মাওলানা এহসানুল হক।।
এ দেশের রাজনীতিতে ধুমকেতুর মতো আগমন করেছিলো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। অল্প সময়ের ব্যবধানে তুমুল ঝড় তোলেছিল দলটি। মাত্র দুইতিন মাসের তৎপরতায় তাবৎ ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিসহ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রেকে প্রচন্ড এক ঝাকুনি দিয়েছিলো। জন্মসাল আরও অনেক আগে হলেও ২০১৩ সনে চট্রগ্রামে শাহাবাগ গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ রুখে দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে হেফাজত।
ইসলাম প্রিয় জনতা যখন নেতৃত্বের শূণ্যতায় হাহাকার করছিল, হতাশা আর আফসুসে বুক চাপড়াচ্ছি, খুঁজে ফিরছিল ইসলামি রাজনীতির কিংবদন্তী শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক বা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মত কোন সংগ্রামি নেতার বজ্র হুংকারের, ঠিক তখন নাস্তিক বিরোধি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এবং এ আন্দোলনকে চূড়ান্ত সফলতায় নিয়ে যেতে জাতির কান্ডারি রূপে আবির্ভূত হয় হেফাজতে ইসলাম।
একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও সারা দেশের আলেম উলামা, ইসলামি রাজনৈতিক দল সমূহ সবধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে রাসূলের ইজ্জত রক্ষার আন্দোলনে কাধে কাধ মিলিয়ে হেফাজতের কাতারে শামিল হয়। তাউহিদি জনতা নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সভাপতি হাটহাজারি মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফি।
নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সারা দেশ জেগে উঠে। ৬ই মার্চ লংমার্চ নিয়ে অভূতপূর্ব উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ঈমান-আকিদা ও ইসলাম রক্ষায় সবাই শামিল হয় এককাতারে। অভাবনীয় মহাজাগরণ এরপর ৫ই মে ঢাকা অবরোধ থেকে শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় তাউহিদি জনতা। সরকার দিশেহারা হয়ে রাতের আধারে ঝাঁপিয়ে হেফাজতে ইসলামের উপর। নির্মিত হয় ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক অধ্যায়।
এ পযর্ন্তই ছিলো হেফাজতের উত্থানকাল। এরপরের ইতিহাস দুঃখ ও বেদনার। বিপুল আশাজাগানিয়া সংগঠনটি ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাপিয়ে দেয়া একটি সংগঠন কেনো এভাবে ব্যর্থ হলো? অনেকেই বিভিন্ন রকম কারণ বলবে। আমি মনে করি হেফাজত ব্যর্থ হওয়ার প্রথম কারণ দুইটি। এক, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে পিছুহটা। দুই, শীর্ষ নেতৃত্বের ত্যাগ স্বীকার না করা। কথাটা বুঝার জন্য আমি একটা উদাহারণ দেই।
ইসলামপন্থীদের উপর এমন দুযোর্গ কিন্তু ২০০১ সালেও এসেছিলো। তখন আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলেন আপোষহীন নেতা শাইখুল হাদীস রহ.। পায়ে পায়ে হেটেছিলেন মুফতি আমিনীসহ আরও অনেকে। হামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে। কিন্তু কেউ পিছু হটেনি। কুরবানি পেশ করার সময় এসেছে। সবার আগে গ্রেফতার হয়েছেন আন্দোলনের প্রধান দুই নেতা শাইখুল হাদীস ও মুফতি আমিনী। তাদের গ্রেফতারের পরও আন্দোলন থামেনি। পঞ্চাশজনের মিছিল থেকে চল্লিশজন গ্রেফতার হয়েছে। তবুও আন্দোলন থেকে পিছু হটেনি। এভাবেই এসেছে সফলতা।
আর হেফাজতে ইসলাম কি করেছে? ৫ মে হামলার পর আর মাঠে নামেনি। নেতাদের অনেকে গাঢাকা দিয়েছে। হেফাজত যদি তখনই আবার মাঠে নামতো, হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি আকাবেরদের অনুসরণে ত্যাগ স্বীকার করতো তাহলে কি পরিস্থিতি হতো একটু চিন্তা করেছেন? হেফাজত যখন সেটা করতে পারেনি, তখনই হেফাজতের পতন শুরু হয়েছে। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এরপর রাজনীতির বিচিত্র খেলায় সরকারের কূট কৌশল, স্বীকৃত আদায়, শুকরানা মাহফিলসহ নানাবিধ কারণে হেফাজতের একটা অংশ সরকারের মিত্র শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তবুও তারা চিন্তা মুক্ত হয়নি। আল্লামা আহমদ শফির অবর্তমানে হেফাজত কার হেফাজতে থাকবে এটা নিয়ে তারা অস্তির। শোনা যাচ্ছে যে কোনো দিন পুনর্গঠিত হচ্ছে হেফাজত। মহাসচিব পদ থেকে বাদ পড়ছেন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী।
বাবুনগরীকে বাদ দেয়ার পর হেফাজতের কি হবে? যাকে বসানো হবে সেই নেতৃত্ব দিবে হেফাজতের? কখনোই না। হেফাজত নিয়ে তারা যা ইচ্ছা করুক। আশা-নিরাশার কিছু নেই। হেফাজত এখন নখদন্তহীন এক সংগঠন। বাবুনগরীর পদ ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে হেফাজতের গন্তব্য হবে শুধুই চট্টগ্রাম। তারা ২০১৩ এর আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। ঢাকার রাজনীতিতে তাদের আর কোনো অবস্থান থাকবে না।
২০১৩ সনে নেতৃত্বের যে শূন্যতা ছিলো সেটাও এখন নেই। নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। রাজনীতি ফিরে আসবে রাজনীতিবিদদের হাতেই। বাবুনগরী কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন। তিনি এখন তাউহিদি জনতার হৃদয়ে আস্থার প্রতীক। পদ ছিনিয়ে নিলেও সময়ের প্রয়োজনে তিনি এগিয়ে আসবেন। হয়তো নতুন নামে, নতুন ব্যনারে। দ্বীন ইসলামের উপর কোনো আঘাত এলে তাউহিদি জনতাই খুঁজে নেবে আপোষহীন নেতা।
শিক্ষক, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া।
-এটি