তিন আজ সমকালের নন্দিত পুরোধা। মজলিসে দাওয়াতুল হকের বাংলাদেশের আমীর। আহলে হক ওলামা হযরতের বৃহত্তর দীনি ঐক্যের প্রতীক। মূলধারার আলেম সমাজ যে চিন্তা ও কর্মসাধনার অভিন্ন উত্তরাধিকার সে হক ও হক্কানিয়তে সমন্বিত অগ্রযাত্রার তিনি উদার ও সর্বজনগ্রাহ্য অগ্রপথিক।
মুহিউস সুন্নাহ হযরতের কথা অল্পতে বলে শেষ করার নয়। তাই এই ‘তিলকা আশারাতুন কামেলা’ বলেই শেষ করছি। মূলত তার অনেক উন্নত বৈশিষ্ট্যের এগুলো কিছু নমুনামাত্র। হযরতের আরও কিছু গুণবৈশিষ্ট্য- যেমন, ফাকাহাত, ফেরাসত, সবর ইত্যাদি নিয়েও অনেক কিছু লেখা যেতে পারে। আমরা অর্ধশতকাল ধরে তার ইলমি, ইসলাহি খেদমত দ্বারা উপকৃত হয়ে আসছি। আল্লাহপাক দীনের দূর্গসম এই মহান ব্যক্তির ছায়া আমাদের ওপর আরো বহুদিন প্রসারিত রাখুন! কালের এই চেনা পিদিমের জ্যোতির্ময় আলো আমাদের মাঝে দীর্ঘায়িত করুন!
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ি, প্রচার সম্পাদক, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ।
-এটি