ইলিয়াস আহমদ।।
পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ধনসম্পদ সবকিছু থেকে পৃথক হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট কিছু সময় মসজিদে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে।
মর্যাদাগত দিক দিয়ে ইতেকাফ তিন প্রকার।
১.ওয়াজিব ইতেকাফ: কোনো বিষয়ে নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট সময় ইতেকাফের মানত করার কারণে যে ইতেকাফ করা হয়, সেটা হল ওয়াজিব ইতেকাফ।
২. সুন্নত ইতেকাফ: রমজানের শেষ দশকে, অর্থাৎ ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব হতে শাওয়ালের চাঁদ দেখা পর্যন্ত যে ইতেকাফ করা হয়, সেটাকে সুন্নত ইতেকাফ বলে। (যা মসজিদের পক্ষ থেকে একজনে আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কেউ না করলে সকলেই সুন্নাত তরকের কারণে গুনাহগার হবে।)
৩. নফল ইতেকাফ: এটা বছরের যেকোনো সময়, যেকোনো মেয়াদে করা যায়। মসজিদে ঢোকার সময় ইতেকাফের নিয়ত করলেই হয়ে যায়।
ইতেকাফের তাৎপর্য
ইতেকাফের তাৎপর্য অতি নিগূঢ়। ইতেকাফ মানে দুনিয়ার শত ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরিবার-পরিজন থেকে পৃথক হওয়া। আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক অর্জনের উদ্দেশ্যে বন্ধুবান্ধব ও ধন-সম্পদ সবকিছু ত্যাগ করা।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল কায়্যিম রাহ. এতেকাফের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা। তাঁর সাথে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা। যাতে তাঁর চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে।
পূর্ববর্তী সকল যুগেই ইতেকাফের ব্যপক প্রচলন ছিল। রমজানে মানুষ দলবেঁধে মসজিদে ইতেকাফে বসতো। আমাদের সালাফের প্রত্যেক ফকিহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও বুযুর্গানে দ্বীনের মাঝে ইতেকাফের বেশ চর্চা ছিল। তাঁরা এটাকে গনিমত মনে করতেন। ইতেকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাদি.-ও রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। মহিলা সাহাবারা নিজেদের ঘরে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন রমজানে ইতেকাফ করেছেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদি. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীরা ইতেকাফ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
কাবা শরীফ নির্মাণের পর আল্লাহ তাআলা হযরত ইব্রাহিম আ. -এর কাছ থেকে ইতেকাফকারীদের জন্য কাবা ঘর পবিত্র রাখার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। যা তিনি পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন, "আর আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইল থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আমার ঘর তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুক-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।। (সুরা হাজ-২৫)
ইতেকাফের ফযিলত
ইতেকাফের এর চেয়ে বড় ফযিলত আর কী হতে পারে যে, এটা নবী কারীম সাল্লাহু সাল্লামের বড় একটি সুন্নত; তিনি সারা জীবন রমজানে ইতেকাফ করেছেন। তাছাড়াও ইতেকাফের অনেক ফযিলত রয়েছে।
১. ইতেকাফকারী নিশ্চিতভাবে শবে কদর লাভ করে। আবশ্যিকভাবে অর্জন করে এই রাত্রের যাবতীয় ফযিলত। যে রাত্রকে হাজার মাস অপেক্ষায় উত্তম বলা হয়েছে। আর মূলত এই রাত্রটি তালাশের জন্যই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে ইতেকাফ করতেন।
২. মুতাকিফের ২৪ ঘণ্টাই ইবাদতে কাটে। সে ঘুমিয়ে থাকুক বা অন্য কোনো কাজ করুক -সর্বাবস্থায় ইবাদতের সওয়াব লাভ করে।
৩. ইতেকাফকারী সমস্ত গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। যেমনটি সুনানে ইবনে মাযাহর একটি হাদীস থেকে জানা যায়,মুতাকিফ সমস্ত গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং (আমল না করা সত্ত্বেও) নেক আমলকারীদের মত তাকে প্রতিদান দেওয়া হয়।
যদিও সনদের দিক থেকে হাদিসটি যয়িফ; দুর্বল। তবে তার গুনাহমুক্ত থাকার বিষয়টি একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায়। ইতেকাফরত অবস্থায় স্বার্বক্ষণিক মসজিদে অবস্থান করায় সে সামাজিক অনেক অশ্লীল কাজ-কর্মে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এতে করে সে অনেক গুনাহ থেকে বেঁচে যায়।
আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা রমজান পেয়েছি। রহমতের দশদিন শেষ। মাগফেরাতের দশদিনও চলে যাচ্ছে। সামনে আসছে নাজাতের দশদিন। যেটা ইতেকাফের সময়। আসুন, রমজানের সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে ইতেকাফের নিয়ত করি। আল্লাহ্ আমাদের তাওফিক দিন।
-এটি