আব্দুল কাদির আল মাহদি
বার্সেলোনা, স্পেন থেকে>
আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের থেকে অনেক জিনিস উহ্য রাখেন। এমন কতেক বিষয় আছে মানুষের জ্ঞানে মন্দ মনে হলেও আল্লাহ তা’আলার জ্ঞানে বিষয়টি হয়তো ভাল। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
ۖ وَعَسَىٰ أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। (আল কোরআন ২/২১৬)
এরকম অনেক বিষয় যেটাকে ভয়ঙ্কর মনে হয় কিন্তু এর পরিনাম অনেক সুন্দর। ইউসুফ (সা) কে যেমন প্রথমে অন্ধকূপের গভীরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তারপরে গোলাম হিসেবে বিক্রি করা হল, তারপর তিনি জেলবন্দী হলেন। এসব ছিল তাকে বিশেষ সম্মানিত করার পূর্ব প্রস্তুতি। বাহ্যত মানুষের জ্ঞানে বিষয়গুলো মন্দ মনে হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُمْ مِنَ الْبَدْوِ مِنْ بَعْدِ أَنْ نَزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي ۚ إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِمَا يَشَاءُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আমাকে জেল থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে কলহ সৃষ্টি করে দেয়ার পর। আমার পালনকর্তা যা চান, কৌশলে সম্পন্ন করেন। নিশ্চয় তিনি বিজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (আল কোরআন ১২/১০০)
এই করোনা মহামারী আমাদের অনেক ক্ষতি সাধন করছে ঠিকই। । যেমন অনেক মানুষের মৃত্যুর কারন হয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্র ফাইন্যান্সিয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক দেশ থেকে অপর দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ঘটিয়েছে। আমাদের লকডাউনের আওতায় জীবনযাপন করতে হয়েছে । আমাদের স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করছে। তারপরও একজন অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে এগুলোর ভিতর বিরাট কল্যান নিহিত।করোনা ভাইরাসের দৃশ্যত কয়েকটি উপকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিব।
১। করোনার উপকারের মাঝে একটি হচ্ছে, এই মহামারী প্রমান করছে যে আল্লাহ তা’আলা সকল শক্তির উৎস, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি সামান্য একটি অদৃশ্য বস্তু দিয়ে পুরা জগতকে অচল করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সকল শক্তি তার শক্তির সামনে দূর্বল একথা প্রকাশ পেয়েছে। পৃথিবীর শক্তিগুলো অপারগ তার শক্তির সামনে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا
তোমরা যেন জানতে পার যে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং সবকিছু তাঁর গোচরীভূত। (আল কোরআন ৬৫/১২)
২। আরেকটি উপকার হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলার দেয়া স্বাভাবিক ও স্বাধীন জীবনযাপনের মূল্য মানুষ বুঝতে পেরেছে। স্বাভাবিক ও স্বাধীন জীবন কত বড় যে নেয়ামত মানুষ সেটি ভূলে যাচ্ছিল। লকডাউনে ঘরে বন্দিজীবন পার করার ভিতর দিয়ে সেটির মূল্য বুঝতে পারল। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ ۚ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ
যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ। ( আল কোরআন ১৪/৩৪)
৩। আরেকটি উপকার হচ্ছে, মানুষের পারিবারিক বন্ধনগুলো যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কারন মানুষ এতই ব্যস্থ হয়ে পড়ছিল যে ঘরে সময় দেয়ার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। ঘরকে হোটেলের মতো রাত্রিযাপনের জন্য ব্যবহার করতো। ঘরে আসা যাওয়ার কোন রুটিন ছিল না। দিনকে দিন চলে যেত, পরিবারের এক সদস্যের সাথে অন্য সদস্যের দেখা হতো না।
সন্তানদের সাথে পিতামাতার সময় দেয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা এই মহামারীর উসিলায় সবাইকে এক ঘরে আবদ্ধ করে পরিবারকে সময় দেয়ার ফুরসত করে দিলেন। যার দরুন এক অন্যের সাথে মেলামেশা ও গল্পগুজবের সুযোগ হল। এলোমেলো বন্ধনগুলো ঠিকঠাকক হল।
৪। এই ভাইরাসে আমাদেরকে পৃথিবীর আসল মর্যাদা বুঝিয়ে দিল যে এই নশ্বর পৃথিবী আসলে কিছুই না। এই পৃথিবী যেকোন মুহুর্তে চোখের পলকে ধংস হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীর মূল্যায়ন করে বলেন-
ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়। (আল কোরআন ৫৭/২০)
৫। আরেকটি উপকার হচ্ছে, যে মৃত্যু ব্যাপারে মানুষের মাঝে অবহেলা চলে আসছিল সেই নিশ্চিত মৃত্যুর সত্যতা মানুষের সামনে পরিস্কার হলো।
কাজেই বুদ্ধিমানদের জন্য এখান থেকে লেসনস হচ্ছে, সর্বদা ঈমান ও আমল নিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। মৃত্যু হঠাৎ কারও কাছে এসে যেতে পারে যেকোন মহামারীতে অথবা মহীমারী ছাড়াও। আল্লাহ তা’আলা বলেন- قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ ۖ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য, দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে। (আল কোরআন ৬২/৮)
৬। আরেকটি উপকার হচ্ছে, মানুষ খরচ করা ও ভোগ করা ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। কারন মানুষ অযথা খরচে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। যেটা ইসলামে নিষিদ্ধ ইসরাফের পর্যায়ে চলে যেত। মানুষের ভিতর অযথা হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল এবং পরিবারের সাথে ঘরে খাওয়া ছেড়েই দিয়েছিল। এই লকডাউনের ফলে মানুষ পরিবারের সাথে খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কাজেই অযথা, অনর্থক, বেহিসেব খরচ থেকে মানুষ বাঁচতে পারছে। আল্লাহ তা’আলার বাণী- وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। (আল কোরআন ৭/৩১)
৭। আরেকটি উপকার হচ্ছে, মানুষ মসজিদ ও মসজিদে জামাতে নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করছে। কারন সংক্রমনের আশঙ্কায় মসজিদগুলো বন্ধ ছিল। যার কারনে অনেকের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। মসজিদ হচ্ছে ইসলামের শে’আর। লকডাউনের ফলে মানুষ ইসলামের শে’আর মসজিদ ও এবাদতখানার প্রতি সম্মান প্রদর্শণ করতে শিখেছিল। আর যারা ইসলামের শে’আরের প্রতি সম্মান পদর্শন করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার বাণী-
ذَٰلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ
এটা শ্রবণযোগ্য কেউ আল্লাহর নামযুক্ত বস্তুসমুহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত। (আল কোরআন ২২/৩২)
৮। আরেকটি উপকার হচ্ছে, পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ কমে আসছিল। কারন মিল ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল। মানুষের চলাচল ছিল না বিধায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। যার দরুন শব্দ দূষণ, বায়ূ দূষণ, পানি দূষণ কমে আসছিল। পরিবেশটা ফ্রেশ হওয়ার একটি মাধ্যম হয়েছিল।
৯। আরেকটি উপকার হচ্ছে, যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তারা নিজেরা এবং যারা আক্রান্ত হয়নি কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেখেছে। প্রতেকে আল্লাহ তা’আলার দেয়া অক্সিজেন ও শ্বাস প্রশ্বাসের মূল্য বুঝতে পেরেছে । মানুষ জন্ম থেকে নিয়ে কত শ্বাস প্রশ্বাস নিল যেটার তুলনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এটি এমন এক নেয়ামত যেটার তুলনা চলে না এবং কেউই তুলনা করার সামর্থ রাখে না।
১০। আরেকটি উপকার হচ্ছে, কিয়ামতের ভয়ঙ্কর অবস্থায় কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না। মানুষ একে অপর থেকে পালাবে। সেগুলোর কিছু নমুনা পৃথিবীতে দেখা গেল। আল্লাহ তা’আলা এ সম্পর্কে বলেন- يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ
সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। (আল কোরআন ৪০/৩৪,৩৫,৩৬,৩৭)
এতো কিছুর পর মানুষের অন্তরদৃষ্টি খোলা উচিত। আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনাবলীর প্রতি চোখ বুলিয়ে তার প্রতি ভাল ধারনা পোষণ করা উচিত। আল্লাহ তা’আলা বান্দার যেটি ভাল সেটির ফায়সালা করেন এমন ধারনা বুকে ধারন করা উচিত। রাসুল (সা) হাদিসে ক্বুদসিতে আল্লাহ তা’আলার বাণী ঘোষণা করে বলেন- أَنَا عِنْدَ ظَنِ عَبْدِي بِي فَلْيَظُنَّ بِي مَا شَاءَ“. আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি আমার বান্দার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করি, আমার প্রতি সে যেমন ধারণা রাখে।
আল্লাহ তা’আলা সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ যেন দান করেন। আমিন
লেখক: বার্সেলোনা দারুল কোরআন ইসলামিক সেন্টার থেকে আব্দুল কাদির আল মাহদি প্রদত্ত খুতবা