এইচ এম আদনান মাকসুদ ।।
রমজান মাস হলো সিয়াম সাধনার মাস। এ মাসে মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দারা রবের সান্নিধ্যে লাভের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। রব তার বান্দাদের কে ভালোবেসে তার রহমতের দরজাসমূহ খোলে দেয়। যাতে করে বান্দা ইবাদত বন্দেগী করে সহজে জান্নাতে যেতে পারে। তাইতো মহা নবি সা. সাহাবাদেরকে শাবানের শুরু থেকে রমজানের প্রস্তুতি নিতে বলতেন।
সাহাবায়ে কেরাম তুমুল প্রচেষ্টায় রমজানের দিনগুলো ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। তাদের ধারাবাহিকতায় তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, আম্মায়ে মুজতাহিদীন,সলফে সালেহীনগণ ও রমজান মাস কে গনীমতের মাস মনে করে দিনে রোজা রেখে রাতে দীর্ঘক্ষণ তারাবি নামাজে কোরআন তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন।
আমাদের আকাবীরে রমজান ও সমসাময়িক উলামায়ে উম্মতের ক একজন প্রিয় মানুষের রমজানের সিয়াম সাধনার নজির লিপিবদ্ধ করছি আমাদের আত্মার খোরাকের জন্য।
১. হজরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান শায়খুল হিন্দ রহ. সারাদিন রোজা রেখে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। ইফতার করার পর কিছু সময় রেস্ট নিয়ে তারাবির জন্য প্রস্তুতি নিতেন।
তারাবির পর ফজর পর্যন্ত সারা রাত্রি নফল নামাজে লিপ্ত থাকতেন। এমনকি কয়েকজন হাফিজের সাথে পরস্পর কোরআন শুনাতেন।
২. আল্লামা খালীল আহমদ শাহরানপুরী রহ. এর রোজার সাহরি, ইফতার ও রমজান মাসের কারগুজারী।
মাওলানা জাকারিয়া রহমতের বলেন, আমি স্বয়ং আমার শায়েখকে দেখেছি, তিনি বার্ধক্যের কারনে অতি দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও রমজান মাসে মাগরিবের পর নফল নামাজে সোয়া পারা পড়িতেন। তারপর আধা ঘণ্টা খানাপিনায় সময়, এশাও তারাবি নামাজে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ও মদিনা যাবার পর প্রায় তিন ঘন্টা ব্যয় করিতেন।
তারপর কিছু সময় আরাম করে তাহাজ্জুদে দীর্ঘ সময় তেলাওয়াত করতেন। সুবহে সাদিকের আধা ঘণ্টা পূর্বে সাহরি খেয়ে ফজর পর্যন্ত তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন।
ফজর নামাজ পড়ে এশরাক পর্যন্ত মোরাকাবায় লিপ্ত থাকতেন। এশরাকের পর এক ঘন্টা আরাম করে বেলা বারোটা পর্যন্ত বিখ্যাত 'বজলুল মাজহুদ'গ্রন্থটি লিখতেন এবং চিঠি পত্রের উত্তর দান করিতেন। জোহরের পর থেকে আছর পর্যন্ত তেলাওয়াত এরপর মাগরিব পর্যন্ত তাছবীহ পাঠে লিপ্ত হতেন।নফল নামাজ সারা বছর আদায় করতেন তবে রমজানে লম্বা রাকাআতে আদায় করিতেন।
৩. শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী রহ. এর দরবারে রমজান মাসে শুধু কোরআন তেলাওয়াত হয়তো এমন কী চিঠি পত্রের আদান প্রদান ও সাক্ষাত্ একেবারে বন্ধ ছিল। দু একজন খাস খাদিমের জন্য তারাবিহ পর দুই এক পেয়ালা সাদা চা পান করিবার সময় সাক্ষাত্ করার অনুমতি ছিল।
৪. আল্লামা তোফাজ্জল হক হবিগঞ্জী রহ. রমজানের ২০ রাকাত তারাবি পর সোজা রুমে চলে যেতেন। অল্প সময় বিশ্রাম নিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য প্রস্তুত হতেন। দুই তিন কোরআনে হাফেজকে পিছনে রেখে তাহাজ্জুদের ইমামতি নিজেই করতেন।
প্রথম রাকাতে এক পারা তেলাওয়াত করতেন।দুই রাকাতে দুই পারা তেলাওয়াত করতেন। সাথে সাথে চোখের পানি বুক পর্যন্ত পৌছে যেতো।জাহান্নমের কোন আয়াত আসলে শব্দ করে কান্না করতেন। দোয়ার আয়াত আসলে বারেবারে তেলাওয়াত করতেন ।এমনভাবে তেলাওয়াত করতেন যেন এই মাত্র কোরআন অবতীর্ণ হচ্ছে।
এতো সুমধুর কন্ঠে তেলাওয়াত করতেন যা গত রমজানে ও ধারাবাহিকতায় জারী ছিল। এই রমজানে মাওলার সান্নিধ্যে। জীবনে অনেক তেলাওয়াত শুনেছি কিন্তু হবিগঞ্জী হুজুরের তেলাওয়াতের মত বিরল নয়।
৫. প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান রহ. রমজানের রাতে কখনো ঘুমাতেন না। সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।ফজর পরে এশরাক পর্যন্ত ধ্যান করতেন, এরপর এশরাক পরে সকাল দশটা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতেন।
প্রশান্তির সাথে অজু গোসল সেরে জোহর পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। এরপর মাদ্রাসায় এসে কিছু সময় পত্রিকায় চোখ বুলাতেন। দামী আতর খুব পছন্দ করতেন।
বিশেষ করে রমজানে বেশি ব্যবহার করতেন। জোহরের নামাজের পূর্বে মসজিদে গিয়ে তাহাইয়াতুল মসজিদ দুই রাকাত আদায় করে সুন্নত ও তাছবীহে রত হতেন। নামাজ পড়ে আছরের আধা ঘণ্টা পূর্বে পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন।
তারপর একটু আরাম করে আছর নামাজ পড়ে তেলাওয়াত লোকদের কে শুনাতেন।এরপর তাছবীহ আদায়, ইফতার তৈরির কাজ করতেন। বড় থালে ইফতারের আয়োজন করা হতো। উনি নিজেই ইফতারের তদারকি করতেন।
নিজ সন্তানদের কে বাসায় ইফতার না করে জামেয়ায় সবার সাথে ইফতার করতে তাকীদ দিতেন। এরপর মাগরিব নামাজ, সুন্নাত, আওয়াবীন আদায় করে এশা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতেন।
এশার নামাজ, তারাবিহ, বিতর নামাজ ধীরস্থির ভাবে আদায় করে সমবেত মুসল্লিদেরকে নিয়ে কিতাব থেকে তালিম দিতেন।এবং সমসাময়িক মাসআলাহ মাসায়িল নিয়ে আলোচনা করতেন।
এরপর মাওলার কাছে দোয়া করতেন।তিনি রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন।এবং ইতেকাফরত অবস্থায় আগত মুসল্লিদের খোঁজ খবর নিতেন। ইন্তিকালের দুই বছর অসুস্থতার জন্য ইতেকাফ করতে পারেনি।
ফলে হৃদয়খরনে শিশুর মতো কানতেন। রমজান মাসে হুজুর বেশি দান সদকা করতেন।যদিও জীবিতাবস্থায় জানা না গেলেও ইন্তিকালের পর অনেকেই শিকার করছেন। আকাবিরদের জন্য ছিল অগাধ ভালবাসা ।তাই রমজানের দোয়ায় তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য চিৎকার করে কাদতেন।
এছাড়া ও বরুনার পীর সাহেব, শায়খুল হাদিস সাহেব, মুফতি আমিনী রহ. মরহুম চরমোনাই পীর, গহরপুরী সাহেব রহ ,ও বাঘার শেখ সাহেব রহ সহ দেশের বরেণ্য বুজুরগানে দ্বীনের রোজা, ইফতার, তারাবিহ, তাহাজ্জুদে তেলাওয়াত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে।
তারা কিভাবে রমজান মাস অতিবাহিত করতেন আর আমরা কিভাবে রমজানের সময় গুলো পার করছি।তারা রমজান মাস গনীমত মনে করে সারা রমজান ইবাদতে কাঠাতেন।
এমনকি অনেক বুজুর্গ সম্পর্কে জানা যায় যে,ঈদুল ফিতরের পর থেকেই রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। এসব বুজুর্গের আদর্শ চরিত্র শুধু বাহ্যিক দৃষ্টিতে পড়া বা দেখার জন্য লিপিবদ্ধ করা হয় নাই। বরং যেন আমরা প্রত্যেকেই সাধ্যমত তাদের পথে ,তাদের মতে চলতে পারি।
যাহারা দুনিয়ার বিভিন্ন ঝামেলা থেকে মুক্ত, তাহাদের জন্য কী অপূর্ব সুযোগ নই যে, তারা বছরের এগারোটি মাস বৃথা নষ্ট করে রহমতের মাসে আপ্রাণ চেষ্টা করে মরিয়া হয়ে জীবন পণ করে আল্লাহর রহমতের আশা করবে । রমজান মাস টাকে অপচয় সময় পার না করে যাতে রবের সান্নিধ্য অর্জন করতে পারি।
হে আল্লাহ্ ,আমাদেরকে আকাবীরে দ্বীন ,চরিত্র ও আদর্শের অনুগামী হয়ে চলার এবং বড়দের সিয়াম সাধনা আমাদের আত্মার খোরাক হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
হে আল্লাহ্ ,আমাদেরকে আকাবীরে দ্বীন ,চরিত্র ও আদর্শের অনুগামী হয়ে চলার এবং বড়দের সিয়াম সাধনা আমাদের আত্মার খোরাক হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, অনার্স চতুর্থ বর্ষ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, এম সি কলেজ সিলেট।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম