মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইসলামের নিদর্শন। এই ইবাদতটি শুধুমাত্র এই উম্মতের মধ্যে নয় বরং পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও ছিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানির একটি পদ্ধতির প্রচলন করেছি, যে জানোয়ার আল্লাহ তাদের দান করেছেন, তার ওপর যেন তারা তাঁর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ, আয়াত : ৩৪)
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কোরবানি চলে এসেছে। সূরা মায়েদা ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা আমাদের আদিপিতা আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানির পেশের কথা বলেছেন। হাবিল ও কাবিল দুই ভাই কোরবানি করেছিল। হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছিল আর কাবিলেরটা হয়নি। সূরা কাউসারেও আল্লাহতায়ালা কোরবানি আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার রবের জন্য নমাজ পড়ো ও কোরবানি করো।’ (সূরা কাউছার, আয়াত : ২)
কোরবানির পশু উট, গরু ভেড়াকে আল্লাহ দ্বীনের নিদর্শন বানিয়েছেন। সেগুলো কোরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের শান শওকত প্রকাশ পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং উটকে আমি করেছি আমার নিদর্শগুলির অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে কল্যাণ রয়েছে।’ (সূরা হজ, আয়াত : ৩৬)
রাসূল (সা.) মদিনার দশ বছরের জিন্দেগিতে প্রত্যেক বছর কোরবানি করেছেন। কখনো কোরবানি পরিত্যাগ করেননি, বরং কোরবানি পরিত্যাগকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবি আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্তে¡ও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৩)
এই কোরবানির পেছনে আমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর চরম আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে। তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন, পরিবার ও বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া প্রাণাধিক পুত্রকে জবাই করার জন্য উদ্যত হয়েছিলেন। কোরআনের ভাষায়- (ইবরাহিম বলল) হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একজন সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো। অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে আমি জবাই করছি।
এখন তোমার অভিমত কী বলো। পুত্র বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা সম্পাদন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে (আল্লাহর নিদের্শের সামনে) আত্মসমর্পন করল, আর ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করে। তখন আমি তাকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরাণদের পুরস্কৃত করে থাকি।
নিশ্চয়ই এ ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে (পুত্র ইসমাইলকে) মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। আর আমি এটা (ঈদুল আজহায় কোরবানি করার রীতি প্রবর্তন করে) পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত : ১০০-১০৮)
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব
জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত এই তিন দিন যে ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার যেকোনো একটির সমপরিমাণ সম্পত্তি) তার জন্য গরু, মহিষ, উট এগুলোর একটা অংশ অথবা ছাগল, দুম্বা এসব পশুর একটি কোরবানি করা ওয়াজিব।
কোরবানির ফজিলত
কোরবানি করার অনেক ফজিলত ও সওয়াব রয়েছে। হোসাইন ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি খুশি মনে সওয়াবের নিয়তে কোরবানি করে, ওই কোরবানি তার জাহান্নামে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হবে।’ (আল মুজামুল কাবির লিত তাবরানি)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ঈদুল আজহার দিন মানুষের কোনো আমল আল্লাহতায়ালার কাছে কোরবানি করার চেয়ে বেশি প্রিয় নয়। কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। অর্থাৎ কোরবানিদাতা ওই জিনিসগুলোর বিনিময়ে সওয়াব পাবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহতায়ালার কাছে একটি বিশেষ স্থানে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা খুশি মনে কোরবানি করো। বেশি খরচ হয়ে গেলেও মন খারাপ করো না।’ (জামে তিরমিজি)
যায়েদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, কোরবানি কী? তিনি বললেন, তোমাদের বংশীয় বা রুহানী পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শ। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, কোরবানি করে আমরা কী পাই হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, প্রতিটি পশমের বদলে একটি নেকি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, হে ফাতেমা! ওঠো জবাই করার সময় নিজের কোরবানির পশুর পাশে উপস্থিত থাকো। কারণ কোরবানির রক্তের প্রথম ফোটাটি মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তোমার সব পাপ মাফ হয়ে যায়। মনে রেখো, কিয়ামতের দিন এই কোরবানির রক্ত ও গোশত আনা হবে এবং তোমার পাল্লায় সত্তর অংশ বাড়িয়ে রেখে দেওয়া হবে। এবং ওই সবগুলোর বদলে তোমাকে সওয়াব দেওয়া হবে।’ (ইসবাহানি)
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় সেও কোরবানি করতে পারে ফজিলত অর্জনের জন্য।
নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া
কোরবানি একান্তই কোনো উৎসব নয়; কোরবানি হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নিজের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার লক্ষ্যে। গোশত খাওয়ার নিয়তে হলে কিংবা মানুষ খারাপ বলবে এই কারণে কোরবানি দেওয়া হলে এই কোরবানি কবুল হবে না আল্লাহর দরবারে। কেননা আল্লাহর না গোশতের প্রয়োজন, না রক্তের প্রয়োজন। তিনি তো শুধু তাকওয়াই দেখেন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে কখনো কোরবানির গোশত বা রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়।’ (সূরা হজ, আয়াত : ৩৭)
একজন কোরবানিদাতা এ ঘোষণাই প্রদান করে, ‘আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের মালিক আল্লাহতায়ালার জন্য।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ১৬২)
কোরবানি না করে অর্থ বিতরণের সুযোগ নেই
গরিব-অসহায় মানুষকে দান-খয়রাত করা আপন স্থানে সওয়াবের কাজ। একে অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে কোরবানি স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইবাদত। ইসলামের ওয়াজিব বিধান। তাই কোরবানি না করে অর্থ বিতরণের সুযোগ নেই। তবে হাঁ, কম টাকা দিয়ে কোরবানি করে বাকি টাকা বিতরণ করলে অসুবিধা নেই।
লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম, বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।
-এটি