মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী।।
দেশের উচ্চশিক্ষার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। শতবর্ষে পা দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই প্রতিষ্ঠানটি। ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে বিবেচিত। শিক্ষার্থীদের আগ্রহের দিক বিবেচনা করলে অবশ্য এটিকে সঠিক বলা চলে, কারণ প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয় তীব্র।
মাত্র ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এতে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬,১৫০ জন; পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২,০০৮ জন শিক্ষক।
যে সব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন তারা হলেন- মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রাহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল।
মূলত ঔপনিবেশিক শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে- শতবর্ষে এসে এটি ভাববার সময়ও এসেছে।
একটা বিষয় কিন্তু মানতেই হবে, প্রথাগত ভাবনার বাইরে দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতি গঠনে অবিরত লড়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি অর্জনের পেছনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই ছিলেন অগ্রগামী। এছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে বহু জ্ঞানী-গুণীজন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, বিজ্ঞানী, শিক্ষক আর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট।
অনেক চড়ায়-উৎরাই ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল, সে অতীত গৌরব এখন শুধুই ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই আমাদের জাতীয় গৌরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অবনতি হতে শুরু করে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের বড় অংশ নিয়েই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। শিক্ষক যদি যোগ্য না হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এ কথার ক্ষেত্রে তেমন দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ আজ রাজনীতিকে রাখেন পছন্দের শীর্ষে। দলীয় পদ নিতেও দ্বিধা করেন না। ভালো গবেষণার খবর পাওয়া যায় কালে-ভদ্রে। গবেষণা কিংবা নিয়মিত ক্লাস বাদ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সান্ধ্যকালীন কোর্সে ক্লাস নিতে আগ্রহ বেশি অনেকের। সাদা, নীল ও গোলাপিতে ভাগ হয়ে গেছেন শিক্ষকরা। তাদের এই ভাগাভাগিতে অনেক সময় দিশা খুঁজে পান না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অবশ্য এর মধ্যে এখনও অনেক ভালো শিক্ষক আছেন, যাদের হাত ধরেই ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে তাদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা ছিল প্রধান, তিনি হলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। অথচ তার মূল্যায়ন এখন যৎসামান্যই হতে দেখা যায়। শুধু তার স্মৃতি ধারণ করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল তাকে সম্মানের শীর্ষস্থানে ধারণ করা। কেননা জাতীয় ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় অবদান যেমন আমাদের স্মরণ করতে হয় তেমনি এ ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠের উদ্যোক্তাদের ভূমিকাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
প্রথমে সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করলেও পরে আর সে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এই আবাসন নিয়েই সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট, দুঃখ আর হতাশা। প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর অর্ধেকের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা নেই। যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তা নিয়েও শিক্ষার্থীদের রীতিমতো সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। হল কর্তৃপক্ষ নয়, সিটে শিক্ষার্থী ওঠান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এজন্য সর্বপ্রথম তাদের সঙ্গে লবিং করার পাশাপাশি গেস্টরুমের মতো নির্যাতন সেলের মুখোমুখি হতে হয়। সেটিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রথমে মেলে হয় গণরুম নয়তো হলের বারান্দা। পরে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ‘বড়ভাই’দের মন পাওয়ার প্রতিযোগিতা। যে এটা ভালোভাবে করতে পারবে, তার রুমের সিটও মিলবে আগে। এটিই এখন হলগুলোতে সিট পাওয়ার অঘোষিত নিয়ম।
এতো সব হতাশার মধ্যেও আশার দিক হলো গত বছর গৌরবের এই ক্যাম্পাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) দীর্ঘ ২৮ বছর পর নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে। প্রায় তিন দশক পর সিনেট পেয়েছে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি। অবশ্য ডাকসু নির্বাচন ও ছাত্র প্রতিনিধি বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। এ নিয়ে সংঘর্ষ, হামলা-মামলা, রাজনৈতিক খেল অনেক কিছুই হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আরও অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। খাবারের মান দিন দিন যেন খারাপই হচ্ছে। পর্যাপ্ত ক্লাসরুমের অভাব। লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিট মেলে না। সান্ধ্যকালীন কোর্স আর সাত কলেজ নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই। শিক্ষার মান নিয়ে তো নতুন করে আর কিছু বলার নেই। র্যাংকিংয়ে নাম না থাকা বা অনেক পিছিয়ে থাকা নিয়ে এ বছরও একরাশ বিতর্ক হয়ে গেছে। বহিরাগত গাড়ির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হাঁটা দায় হয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে যাওয়া মেট্রোরেল নিয়েও অসন্তোষ কম নয়। এমন হাজারো সমস্যা আর সংকটে জর্জরিত এ বিশ্ববিদ্যালয়।
সকল বাধা পেরিয়ে আবারও আমাদের প্রিয় এই ক্যাম্পাস হয়ে উঠবে মেধাবী ছাত্রদের, ভালো শিক্ষকদের- সেটাই এখন সবার প্রত্যাশা। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।