মাজহার বারলাস।।
অনুবাদ: বেলায়েত হুসাইন>
'মুসলিম শাসকদের ডুবে মরার জন্য মাত্র দুটি ছবিই যথেষ্ট'- বদি সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে এই কথা বলার পরেই আমি জানতে চাইলাম, শাহ্ জ্বী! কোন দুটি ছবি? আমার এই প্রশ্ন শুনে বদি সাহেবের চেহারা রক্তিমাভাব ধারণ করলো। ফের আরো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, তুমি ছবি দুটি সম্পর্কে জানোনা? এর একটি হলো- অধিকৃত কাশ্মীরের।
যেখানে ৬০ বছর বয়সী বশির আহমাদ খানকে ভারতীয় জানোয়ারেরা গুলি করে হত্যা করেছে। দেখছো না- বশির আহমাদের রক্তেভেজা দেহ পড়ে রয়েছে, বুকের ওপর বসে আছে তার তিন বছরের নাতি- অবুঝ- অসহায় এই বাচ্চাটি মুসলিম দেশগুলির শাসকদের কাপুরুষতার শোক প্রকাশ করে যাচ্ছে।
অসহায়ত্বের প্রতিকৃতি ছবির এই শিশু কী ভাবছে? সে মনে করছে- আমি এমন এক ধর্মে জন্মলাভ করেছি যার অনুসারী দেড় মিলিয়ন থেকেও বেশি কিন্তু সবাই যেন ভেজা বিড়াল। এদের সবার মুখে তালা পড়ে আছে। হাতে হাতে দাসত্বের শিকল লটকানো। সকলেই কাপুরুষ। খুব ভয় তাদের।
গাফলতের ঘুমে বিভোর মুসলিম শাসকগণ হয়তো দ্বিতীয় ছবিটির খবরও জানে না।
১০-১২ বছরের ফিলিস্তিনি একটি শিশু মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তার বুকের ওপর বসে গলা চেপে রেখেছে এক ইহুদি কুকুর। যেভাবে মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের ওপর বসেছিল। কিন্তু আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে, পোস্টার ব্যানার ছাপিয়ে আন্দোলন করেছে তার স্বজাতিরা। তারা দেখিয়েছে যে, আমরা মুসলমান নয়, যারা নিহত হওয়ার পরও নিশ্চুপ থাকে।
ফিলিস্তিনি শিশুটি শাহাদাত বরণ করলো। ফ্লয়েড যেভাবে নিহত হল। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই বলে সে দুঃখ করছিলো- হে আল্লাহ! আমার অপরাধ শুধু এই যে- আমি মুসলিম। কিন্তু আমার জীবন সায়াহ্নের প্রতিটি শ্বাস-নিঃশ্বাস আমার কাছে জানতে চাইছে, কোথায় গিয়েছেন বড় বড় শাসকগণ, জুব্বা পরিহিত বাদশাহরা কোথায়, মুসলমানদের আত্মমর্যাদা আজ কোথায় ভূলুণ্ঠিত হলো?
হে আমার অধিকর্তা! আমি তো সামান্য এক ফিলিস্তিনি শিশু। আমার আশেপাশে কতো বড় বড় মুসলিম রাষ্ট্র। আমাকে বাঁচানোর জন্য মুসলমানদের এসব দেশে কেউ নেই। কতো বড় জর্দান, মিসরের বিস্তৃতি কতদূরে, শামও নিশ্চুপ, লেবানন থেকেও কেউ আসছে না।
বিপুল ধনসম্পদে হাবুডুবু খাওয়া সৌদি শাসকগণ হয়তো কিছু একটা বলতো, কিন্তু তাদের এখন আমাকে স্মরণ করার ফুরসত মিলছে না। তারা এখন এটি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, করোনা তাদের কোটি কোটি রিয়াল লোকসান করে দিচ্ছে; করোনা ভাইরাস সিনেমা বিরান করে দিয়েছে, ক্যাসিনো কপলশূণ্য- মডার্ন ক্রাউন প্রিন্স এগুলো বানিয়েছেন বানিজ্যের আশায়, লাভের প্রত্যাশায়, কিন্তু আজ সর্বত্রই ঘাটতি আর ঘাটতি!
একইভাবে অন্যান্য আরব নেতারাও হয়তো নানাকাজে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। পক্ষান্তরে আমি মৃত্যু-উপত্যকায় উপনীত হয়ে এটিই চিন্তা করছি যে, ইসলামি রাষ্ট্রগুলির এতো বড় বড় বিশাল সৈন্যবাহিনীর বহর কি করছে, তারা কি ইসরায়েলের দেড়-পৌনে দুই লাখ সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে পারেনা?
এসব প্রশ্ন শুনে ভাবছি- সেই জজবা ও আবেগ কোথায় হারিয়ে গেল? আমাদের ৩১৩ তো হাজারো যোদ্ধার চেয়ে বেশি শক্তিদ্বীপ্ত ছিল।
ইহুদিরা আজও হজরত আলি রা. এর যুদ্ধের কথা ভুলেনি। কিভাবে তিনি ইহুদিদের নেতা তিন ভাই- মারহাব, হারিস ও আসিরকে টুকরো টুকরো করে রেখেছিলেন। আবেগ লড়াই করে, ঈমান লড়াই করে- ঈমান তো এমন খোদায়ী শক্তি যা ৭২ বছরের বৃদ্ধকেও ঝুঁকতে দেয়না।
ইসলামের সূচনাকালের কথা বাদ দিয়ে এর হাজার বছর পরের আলোচনা করো। এই মুসলিম শাসকদের মধ্যে কি তৈমুর, বাবর কিংবা বাইপার্স নেই?
বদি সাহেব ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেই যাচ্ছিলেন- এরইমধ্যে এক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে আমি জানতে চাইলাম- শাহ জ্বী! এই বাইপার্স- তিনি কে?
বদি সাহেব গর্জন ধ্বনি তুলে বললেন, তুমি তো ইতিহাসের কিচ্ছু জানো না- তৈমুরের পূর্বপুরুষগণ মঙ্গলরা মুসলিম ছিলো না। এসব মঙ্গল তাতারেরা বিশ্বব্যাপী জুলুম-অত্যাচারের জাল বিছিয়ে রেখেছিল। এশিয়া ও ইউরোপ তাদের ভয়ে কম্পিত ছিল। হালাকু আর চেঙ্গিজ খানের মাথার খুপরি দিয়ে মিনার বানানোর কথা আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তাতার বাহিনী যে ভূমি দিয়ে অতিক্রম করতো সেই ভূমির বসতির ধ্বংসাবশেষ রেখে যেতো। আব্বাসি খেলাফতের ভীত নড়বড়ে করে দিয়েছিল। বাগদাদ লুন্ঠনের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। চীন গোলামি মেনে নিয়েছিল। আনাতোলিয়ায় পতপত করে উড়তে ছিলো মঙ্গল-পতাকা।
দ্বাদশ শতাব্দীতে, মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং বাগদাদের শাসকরা মঙ্গলদের সামনে যাও একটু খাড়া হয়েছিল, কিন্তু টিকতে পারেনি। তারা একেক করে সব মুসলিম সাম্রাজ্যের পতন ঘটানোর পর মুসলিম শাসকগণ পরাজয় বরণ করে নেয়।
একমাত্র মিসর হার মানেনি- এখানের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন কৃতদাস মামলুকেরা- রুকনুদ্দিন বাইপার্স এই সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। কৃতদাস এবং কৃতদাস- সন্তানেরা আগে থেকেই মঙ্গলদের অনিষ্ট থেকে সতর্ক।
আইনে জালুতের ময়দানে মঙ্গল বাহিনী তুফান বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কিন্তু বাইপার্স পর্বতের ন্যায় স্থির হয়ে তাদের মোকাবেলা করেছেন। সংখ্যায় বাইপার্সের বাহিনী ছিল অল্প, রণসামগ্রীও ছিলো না থাকার মতোই- এরপরও সে শংকিত হয়নি, ভয় পায়নি। এতো সেই বাইপার্স যাকে বাজার থেকে কয়েক দিনারে খরিদ করা হয়েছিল।
মঙ্গলদের সঙ্গে বোঝাপড়া ছিল খুব কঠিন, তাদের তরবারি থামানো ছিলো প্রায় অসম্ভব, কিন্তু কৃতদাস মামলুকেরা এমন বীরদর্পে তাদের তরবারি থামিয়ে দিয়েছিল যে, তরবারির আলিঙ্গনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে বেরুচ্ছিলো।
বাইপার্সের এই অসীম সাহসিকতায় মঙ্গলবাহিনী শুধু পিছপাই হয়নি; রীতিমতো ভাগতে বাধ্য হয়েছিল- এভাবে সামান্য এক কৃতদাসের হাতে মুসলমানদের শেষ অস্তিত্বটুকু টিকে ছিল সেদিন।
কিন্তু আফসোস! আজ মুসলিম শাসকদের মধ্যে কোন বাইপার্স নেই। মজলুম দুই মুসলিম শিশুর বীভৎস এই ছবি দেখে মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর ডুবে মরা উচিত। তাদের ডুবে মরার জন্য শুধু এই দুটি ছবিই যথেষ্ট। অথচ কেমন হওয়ার কথা ছিল- আল্লামা ইকবালের ভাষায়- হক বাতিলের লড়াই হলে মুমিন সেথায় লৌহ কঠিন।
পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট মাজহার বারলাসের কলামটি জিয়ো নিউজ উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন তরুণ লেখক বেলায়েত হুসাইন।
-এএ