শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ঢাকাস্থ চাঁদপুর ফোরাম এর সেতুবন্ধন সভা অনুষ্ঠিত অর্থবহ সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়: প্রিন্সিপাল মোসাদ্দেক বিল্লাহ বিস্ময়কর হাফেজ শিশুর সঙ্গে শায়খ আহমাদুল্লাহ মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক

মহিমান্বিত মাসে দোয়া কবুলের মুহূর্তগুলো অবহেলায় কেটে যাচ্ছে না তো?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ আল আমিন।।

রমজান মাস স্রষ্টার সমীপে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মাস। অবারিত রহমত বরকত ও ক্ষমায় সিক্ত হওয়ার মাস। মহান স্রষ্টার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে চেয়ে নেওয়ার মাস। বিশ্ব জাহানের অধিকর্তার দরবারে নিজের চাওয়াগুলো একান্তে পেশ করার মাস। প্রভূর দরবারে চাওয়াটাও একটি স্বতন্ত্র ইবাদাত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—" الدُّعَاءُ مُخُّ الْعِبَادَةِ অর্থাৎ দোআ করা (চাওয়া) শুধু ইবাদাত নয় বরং ইবাদাতের মগজ। (তিরমিজিঃ ৩৩৭৭)

বান্দা যখন আল্লাহ কে ডাকে আল্লাহ সে ডাক শোনেন, সাড়া দেন। বান্দা চাইলে তিনি খুশি হন, না চাইলে রাগ করেন।

কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বলেছেন— ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ অর্থাৎ, "তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। (সূরা মু'মিনঃ ৬০)
অন্য আরেক আয়াতে বলেছেন— وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ" অর্থাৎ, যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিগ্যেস করে, (বল) আমি নিকটেই, আমি আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দিই যখন সে আমাকে আহ্বান করে।" (সূরাঃ বাকারাহ- ১৮৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
من لم يسأل الله يغضب عليه
অর্থাৎ—"যে আল্লাহর নিকট চায় না আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হন।" (তিরমিযীঃ ৩৩১৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৬৬১৮)

মহান আল্লাহর শাহী দরবার বান্দার জন্য সদা উন্মুক্ত। তিনি সবসময় সবার প্রার্থনা শোনেন, সাড়া দেন। দিন-রাতের যেকোনো সময় বান্দা তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে পারে। তারপরেও প্রতিশ্রুত কিছু মুহূর্ত আছে, যে মুহূর্তগুলোতে আল্লাহ তা'য়ালা বান্দার দু'আ সবিশেষ কবুল করে থাকেন। এমন বেশ কয়েকটি মুহূর্তের কথা প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। পবিত্র রমজানের সে মুহূর্তগুলো প্রভূর দরবারে কৃত গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং নিজের প্রয়োজনের কথাগুলো তার কাছে পেশ করার সুবর্ণ সুযোগ।

১/ রাতের শেষ প্রহর

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "
(عن أبي هريرة رضي الله عنه، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال:) " ينزل ربنا تبارك وتعالى كل ليلة إلى السماء الدنيا، حين يبقى ثلث الليل الآخر، يقول : من يدعوني فأستجيب له ؟ من يسألني فأعطيه ؟ من يستغفرني فأغفر له ؟ ".
অর্থঃ আমাদের মহামহিম প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন— কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (বুখারীঃ ১১৪৫, মুসলিমঃ ৭৫৮)

বছরের অন্য সময়ে রাতের শেষ প্রহরটা কেটে যায় ঘুমের ঘোরে। আলস্যের চাদর ছেড়ে জাগ্রত হওয়া জাগ্রত হওয়া অনেকের জন্যই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

কিন্তু রমজানে সে সময়টাতে আমরা সাহরীর জন্য জাগ্রত হই। একটু চেষ্টা করলেই মহামহিম আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা সে স্বর্ণ–সময়টাতে নিজেদের কৃত অন্যায়গুলোর জন্য ক্ষমা চাইতে পারি, মনের সুপ্ত বাসনাগুলো স্রষ্টার নিকট একান্তে পেশ করতে পারি। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে ই অলসতা ও অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়
মূল্যবান এ সময়টি ।

২/ ইফতারের পূর্বমুহূর্ত

সারাদিনের ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর, শুকনো মুখ, অভুক্ত উদর, ক্ষুধার্ত চোখ আর রকমারী সুস্বাদু খাবার সামনে নিয়ে যখন বান্দা স্রষ্টার হুকুমের অপেক্ষায় বসে থাকে তখন সে দৃশ্যটি দেখে তিনি বড়ো খুশি হন। সে সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ খালি হাতে ফেরিয়ে দেন না।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন— (عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :) " ثلاثة لا ترد دعوتهم ؛ الصائم حتى يفطر، والإمام العادل، ودعوة المظلوم يرفعها الله فوق الغمام، ويفتح لها أبواب السماء، ويقول الرب : وعزتي لأنصرنك ولو بعد حين ".
অর্থঃ তিন ব্যক্তির দু'আ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ইফতারের পূর্বে রোজাদারের দু'আ, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দু'আ ও অত্যাচারিত ব্যক্তির দু'আ।

আল্লাহ তা'য়ালা তা (দু'আ) মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন। তার জন্য আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেন এবং আল্লাহ বলেন— আমার ইজ্জতের শপথ! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব, যদিও তা বিলম্বে হয়। (তিরমিযীঃ ৩৫৯৮, মুসনাদে আহমাদঃ ৮০৪৩)

দুঃখজনকভাবে আমরা কেউ কেউ দু'আ কবুলের প্রতিশ্রুত এ সময়টি ইফতারের আয়োজন করতে করতেই কাটিয়ে দিই। অবহেলা ও অসচেতনায় চাওয়া-পাওয়ার এ সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়া করে ফেলি।

হাত উঠিয়ে দো'আ করার সুযোগ না হলেও অন্তত মনে মনে يا واسع الفضل اغفرلي দো'আটি পড়তে পারি। হাদীসে এসেছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারের সময় এ দো'আটি পড়তেন। (শুয়াবুল ঈমানঃ ৩৬২০)

৩/ ফরজ নামাজের পর

ফরজ নামাজের পর দো'আ কবুল হওয়ার কথা নির্ভরযোগ্য একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

عن أبي أمامة قال : قيل : يا رسول الله صلى الله عليه وسلم، أي الدعاء أسمع ؟ قال : " جوف الليل الآخر، ودبر الصلوات المكتوبات ".
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোন দোয়া সর্বাধিক শোনা (কবুল করা) হয়?’
তিনি বললেন: ‘রাত্রির শেষভাগে এবং ফরজ নামাজসমূহের শেষাংশে।’ (তিরমিযীঃ ৩৪৯৯, আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ীঃ ৯৯৩৬, আত তারগীব ওয়াত তারহীবঃ ২/৩৯৬)

মুমিন-মুসলমান বিশেষত রমজানে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের পরম আগ্রহ নিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ায়। নামাজান্তে অকৃত্রিম তৃপ্তির আবেশে জড়িয়ে থাকে খানিকটা সময়। অপার্থিব এক প্রশান্তির ছোঁয়ায় সিক্ত হয়ে ওঠে মুমিনের অন্তরাত্মা। কোমল সে হৃদয়ের গহীন থেকে যখন স্রষ্টার দরবারে কোনো আকুতি পেশ করা হয়, স্রষ্টা তা ফিরিয়ে দেন না।

৪/ আযান ও ইক্বামাতের মধ্যবর্তী সময়

عن أنس بن مالك قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : " الدعاء لا يرد بين الأذان والإقامة ". قالوا : فماذا نقول يا رسول الله ؟ قال سلوا الله العافية في الدنيا والآخرة রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে কৃত দোয়া কখনই ফিরিয়ে দেয়া হয় না।

তারা (সাহাবাগন) বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কী বলে দো'আ করব? তিনি বললেন— তোমরা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তা কামনা করো।’ (তিরমিজি : ৩৫৯৪, আবু দাউদ : ৫২৫, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী : ১/২৬২)

মুআজ্জিন যখন সালাতের দিকে ও কল্যানের দিকে আহ্বান করতে থাকে, তখন সে পবিত্র আহ্বানে সাড়া দিয়ে কালবিলম্ব না করে মুমিনের উচিত মসজিদপানে গমন করা। পবিত্র হয়ে নামাজের অপেক্ষায় বসে বসে স্রষ্টার তরে প্রার্থনা জানানো।

৫/ সিজদার মধ্যে

عن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم
قال أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد، فأكثروا الدعاء অর্থঃ আবু হুরাইরাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—"বান্দা সিজদা অবস্থায় স্বীয় প্রভুর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়। অতএব, তোমরা অধিক মাত্রায় (ঐ অবস্থায়) দোয়া করো।" (মুসলিম :৪৮২, নাসায়ী: ১১৩৭, আবু দাউদ: ৮৭৫, মুসনাদে আহমাদ: ৯১৬৫)।

ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে— রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন
وأما السجود فاجتهدوا في الدعاء ؛ فقمن أن يستجاب لكم অর্থাৎ, তোমরা সিজদায় বেশী বেশী দু'আ করো, যাতে তা কবুল হয়। (আবু দাউদঃ ৮৭৬)।

বান্দা যখন নিজের অসামান্য ক্ষুদ্রতার অনুভূতিভরা বিনয়াবত হৃদয় নিয়ে মহান স্রষ্টার কুদরতি পায়ে লুটিয়ে পড়ে, স্রষ্টা তখন তার মহিমাময় সত্ত্বা নিয়ে এগিয়ে আসেন। খুলে দেন তার অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা-কপাট।

প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার মুখাপেক্ষী। মানুষও। মানুষ অতি দূর্বল। স্রষ্টার সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। জীবনের পদে পদে তার ফিরে আসতে হয় স্রষ্টার দরবারেই। তাই স্রষ্টা তার মহান দরবার সদা উন্মুক্ত রেখেছেন। বিশেষ সুবিধার জন্য দিয়েছেন প্রতিশ্রুত বেশ কিছু সময়-সুযোগ।

সুবর্ণ এ সুযোগগুলো মহামহিম স্রষ্টার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য বিশেষ উপহার। কিন্তু আমাদের মন-মননে জেঁকে বসা বস্তুবাদিতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের বস্তুর সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। বস্তুর দৃশ্যত ক্ষমতার সামনে আমরা ভুলে যাই বস্তু ও তার ক্ষমতার স্রষ্টা আল্লাহকে।

অপরদিকে অবহেলা ও অসেচতনতার সর্বগ্রাসী ব্যাধি ছড়িয়ে আছে আমাদের মন-মস্তিষ্কের রগ-রেশায়। মহা সুযোগগুলো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়, কিন্তু আমরা সেদিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভুলে যাই।

অতএব প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত এ সময় ও দিনক্ষণগুলোতে আল্লাহর কাছে নিজের, প্রিয়জনের, দেশ-জাতি ও বিশ্বের মুসলমানদের জন্য তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের একান্ত চাহিদাগুলো পূরণে আল্লাহর কাছে মিনতি জানানো।

আল্লাহ আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করুন। সদিচ্ছাগুলো পুরণ করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইফতা ১ম বর্ষ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া।

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ