এস.এম. তাকী (শোয়াইব মুহাম্মদ তাকী)।।
হযরত ফকীহুল মিল্লাত রহ. বিভিন্ন সময় ছাত্র-শিক্ষক ও সালেকীনদের উদ্দেশে দেওয়া তাকরীর থেকে সংগৃহীত। বছর ঘুরে আবার আমরা পবিত্র রমাজানে উপনীত হয়েছি।
তিনি বয়ানে বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষক ঘোষণা করেন, মাগফিরাতের তালেব কেউ আছে কি, যাকে আমি ক্ষমা করব। কেউ আছে কি রিযিক প্রার্থনাকারী, যাকে আমি রিযিক দেব। বিপদগ্রস্ত কেউ আছে কি, যাকে আমি বিপদমুক্ত করব।
রমাজানের মর্যাদা জানতে হবে
অতএব প্রথমেই আমাদেরকে রমাজানের মূল্যায়ন করতে-জানতে হবে। জানতে হবে রমাজানের মর্যাদা। তবেই আমাদের জীবনে বৈপ্রবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “রমাজান সঠিক ও যথার্থভাবে আদায় হলে পুরো বছর নিরাপদে কাটবে।
রমাজানকে সঠিকভাবে পালন করার একাধিক অর্থ হতে পারে। এক. রমাজানকে সঠিকভাবে পালন করার একটি অর্থ এই যে আল্লাহ তায়ালা রমাজানে যেসব বিশেষ ইবাদত নির্ধারিত করেছেন সেগুলো সঠিকভাবে আদায় করা।
যেমন রমাজানের রোযাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে আদায় করা। রোযার যাবতীয় আদাবের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখা। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা যেন কোনো রোযা ছুটে না যায়। কারণ রোযা শুধু রমাজানেই ফরয, অন্য কোনো মাসে নয়। যে ব্যক্তি ইখলাসের সহিত সহী তরীকায় রমাজানের রোযা আদায় করে তার ব্যাপারেই আল্লাহর এই বাণী, এভাবে রোযা রাখার ফলে তোমাদের মাঝে তাকওয়া পয়দা হবে।
তাকওয়ার নিদর্শন:
একজন রোযাদারের রোযা অবস্থায় তাকওয়ার নিদর্শন এভাবে নির্ণিত হয় যে, ক্ষুধার জ্বালায় নাড়িভুড়ি ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় তবুও খাদ্য গ্রহণ করে না। পিপাসায় ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলেও পানি পান করে না। সুন্দরী স্ত্রী পাশে থাকতেও জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য তার দিকে হাত বাড়ায় না। অথচ নির্জন ঘরে এ সব কিছুই তার হাতের মুঠোয় তবুও ওগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় না।
এমনকি এসব কাজ করতে কেউ কোটি টাকার লোভ দেখালেও কোটি টাকায় লাথি দেবে কিন্তু আল্লাহর ভয়ে রোযা নষ্ট করবে না। রোযা নষ্ট না করার এই অনুভূতি ও আবেগকেই তাকওয়া বলা হয়। অর্থাৎ তাকওয়ার মানেই হলো, আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে এই ভয়ে বান্দা নিজের চাহিদাকে বিসর্জন দেওয়া।
রমাজানের বিশেষ ইবাদত:
রমাজানের বিশেষ একটি ইবাদতের নাম তারাবীহ, তারাবীহ ফরয, ওয়াজিব কিছুই নয়। হাদীসে আছে, রাসূল (সা.) যখন তারাবীহ পড়া শুরু করেন তখন জামাতের সহিত আদায় করার গুরুত্ব ছিল না। মসজিদে নববীতে চাটাই নির্মিত বিশেষ হুজরায় রাসূল (সা.) ইতিকাফ করতেন সেখানেই রাসূল (সা.) তারাবীহ পড়া শুরু করেন। এটা দেখে কিছুসংখ্যক
সাহাবী রাসূল (সা.)-এর পেছনে ইক্তিদা করেন। প্রথম দিন তাদের সংখ্যা অল্পই ছিল।
দ্বিতীয় দিন এটা জানাজানি হলে সাহাবাদের একটি বিরাট দল রাসূল (সা.)-এর ইক্তিদা করেন। তৃতীয় দিন এটা প্রচার হয়ে গেলে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.)-এর পেছনে তারাবীহ পড়তে মসজিদে নববীতে সমবেত হন। এতদ্বদর্শনে রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের এই নামায আদায় অনেক পছন্দ করেছেন, তবে আমার ভয় হয়, এটা আবার ফরয হয়ে যায় কি না! ফরয হয়ে গেলে তোমরা হিম্মত হারিয়ে বসবে, আদায় করবে না। ফলে গোনাহগার হবে।
অতএব আগামীকাল থেকে তোমাদেরকে জামাতের সহিত তারাবীহ পড়ানো হবে না। তোমরা যার যার মতো তারাবীহ পড়ে নেবে। সাহাবায়ে কেরাম ও রাসূল (সা.)-এর এই নির্দেশের তামীল করেন। হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
একদিন তিনি দেখেন, লোকেরা ছোট ছোট কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে মসজিদে নববীতে জামাতের সাথে তারাবীহ আদায় করছেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বলেন, এখন তো ওহী নাযিল হওয়ার পথ বন্ধ, এদিকে রাসূল (সা.)-এর ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহর কাছে এই জামাত পছন্দনীয়।
অতএব এখন থেকে তারাবীহর নামায সকলে একই জামাতে একই ইমামের পেছনে আদায় করবে। কারণ এখন আর ফরয হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর ইমাম হবেন হযরত উবাই বিন কাব। যাকে স্বয়ং রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর তেলাওয়াত করার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। হযরত উমর (রা.)-এর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হযরত উবাই (রা.)-এর ইমামতিতে সকলে একসাথে তারাবীহ পড়া শুরু করেন, এ দৃশ্য দেখে হযরত উমর (রা.) বলেন, এটা কতই না সুন্দর একটি কাজ। এর পর থেকেই আবার তারাবীহ জামাতের সহিত একত্রে পড়ার ধারাবাহিকতা আরম্ভ হয়, ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে।
তারাবীহর রাকআত সংখ্যা:
যেদিন থেকে জামাতের সহিত তারাবীহ শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই তারাবীহ ২০ (বিশ) রাকআত পড়া হচ্ছে এটাই সকল সাহাবীর এক্যবদ্ধ আমল। স্বয়ং রাসূল (সা.) থেকেও বিশ রাকআত তারাবীহ প্রমাণিত, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) রমাজানে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়তেন এবং বিতির আদায়
করতেন। (ইবনে আবী শাইবা- ২/৩৯৪, ইলাউস সুনান ৫/১৯৫৯)।
এখন কিছু কিছু লোককে দেখবেন তারা বেশিক্ষণ মসজিদে থাকতে চায় না, পুরো কোরআন তারাবীতে শুনতে চায় না। রাসূল (সা.)-এর অনুসরণ এবং সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণ না করে আট (৮) রাক'আত তারাবীহ পড়ে মসজিদ থেকে দৌড়ঝাপ করে বের হতে শুরু করে, ফলে মসজিদের শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে, দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা ।
আল্লাহ সকল মুসলমানকে তাদের ফেতনা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহ তা'আলা রমাজানের দিনের বেলা রোযা রাখা ফরয করেছেন আর আমি রমাজানের রাতে তারাবীহ পড়া তোমাদের জন্য সুন্নাত হিসেবে নির্ধারণ করেছি।
ফরয রোযা ও তারাবীহ রমাজানের বিশেষ ইবাদত, কারণ রমাজান ছাড়া অন্য কোনো সময় ফরয রোযা নেই এবং জামাতের সহিত নফল আদায়ের বৈধতাও নেই। সুতরাং সঠিকভাবে রমাজান পালন করার প্রথম উদ্দেশ্য এটাই যে, বিশেষ এই ইবাদতগুলোকে যথাযথভাবে আদায় করা। এখানে একটি মাসআলা জেনে নেওয়া ভালো। সেটি হলো তারাবীহের নামাযে যে সকল হাফেজ সাহেবান খতমে কোরআন করেন তাদের কোনো ধরনের বিনিময় দেওয়া চাই সেটি কালেকশন করে দেওয়া হোক বা কারো পক্ষ থেকে এককভাবে হাদিয়া হিসেবে দেওয়া হোক কিংবা অন্য কোনোভাবে- শরীয়ত মতে তা বৈধ নয়। যদি টাকা পয়সা ছাড়া কোরআন খতম করনেওয়ালা হাফেজ সাহেব পাওয়া না যায় তাহলে সূরা তারাবীহ পড়াই উত্তম।
দুই. সঠিকভাবে রমাজান পালনের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, রমাজানে প্রত্যেকেই বিশেষভাবে এদিকে খেয়াল রাখা যেন কোনো প্রকার গোনাহের কাজে লিপ্ত না হয়। কারণ এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে অন্য দিনগুলোতে যে কাজগুলো বৈধ ছিল রোযাবস্থায় তো সেগুলোকে হারাম করে নিল। যেমন, খানাপিনা, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি।
কিন্তু অন্য সময় যে কাজগুলো হারাম ছিল সেগুলো রোযা অবস্থায়ও বর্জন করল না। যেমন রমাজানের আগেও মিথ্যা বলা হারাম ছিল, কিন্তু রমাজানেও মিথ্যা বলা ছাড়ল না। ঘুষ গ্রহণ করা আগেও হারাম ছিল, কিন্তু রোযাবস্থায়ও তা পরিত্যাগ করল না। সুদ খাওয়া আগেও হারাম ছিল, কিন্তু রামাজানেও তা থেকে বিরত রইল না। গীবত-পরনিন্দা সব সময়ই হারাম, কিন্তু রমাজানেও তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল না। বিনা কারণে যে কাউকে কষ্ট দেওয়া অবৈধ, কিন্ত রমাজানে এসেও নিজের অনিষ্ট থেকে কাউকে পরিত্রাণ দিল না। এভাবেই অনেকে মাহে মুবারকের পবিত্রতা নষ্ট করে চলেছে। কপাল পোড়ারাই এ ধরনের কাজ করতে পারে।
গোনাহ রমাজানের পবিত্রতার বিরোধী:
রোযা রেখেও যদি এসব গোনাহ করা হয় তাহলে তা হবে রমাজানের পবিত্রতার বিরোধী। এ রকমভাবে গীবত, মিথ্যা ও সুদ-ঘুষ বর্জন করলাম না, কুদৃষ্টি পরিত্যাগ করলাম না, পরনারীর প্রতি দৃষ্টি করা থেকে চোখের হেফাজত করলাম না। মনে রাখবেন, ঘরে টেলিভিশন রেখে চোখের গোনাহ ও কানের গোনাহ থেকে বাচা অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলছি। এসি চালিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করার জন্য প্রথমেই ঘরের দরজা, জানালা, ফাক-ফোকর বন্ধ করতে হবে। এরপর এসি চালালে ঘরের ভেতরের পরিবেশ ঠাণ্ডা হবে।
কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি ঘরের দরজা-জানালা, ফাক-ফোকর বন্ধ না করে এসি চালায় তাহলে এসির কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। ঘর ঠাণ্ডা হবে না। তদ্রুপ রোযার বিষয়টি, রোযা নামক এসি চালালেন, কিন্তু চোখের জানালা খুলে রাখলেন, কানের জানালা খুলে রাখলেন,মুখের দরজা উন্মুক্ত করে রাখলেন, হালাল-হারামের পার্থক্য না করে যা পেলেন তাই খেলেন, বলুন তো! কী ফায়দা হবে? রোযা আমাদের ওপর ফরয করা হয়েছে তাকওয়া লাভের জন্য। আর তাকওয়া তখনই লাভ হবে, যখন রোযাবস্থায় হালালের সাথে হারামকেও পরিত্যাগ করতে পারব। যদি রমাজানেও এসব গোনাহ করতে থাকি তাহলে পবিত্র মাহে রমাজান যথার্থ সঠিকভাবে পালন করেছি, এটা কীভাবে বলব? এ মাসের
পবিত্রতা রক্ষা করতে পেরেছি-কোন যুক্তিতে দাবি করব? অতএব শুধু রমাজানের জন্য হলেও এ মর্মে দৃঢ় সংকল্প করুন যে ভূল জায়গায় চোখ উঠাব না, কান দিয়ে অবৈধ কিছু শুনব না, মুখের গোনাহে লিপ্ত হব না, হারাম খাব না, গীবত করব না, মিথ্যা বলব না, চোগলখোরী করব না, ঘুষ দেব না/ নেব না, সুদি লেনদেনে জড়াব না, কাউকে কষ্ট দেব না, কারো অনিষ্ট করব না। যদি মাহে রমাজান এভাবে কাটাতে পারি তবেই আমরা রাসূল (সা.)-এর বাণী “রমাজান ঠিকঠাক মতো কাটলে পুরো বছরই ঠিকঠাক থাকবে। এই হাদীসের প্রতিপাদন হব, অর্থাৎ যে ব্যক্তি গোনাহমুক্ত থেকে পুরো রমাজান ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাবে, ইনশাআল্লাহ তার আগামী বছর পুরোটাই নিরাপদে সহী-সালামতে কাটবে।
ই’তিকাফ:
রমাজানের শেষ দশ দিন হলো পুরো রমাজানের সুগন্ধি, লক্ষ্যবস্ত। এই দশকের পাচটি বেজোড় রাতের যেকোনো একটি কদরের রাত। যে রাতের ফজীলত হাজার রাতের চেয়ে উত্তম বলে কোরআনে উল্লেখ। যথার্থভাবে এ রাতটিকে পাওয়ার জন্য শেষ দশকে ইতিকাফের বিকল্প নেই। তাই ই'তিকাফ করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, যদি সুযোগ না হয়/সম্ভব না হয় তাহলে অন্যান্য ব্যস্ততা কমিয়ে একটু বেশি সময় আল্লাহর জন্য দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, অন্য সময়েরে চেয়ে তুলনামূলক বেশি মসজিদমুখী হওয়ার প্রতি গুরুতু দিতে হবে। এতটুকুও যদি কেউ করতে না পারে তাহলে সামর্থ্য থাকলে সে অন্য রোযাদার ও ইতিকাফকারীদেরকে সাহরী-ইফতার করানোর সুযোগ হাতছাড়া করবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে পবিত্র মাহে রমাজান পালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
-এটি