আল আমিন: মহিমান্বিত মাস রমাজান। মুমিনের আমলের ভরা বসন্ত। এ বসন্তের পবিত্র পরশে সেজে ওঠে মুমিনের আমলের সোনালী জীবন। মাহে রমজানের প্রতিটি আমলের পরতে পরতে মুমিনের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে ফেরে তৃপ্তির খোরাক। রমজানের শেষ দশকে ফজিলতপূর্ণ ই'তিকাফ সে আমলি ধারাবাহিকতায় যোগ করে নতুন মাত্রা।
টানা দশদিন মসজিদের নিভৃত কোণে সাময়িক বৈরাগ্য বান্দা কে নিয়ে যায় স্রষ্টার সান্নিধ্যের অনন্য উচ্চতায়। আমলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ তাৎপর্য ও মাহাত্ম্যবহ। যুগশ্রেষ্ঠ প্রাজ্ঞ মনীষীগন ই'তিকাফের বহু তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।
১। ইমাম যুহরী রহ. ই'তিকাফের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন— 'আমি মানুষের প্রতি বড়ো আশ্চর্য হই, তারা ই'তিকাফ করা ছেড়ে দেয়। অথচ বহু কাজ এমন আছে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো করেছেন কখনো ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু ই'তিকাফ এমন একটি আমল যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমনের পর থেকে মৃত্যু অবধি কখনো ছাড়েন নি। (বাদায়িউস সানায়ে : ২/১০৮)
২। আল্লামা হাফেজ ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ রহ. ই'তিকাফের তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো—নিবিড় ঐকান্তিকতায় আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর স্মরণে নির্জন বাস করা এবং স্রষ্টার পরম সান্নিধ্য লাভের প্রত্যাশায় সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা, যাতে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনের একান্ত গহীনে স্থান করে নিতে পারে।’ (যাদুল মা'আদঃ ২/৮২-৮৩)
৩। আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেছেন ‘ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো— সৃষ্টির সাথে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার
সাথে নিবিড় সম্পর্ক কায়েম করা। মহামহিম স্রষ্টার সাথে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা তত গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি স্রষ্টার কাছে নিয়ে যাবে।’ (লাতাইফুল মা'আরিফ, পৃঃ ৪০)।
৪। আতা আল-খুরাসানী রহঃ বলেছেন— “ইতিকাফকারীর উদাহরণ সে বান্দার মত, যে নিজেকে আল্লাহর সামনে পেশ করে বলছে— হে আল্লাহ যতক্ষণ না তুমি ক্ষমা কর, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না, হে আমার রব, যতক্ষণ না তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমি তোমার দরবার ত্যাগ করব না”। (শারহু ইবনিল বাত্তাল আলাল বুখারী: ৪/১৮২)
৫। মালিকুল উলামা ইমাম আলাউদ্দীন কাসানী রহঃ বলেছেন— ইতিকাফ হলো—দুনিয়ার সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে নির্জনে আল্লাহর ঘরে বসে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা এবং তাঁর অবারিত রহমত ও ক্ষমা লাভের প্রত্যাশায় একান্তভাবে তাঁর দিকে ধাবিত হওয়া।' (বাদায়িউস সানায়ে: ২/১০৮)
৬। ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেছেন— ‘মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ: ২/৪২)
৭। ইমাম হাসান ইবনে আম্মার আশশুরুমবুলালী রহ. বলেছেন— 'ই'তিকাফ যদি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন হয় তাহলে তা উত্তমতম ইবাদাত। ই'তিকাফের বৈশিষ্ট্য নানাবিধ। ই'তিকাফকারী তার অন্তর কে দুনিয়া ও তার যাবতীয় বিষয়াদি থেকে মুক্ত করে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করে এবং নিজেকে মহাবিশ্বের অধিপতির দরবারে ফেলে রাখে। (মারাক্বিল ফালাহ: ১/২৬৮)
৮। আরব বিশ্বের খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন শায়খ ইবনে উসাইমীন রহ. ই'তিকাফের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন— ' ই'তিকাফের উদ্দেশ্য হলো— আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহ, অফুরন্ত পূন্য ও শবে ক্বদর লাভের প্রত্যাশায় মানবজগত থেকে সাময়িক বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহের কোনো এক মসজিদে বসা যাওয়া। এজন্য ই'তিকাফকারীর উচিত যিকর, তিলাওয়াত, নামাজ ও অন্যান্য ইবাদাতে লিপ্ত থাকা এবং অহেতুক দুনিয়াবী কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা।' ( মাজালিসু শাহরি রমাদান, পৃঃ ১০২)
৯। হাকিমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন— " প্রথমত ই'তিকাফের উদ্দেশ্য হলো— শবে ক্বদর তালাশ করা, দ্বিতীয়ত— নামাজের জামাতের জন্য অপেক্ষা করা, তৃতীয়ত ই'তিকাফের রূহ তথা মৌল উদ্যেশ্য হলো— ই'তিকাফকারী যেন নিজেকে সর্বহারা অসহায় ও নিঃস্ব বানিয়ে মহান বাদশাহ আল্লাহর দরবারে নিজেকে পেশ করে এই বলে বলে নিজের সর্বোচ্চ মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে যে— হে আল্লাহ এখন আমি আপনার পবিত্র দরবারে পড়ে আছি, চাইলে বের করে দিন, না হয় আমাকে ক্ষমা করে দিন।
এটা হলো নিজেকে মিটিয়ে দেওয়া। আর তৃতীয় বিষয়টিকে ই'তিকাফের রূহ এজন্য বলা হলো, কেননা ই'তিকাফ অন্য কোনো ইবাদাতের ওপর নির্ভরশীল নয়, যদি ই'তিকাফকারী ই'তিকাফরত অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট ইবাদাত নাও করে তারপরেও সে ই'তিকাফের পূর্ণ প্রতিদান পাবে। আল্লাহর দরবারে পড়ে থাকাটাই বড়ো ব্যাপার। আর এটা এমন দামী জিনিস যা বিতাড়িত ব্যক্তিকেও আল্লহর প্রিয়পাত্রে পরিণত করে।
(আহকামে ই'তিকাফ : ১৬)
১০। বর্তমান বিশ্বের সর্বজন শ্রদ্ধেয় খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন মুফতী তকী উসমানী দা. বা. বলেছেন— ' আল্লাহ ইবাদাতের যে পদ্ধতিগুলো বলে দিয়েছেন তার মধ্যে কিছু পদ্ধতি একান্তই প্রেমসূলভ। তার মধ্যে ই'তিকাফ একটি। ই'তিকাফকারী ব্যক্তি পৃথিবীর সামগ্রিক বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর মসজিদে পড়ে থাকে। নিজেকে আল্লাহর সমীপে সঁপে দেয়।
দীর্ঘ একটি সময় পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়ার দরুন যে বিশেষ প্রমের বন্ধন সৃষ্টি হয় তা আসলেই একটি অনন্য ব্যাপার। (আহকামে ই'তিকাফ: ৬)। আল্লাহ আমাদের নেক কাজে অগ্রগামী করুন! আমীন!
শিক্ষার্থী, ইফতা বিভাগ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া।
-এটি