মুফতী মুহাম্মাদুল্লাহ।।
হে মুসলিম ভাই! আপনাকে গীবত থেকে বাঁচতে হবে। পর নিন্দা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কারও সমালোচনা করবেন না। কারও নিন্দা করবেন না। ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘প্রত্যেক মুকাল্লিফ তথা যাদের ওপর শরী‘আতের হুকুম আহকাম আরোপ হয়, তাদের কর্তব্য হলো যবান হিফাযত রাখা। একদম চুপ থাকা চাই। তবে যদি কোনো কথা বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে পুণ্যের কথা। নেকের কথা। যে কথায় আল্লাহ খুশি হন। রাসূল সন্তুষ্ট হন। আর অনর্থক কোনো কথা বলা যাবে না। কেননা তা হারামের দিকে, মিথ্যার দিকে, অসত্যের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এই অভ্যাসই মানুষের বেশি। যবান মানুষকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হারাম পথে, মিথ্যার দিকে, অসত্যের দিকে কিন্তু তার কোনো খবরই নেই। সে চোখে দেখেও দেখে না। বুঝেও বুঝে না।’
গীবত করা একটি নিকৃষ্ট অভ্যাস। ঘৃণিত কাজ। যে গীবত করে, অপরের দোষ তালাশ করে বুঝতে হবে তার অন্তরটা পচা। পচে পচে এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আর সেই দুর্গন্ধই হলো অপরের দোষ তালাশ করা। আমাদের পেয়ারা রাসূলও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘হযরত আবূ হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কোনো বস্তু বা ব্যক্তি সম্পর্কে কুচিন্তা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কুচিন্তা হলো সবচেয়ে মিথ্যা কথা। কারও খারাপ বা দোষের খবর জানার চেষ্টা করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না। পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রæতা রেখো না। আর পরোক্ষ নিন্দাবাদে একে অপরের পিছনে লেগো না; বরং তোমরা সকলেই আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৬৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৩)
আল্লাহ তা‘আলাও গীবতের নিন্দা করে কুরআন শরীফে আয়াত নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন,
‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজের পরিবার ও অন্য কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, শুধু শুধু ধারণা থেকে বিরত থাকো। কিছু কিছু ধারণা গুনাহের কারণ। আর মিথ্যা ধারণা করলে তো শাস্তি নির্ধারিত আছেই। আর শোনো, কোনো মুসলামানের দোষ-ত্রæটি তালাশ করো না। কারও গোপন বিষয়ের তালাশে পড়ো না। আর কারও এমন বিষয় আলোচনা করো না, যা তার কানে গেলে সে অসন্তুষ্ট হয়। আচ্ছা বলো তো, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন আছে, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে খুব পছন্দ করে? সুতরাং যেমনি ভাবে তোমাদের স্বভাব-সুরুচি বোধ তোমাদেরকে এই বিষয়টি বাধা দেবে, তেমনিভাবে তোমাদেরকে শরী‘আতও কোনো মুসলামান ভাইয়ের গীবত করতে বাধা দেয়। মানুষ তো মুসলমান ভাইয়ের গোস্ত খাবে না, তার ভাই হওয়ার কারণে, আর মৃত হওয়ার কারণে, তাহলে এর থেকে আরও বেশি তার অপছন্দ হওয়া দরকার মুসলমান ভাইয়ের নিন্দা করা। এখন তোমাদের কাজ হলো, কারও গীবত করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা। আর ভয় করা পরকালের কঠিন আযাবকে।’ (সূরা হুজরাত ১২, ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ)
সুতরাং প্রত্যেক কথা, কথার আকার-ইঙ্গিত, অথবা হাতের কোনো ইশারা, কোনো কাগজে বা ফেসবুকে অথবা অন্য কোনো ভাবে কারও গীবত করা সম্পূর্ণ হারাম।
হে ভাই! গীবত কিন্তু আপনার নেক আমল ধ্বংস করে দেবে। এখন আপনিই বলুন তো, আপনি কি গীবত করে করে আপনার নেক আমল ধ্বংস করে দেবেন? আপনার কি সাওয়াবের কোনো প্রয়োজন নেই? তাহলে গীবত ছাড়–ন। আর শুনুন, গীবত করা বন্ধ না করলে আপনি গীবত করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। গীবত করা আপনার রুটিনে পরিণত হবে। যা আপনি টেরও পাবেন না। বুঝতেও পারবেন না। তাই হুঁশিয়ার হোন। সতর্ক হোন। নিজের নেক আমল বাঁচান। তাই তো আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক চমৎকার বলেছেন, ‘তোমার যদি গীবত করতে মন চায়, তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে তোমার মায়ের গীবত করা। কেননা তোমার মায়ের গীবত করলে তোমার নেক আমলগুলো লেখা হবে তোমার মায়ের নামে। আর মায়ের উপকার করতে কে না চায়? সুতরাং মায়ের গীবত করে করে তোমার নেক আমল দিয়ে দাও তোমার মাকে। তাহলে তিনি পরকালে শান্তিতে থাকবেন তোমার নেক আমল পেয়ে। তোমার পুণ্য পেয়ে।
শুনুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি হাদীস, ‘হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ওপরে (মেরাজে) নিয়ে গেলেন, আমি সেখানে এমন লোকদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ তামার তৈরি। নখ দ্বারা তারা তাদের মুখমÐল ও বক্ষ খোঁচাচ্ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা?! হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন, এরা সেসব লোক, যারা মানুষের মাংস খায়, অর্থাৎ পরোক্ষ নিন্দা করে এবং মানুষের পেছনে লেগে থাকে।’ (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪৮৭৮)
প্রিয় পাঠক! এখন আপনি গভীরভাবে চিন্তা করুন, আপনি কি গীবত করবেন? গীবত করে পরকালে তামার নখ দিয়ে আপনার মুখমÐল খোঁচাবেন? আপনার বক্ষে আঘাত করবেন?
আমরা আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারলাম, যে গীবত করা একটি রোগ, মারাত্মক ব্যাধি, নিজেকে শেষ করার জন্য কুড়ালের মতো ধ্বংস বিনাশী। আর তা শরীর ধ্বংস করার থেকেও বেশি দ্রæত ধ্বংসকারী আখলাক-চরিত্র। গীবত সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। মুমিনদের পরস্পরের মাঝে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। শত্রæতা সৃষ্টি হয়। একে পরের মধ্যে মুহাব্বত-ভালোবাসা কমে যায়।
হে আমার মুসলিম ভাই! আপনি চিন্তা করুন, আপনি ভাবুন, আপনি কি গীবত ছাড়বেন না? আপনার পক্ষে কি সম্ভব আপনার ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া? কেননা কারও গীবত করার অর্থ হলো তার গোস্ত খাওয়া। আপনি কি পারবেন গীবত করে আপনার মুসলিম ভাইয়ের গোস্ত খেতে? অথবা যেখানে কারও গীবত করা হয়, সেখানে বসতে? তাদের সঙ্গে মৃতভাইয়ের গোস্ত খাওয়ায় শরীক হতে? যারা বসে বসে ছিড়ে ছিড়ে কোনো মুসলিম ভাইয়ের গোস্ত খাচ্ছে। যাদের সবার দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে আছে মুসলমানের গোস্ত। হে আল্লাহ! আমাদেরকে হিফাযত করুন কারও গীবত করা থেকে। কারও সমালোচনা থেকে। আমীন।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসা উলূমে শরী‘আহ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা- ১২০৪