সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আল্লামা পালনপুরীর প্রস্থান, যাই বলে অবেলায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবুল ফাতাহ কাসেমী।।

আমাদের এ শতকে যে কজন মনীষা জীবন জয় করে আরো হাজার বছর বেঁচে থাকবেন উস্তাদ মুহতারাম মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরী রহ. তাদের অন্যতম। শরিয়ত ও তরিকতের সমন্বয়ে দীনকে শেখড় থেকে বুঝতে পালনপুরী হুজুরের বিকল্প নেই। আমাদের মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরী রহ. এর জীবন চরিত এ সময়ের ইলম পিপাসুদের জন্য অনন্য সততায় প্রাসঙ্গিক।

মুফতি সাঈদ আহমদ পালানপুরী ১৩৬২ হিজরী মোতাবেক ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বনাস কাঁথা (উত্তর গুজরাট) মৌজা কালীত্রা জেলার বাসিন্দা। তার বাবা-মা তাকে ‘আহমদ’ নাম রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন মাদ্রাসা মাজাহির উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হোন তখন তিনি তার নামের শুরুতে ‘সাঈদ’ যুক্ত করেছিলেন, এইভাবে তার পুরো নাম দিয়েছিলেন ‘সাঈদ আহমদ’।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জন্মস্থান গুজরাটে শুরু করেন। তার পিতার কাছ থেকেই শুরু হয় ইলম অর্জন। এরপর গ্রামের মকতবে নাজেরা শেষ করে দারুল উলুম ছাপি তে প্রাথমিক করে কিতাবাদি পড়েন। অতঃপর তিনি নাজির আহমদ পালনপুরীর মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে (শরহে জামি) আরবি স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেখানে মুহাম্মদ আকবর পালানপুরী এবং হাশিম বুখারী তার বিশেষ শিক্ষক ছিলেন।

১৩৭৭ হিজরিতে তিনি মাজাহির উলূম সাহারানপুর মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে আরবি ব্যাকরণ, যুক্তি-দর্শন নিয়ে বেশিরভাগ কিতাব পড়েছিলেন। ১৩৮০ হিজরী মোতাবেক ১৯৬০ সালে দারুল উলূম দেওবন্দে আবার ভর্তি হন এবং হাদীস, তাফসির ও ফিকাহ ছাড়াও আরো উচু স্তরের অধ্যয়ন করেন। ১৩২৮ হিজরী অনুসারে ১৯৬২ সালে দাওরায়ে হাদীস পড়ে স্নাতক হন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় স্টার মার্ক অর্জন করেন।

পরের শিক্ষাবর্ষে তিনি (১৩২৮ হিজরী) ইফতা বিভাগে ভর্তি হন এবং ফতোয়া লেখার প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। ইফতার সমাপ্তির পরে ১৩৮৪ হিজরিতে দারুল উলূম আশরাফিয়া মাদ্রাসায় (সুরত) শিক্ষক নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি প্রায় দশ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারপরে ১৩৯৩ হিজরিতে দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সম্মানিত সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ মনজুর নোমানীর পরামর্শে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষক পদে নির্বাচিত হন এবং তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দারুল উলূমে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। দারুল উলূমে তহাবি, তিরমিযি, বুখারি শরিফসহ অসংখ্য হাদিস, ফেকাহ পাঠদান করেন।

তার দারস অত্যন্ত জনপ্রিয় ও চিত্তাকর্ষক এবং তথ্যেপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা তার বক্তৃতার নোট নেয়ার প্রবণতা রাখতো শুরু থেকেই। তাঁর বক্তব্য এতটাই স্থির এবং এত স্বচ্ছ যে দারুল উলূমের সাবেক শায়খুল হাদীস এবং সদর-উল-মুদাররিসিন আল্লামা নাসির আহমদ খান (১৪২৯ হিজরী ২০০৮) নিজের অসুস্থতার কারণে বুখারী শরীফের পাঠদানের গুরু দায়িত্ব হুজুরকে অর্পণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেওবন্দের শাইখুল হাদিস পদে সমাসীন ছিলেন।

ব্যক্তি যখন ব্যক্তিত্বের ব্যপ্ততা, চিন্তার গভীরতা, জ্ঞান ও বৈশ্বাসিক দৃঢ়তায় জয়ী হন তখন তিনি ‘আমাদের’ না হয়ে হয়ে উঠেন সবার। এমন সবার একজন আল্লামা পালনপুরী। বর্তমান বিশ্বে ইশারা করে দেখানো হয় এমন ইলমী ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রথম সারির একজন আল্লামা সাইদ আহমদ পালনপুরী।

হিমালয় জয়ের সাধনায় যিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন একটি ইলমী প্রতিষ্ঠানে। কালের এ শতকে ইলমী দুনিয়ায় বিখ্যাত হওয়া পালনপুরীর গল্পের শুরুটা ছিল এমন আল্লামা কাশ্মিরী রহ. এর প্রখ্যাত শাগরিদ মাওলানা বদরে আলম মিরাঠীর শিষ্য বাবা ইউসুফ এর আশা ছিল পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলে হাকীম হবে। মাদরাসায় ফ্রি পড়াবে আর সংসার চালাবে ডাক্তারি পয়সা দিয়ে।দাওরা পাশ করার পর বাবা মওলবি সাইদকে তিব্বিয়া কলেজে ভর্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করলেন। ছেলেও নাছোড়বান্দা। বাবাকে কোন মতে বুঝিয়ে চলে এলেন মাদরাসায়। জীবন উৎসর্গ করলেন ইলমের পেছনে। তাকাননি পেছনে ফিরে। সেই মওলবি সাইদ এখন সবার পালনপুরী হুজুর।

পৃখিবীখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস, বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার, ফকীহ আলিম মুফতী সাইদ আহমদ পালনপুরী এর বর্তমান সময় কাটে কিতাব নিয়ে। প্রয়োজনের পর বাকিটা সময় বুঁদ হয়ে থাকেন কিতাবের পিঠে। যেন তিনি কালো হরফের রাখাল। ১৩৯৩ হিজরী থেকে (১৪৩৯ হিজরী) আজ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দেওবন্দের হাদীসের মসনদে দরস দিয়ে আসছেন।

অধ্যাপনা, ইলমী গবেষণা ও আধ্যাত্মিকতা চর্চায় ব্যস্ত থকেন সব সময়। রমজানসহ ছুটির সময়ে বুরতানিয়া, কানাডা, ইউরোপ আমেরিকা, লন্ডনসহ পৃখিবীর বিভিন্ন দেশে ছুঁটে যান দীন দাওয়াতের মেহনত নিয়ে। তার ঐতিহাসিক কীর্তির মধ্যে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর বিখ্যাত কিতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ’ অমর কীর্তি।

তাছাড়া তিনি হেদায়েতুল কুরআন, আপ ফতোয়া কেইছে দেঁ, তাহসিল আদিল্লায়ে কামেলা, ইফাদাতে নানুতবি, ইফাদাতে রশিদিয়া, তুহফাতুল কারী (বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ), তুহফাতুল আলমায়ী (তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ) সহ ছোট বড় প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি ইলমী অভিসন্দর্ভ, কিতাব রচনা করেন।

উস্তাদে মুহতারাম মুফতী পালনপুরী আমাদের প্রবীন অনেক আকাবিরগণের সুহবতে থেকেছেন দীর্ঘ দিন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ মাওলানা আবদুল কাদীর রায়পুরী ও শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ. এর সুহবতে থেকেছেন অনেকটা সময়। ভারতের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মাযাহেরুল উলুম সাহারানপুর মাদরাসার প্রখ্যাত পীর মাওলানা মুফতী মুযাফফর হুসাইন রহ. থেকে খেলাফতও লাভ করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার সময় অনেক স্বপ্ন নির্মাণ করতাম হুজুরকে নিয়ে। বহুগুনের এমন ব্যক্তিকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা কোথায় আমাদের। যার চয়িত গভীরতা এবং বয়িত আলোচনা এ সময়ে অনেকটা বিরল। আপাদমস্তক দেওবন্দি চেতনায় আপ্লুত হিরণ্নয় জীবনের অধিকারী উস্তাদে মুহতারামের ভাষা ঝরঝররে। কথায় মনোযোগ কাড়ে।

উপমহাদেশের ইলমী অঙ্গনে কঠিন বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপনার জন্য তার বিশেষ প্রসিদ্ধি রয়েছে। তার সামান্য আলোচনায়ও ইলমী বিভা ঝরতে থাকে। তিনি তার শুরু জীবনে ‘ইফাদাতে নানুতবী’ কিতাব রচনার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও শেষে এসে হিকমাহ তথা দর্শন শাস্ত্রে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর কালজয়ী কিতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ’ লিখে দুনিয়ার আহলে ইলমদের দৃষ্টি কাড়েন। এজন্য দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরা তাকে রেজুলেশনের মাধ্যমে বিশেষ সম্মানে ভুষিত করেন। এমন শত গুনের অধিকারী আমাদের উস্তাদে মুহতারাম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস মুফতী সাইদ আহমদ পালনপুরী।

বিশেষণের পর বিশেষণ এমন ক্লান্তিকর কাব্যিকতায় না গিয়ে এক বাক্যে বলি তিনি আমাদের প্রবীন আকাবিরের জীবন্ত নমুনা। দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন (একাডেমিক প্রধান) ও শুরা সদস্য মুফতী সাহেব হুজুর বিশ্বের ইলমী অঙ্গনে তার ইলমের কারণে এক অনন্য নযির স্থাপন করেছেন। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে তার হাজার হাজার ছাত্র ভক্ত ও শুভাকাঙ্খিবৃন্দ। বাংলাদেশেও তার ছাত্র ভক্তদের সংখ্যা শত শত। উস্তাদে মুহতারাম এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কখনও ক্লাস মিস করেন না। এমন কি ক্লাস মিস হবে এজন্য তিনি উমরাতেও যান না। এজন্য তিনি রমজান ছাড়া দেশের বাইরে কোন প্রোগ্রামে সচারচর উপস্থিত হন না।

এ বছর রমজানের শুরুতে হুজুর কে স্বপ্নে দেখেছিলাম। প্রতি রমজান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করলেও এবার হুজুর ভারতের মুম্বাইতে অবস্থান করেন। প্রথম রমজান থেকে বার রমজান পর্যন্ত প্রতিদিন তারাবির পর হুজুর তাফসিরের মজলিস করতেন। আমি বার রমজান পর্যন্ত নিয়মিত হুজুরের তাফসির শুনেছি। তের রমজান হঠাৎ করে হুজুর অসুস্থ হয়ে পড়লে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কয়েকদিন যাবত শরীরের অবনতি হতে থাকে। আর আজ চাশতের সময় ইলমি জগতের এ মুকুটহীন সম্রাট লক্ষ লক্ষ ভক্তকুলকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চলে যান না ফেরার পথে। আপন প্রভুর একান্ত কাছে।

বহমান এ নষ্টালজিক সময়ে আল্লামা পালনপুরীর এ বিয়োগ কখনো পূরণ হবার নয়। আজ এখন এ মহান মনীষীর জীবনালেখ্য যাই বলে অবেলায়।

লেখক; আল্লামা পালনপুরীর শাগরেদ, লেখক, শিক্ষক ও অনুবাদক

-ওআই/আব্দুল্লাহ আফফান


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ