হাফেজ মাওলানা মূসা আল-কাযীম।।
হাদীস শরীফে রমজানের ত্রিশ দিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের আর সর্বশেষ দশক নাজাত বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির ৷ সেই ধারাবাহিকতায় রহমতের দশক পেরিয়ে আমরা মাগফিরাতের দশক অতিবাহিত করছি ৷
মাগফিরাত অর্থ হচ্ছে ক্ষমা করা আর ইস্তিগফার অর্থ হচ্ছে ক্ষমা চাওয়া ৷ স্বাভাবিকত মাহে রামাদানের প্রত্যেকটি মুহুর্তই বিশেষ বারাকাত ও ফজীলতে ভরপুর যারফলে মুমিন কর্তৃক প্রতিটি মুহুর্তই আল্লাহর বিশেষ রহমত ও ক্ষমা কামনা করা সৌভাগ্যের হাতছানি ৷
বিশেষ করে সময়টা যেহেতু মাগফিরাতের চলছে তাই আরো বেশি মাগফিরাত কামনা করা কাম্য ৷ আমাদের জীবনে প্রত্যেকটা মানুষেরই কম বেশি পাপ রয়েছে ব্যতিক্রম শুধু নবী-রাসূলগণ তাদের জীবনে কোন গুনাহ ছিলনা তারা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত নিষ্পাপ নৈকট্যশীল প্রিয় বান্দা৷ যাদের জীবনে পুর্বাপর কোন গুনাহ ছিলনা ৷
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন ৷ শয়তান সর্বদা বনী আদমের পিছু লেগে থাকে কি করে তাকে স্রষ্টার সান্নিধ্য থেকে বিমুখ করে পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে রাখা যায় ৷ অপরদিকে প্রকাশ্য দুশমন শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর ও বিপজ্জনক হচ্ছে "নফস" নামক অদৃশ্যমান দুশমন ৷
ইবলিস ও নফস উভয়টিই বনী আদমের জন্য কল্যাণের পথে অন্তরায় ৷ দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য পেতে উভয় দুশমন থেকেই বনী আদমকে বেঁচে থাকতে হবে ৷ তবেই সাফল্যের নাগাল পাওয়া যাবে ৷ ইরশাদ হচ্ছে শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহবান করে যেন তারা জাহান্নামী হয়।
সূরা ফাতির,আয়াত ৬
ইরশাদ হচ্ছে হে ঈমানদার গন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সূরা বাকারা,আয়াত ২০৮
ইরশাদ হচ্ছে নিশ্চয় মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ ৷ কিন্তু সে নয়-আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার পালনকর্তা ক্ষমাশীল, দয়ালু। সূরা ইউসুফ,আয়াত ৫৩
মানুষের জীবনে গুনাহ একটি মজ্জাগত ব্যাপার ৷ কিন্ত বারংবার গুনাহ করে যাওয়া আর গুনাহের উপর অনুতপ্ত না হওয়া দুর্ভাগার লক্ষণ ৷ মুমিনতো সর্বদা আল্লাহর ভয়ে তটস্হ থাকবে অগত্যা কোন গুনাহ হয়ে গেলে তৎক্ষনাত অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসবে মহান মালিকের রহমতের ছায়াতলে ৷
ইরশাদ হচ্ছে আর তোমাদের পালনকর্তার কাছে মার্জনা চাও এবং তাঁরই পানে ফিরে এসো নিশ্চয়ই আমার পরওয়ারদেগার খুবই মেহেরবান অতিপ্রেমময় ৷ সূরা হুদ,আয়াত ৯০
আল্লাহর প্রত্যকটি সৃষ্টি আল্লাহর কুদরতি দৃষ্টিসীমার মধ্যেই রয়েছে ৷ তদুপরী বনী আদমের দুই স্কন্ধে তো দুই ফেরেশতা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেই যাচ্ছেন ৷ ইরশাদ হচ্ছে যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফয়সালা খুবই মন্দ। সূরা আনকাবুত,আয়াত ৪
ইরশাদ হচ্ছে যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে।সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে ৷ সূরা ক্বাফ,আয়াত ১৭,১৮
মহান আল্লাহ তা'য়ালা তাওবাকারীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং তাওবাকারীর জন্য রেখেছেন ক্ষমা ও আখিরাতের পুরষ্কার ৷ ইরশাদ হচ্ছে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবা কর-আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ নবী এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। তারা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর সর্ব শক্তিমান। সূরা তাহরীম,আয়াত ০৮
হাদীস শরীফে শতখুনের আসামিকেও মহান করুনাময় মালিক কর্তৃক ক্ষমার ঘটনা রয়েছে এমনকি নিজ কন্যা সন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা পিতার তাওবা কবূলের ঘটনা রয়েছে ৷ জঘন্য এক ব্যক্তি যিনি মৃত মহিলার সাথে যিনায় লিপ্ত হয়েছিলেন নবীজী (সাঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে এ পাপের বর্ণনা দেয়ার পরে আল্লাহর নবী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তৎক্ষনাত আল্লাহ তা'য়ালা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন খাঁটি মনে তাওবা করলে তার জন্য ক্ষমার সুসংবাদ রয়েছে ৷ সুবহানাল্লাহ
রাসূলে আকদাস সা. এর জীবনে কোন গুনাহ ছিল না তারপরেও তিনি দৈনিক সত্তরবার কোন বর্ণনায় একশত বার ইস্তিগফার করতেন তাহলে পাপের সাগরে ডুবে থাকা জীবনের জন্য আমাদের কি পরিমাণ তাওবা ইস্তিগফার করা চাই তা সহজেই বোধগম্য৷
প্রত্যেক গভীর রজনীতে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বান্দাকে তার গুনাহ মুক্তির জন্য আহ্বান করে থাকেন আর পবিত্র মাহে রামাদানে দৈনিক অসংখ্য জাহান্নামীকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় হাদীসের বাণী আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রামাদানের প্রথম রাতে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় এবং জাহান্নামের সব কয়টি দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের সব কয়টি দরজা খুলে দেওয়া হয়। একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণকামী, অগ্রসর হও এবং হে মন্দপ্রত্যাশী, সংযত হও। (রমজানের) প্রতি রাতে আল্লাহ কিছু জাহান্নামিকে মুক্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) রামাদান মাসে দোয়া কবুল ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করা যায় এমন কাজে মনোযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতি ইফতারের সময় অর্থাৎ প্রতি রাতে বেশসংখ্যক লোককে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
তাওবা ইস্তিগফার শুধু মুখে মুখে করলেই হবে না তার জন্য রয়েছে কতিপয় শর্ত যদ্বারা একজন মুমিন তার জীবনের গুনাহ ক্ষমার সুসংবাদ পেতে পারে ৷ প্রথমত তাওবাকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই তাওবার প্রাক্কালে কৃত গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে দ্বিতীয়ত নিজের অন্তরে অনুশোচনাবোধ জাগ্রত করতে হবে এবং লজ্জিত হতে হবে (হায় কি করলাম ! ) তৃতিয়ত ভবিষ্যতে এই গুনাহ কোনদিন করবনা মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে তাহলেই কেবল ক্ষমা পাওয়ার আশা করা যেতে পারে অন্যথায় শুধু মৌখিক প্রলাপ তামাশার নামান্তর৷
অপরদিকে হুকুকুল ই'বাদ (বান্দার হক) সংশ্লিষ্ট হক্বদারকে যতক্ষণে তার হক্ব বুঝিয়ে দিবে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে যেমন কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া,কাহারো পাওনা পরিশোধ না করা ইত্যাদী ততক্ষণে হক্ব নষ্টকারীর তাওবা বা তার দায়মুক্তি গ্রহণযোগ্য হবেনা ৷
দৈন্দিন জীবনে নবীজী (সাঃ)অসংখ্যবার ইস্তিগফার করতেন ৷ নবীজী (সাঃ) বলেন যে ব্যক্তি "আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজী লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হায়্যিয়ুল ক্বায়্যুম ওয়াতূবু ইলাইহি" পড়বে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে যদিও সে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়নের মত জঘন্য পাপও করে থাকে ৷ নবীজী সাঃ আরো বেশি বেশি যে ইস্তিগফার পড়তেন তা হচ্ছে "আসতাগফিরুল্লাহা ওয়াতূবু ইলাইহি" ৷
সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাপ মোচনের হাতিয়ার ৷
নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সন্ধ্যায় সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায়, তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুবহানাল্লাহ -সহীহ বুখারী
সায়্যিদুল ইস্তিগফার> আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা। ওয়া আনা আলা আহদিকা। ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাতা’তু। আউজু বিকা মিন শাররি মা-সানা’তু। আবুয়ু লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগফিরলী। ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনবা ইল্লা আনতা।
আসুন পবিত্র মাহে রামাদানে অন্য সময়ের চেয়ে অধিক পরিমাণে তাওবা-ইস্তিগফার করে কালিমাচ্ছন্ন আত্মার অমানিশা দুর করি ৷ মৃতপ্রায় আত্মাকে জাগিয়ে তুলি তাওবার পরশে৷
লেখক: শিক্ষক,তেজগাঁও রেলওয়ে জামিয়া ইসলামিয়া। খতীব, নূরে দারূসসালাম জামে মসজিদ বিজি প্রেস সংলগ্ন, শিল্পাঞ্চল, তেজগাঁও।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম