আওয়ার ইসলাম: রমজান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মিসর ও ফিলিস্তিনসহ আশপাশের দেশের লোকেরা লণ্ঠন জ্বালিয়ে রমজানকে স্বাগত জানান।
এটা তাদের ঐতিহ্য বিশেষ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে এ ঐতিহ্য। বিভিন্ন আয়তন এবং আকারের লন্ঠন দেখা যায়। এসবে পবিত্র কোরআনের আয়াত, বিভিন্ন বাণী লেখা থাকে। লণ্ঠনগুলো আকর্ষণীয় রঙে সাজানো হয়।
রোজা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় এসব দেশের চিত্র। বিশেষ করে মিসরের। রোজা উপলক্ষে বন্ধ থাকে নাইট ক্লাব, বার, প্রকাশ্যে পানাহার ও ধূমপান। নির্বিঘ্নে ইবাদত-বন্দেগির জন্য পরিবর্তন আসে অফিসের সময় সূচিতেও। থাকে বিভিন্ন ভোজ্য পণ্যে ছাড়। আর ক্রয়অক্ষম মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে দেওয়া হয় ‘গিফট বক্স’। যাতে থাকে আটা, চিনি, চাল, পাস্তা, তেল, দুধ ও খেজুরসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী।
রমজান শুরুর আগে বিভিন্ন মসজিদে, ব্যস্ততম সড়কের পাশে বড় বড় তাঁবু স্থাপন করা হয়। এসব তাঁবুতে শত শত মানুষের জন্য ব্যবস্থা করা হয় ইফতারের। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ইফতার করানো মিসরীয়দের ঐতিহ্য। রোজাদারের আতিথেয়তায় নিজেদের উজাড় করে দেন মিসরীয়রা। হজরত মুসা (আ.), হজরত হারুন (আ.) ও হজরত ইউসূফ (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত মিসরে কামানের গোলার শব্দে শুরু করা হয় ইফতার।
কিন্তু চলতি রমজানে এসবের কোনো কিছুই নেই। নেই কামানের গোলার আওয়াজ, লণ্ঠনের আলো, রাস্তার পাশের তাঁবু। সব কিছু কেড়ে নিয়েছে করোনা মহামারির প্রকোপ। চলছে দেশটিতে লকডাউন। তার পরও কিছু কিছু বাড়ির সামনে লন্ঠন দেখা গেছে। তবে এর পরিমাণ খুব বেশি নয়।
আল জাজিরাকে মিসরের রমজান ঐতিহ্য নিয়ে এভাবেই বলছিলেন আবদেল ফাতেহ। তার মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। রোজার প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার সামর্থ্য রয়েছে খুব কম মানুষেরই। যদিও রমজান উপলক্ষ্যে লকডাউন কিছুটা শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে মিসর সরকার। আফ্রিকা মহাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ঘটে মিসরেই।
আবদেলের প্রত্যাশা, সময় দ্রুত বদলাবে, আবারও আমরা পুরোনো ঐতিহ্যমতে উৎসবমূখর পরিবেশ পালন করবো রমজান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মিসরে ফাতেমি খেলাফতের সময়, ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রমজান মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য রমজানের বাতি, লণ্ঠন বা ফানুস প্রজ্বলিত করার প্রচলন ঘটে। লণ্ঠন দিয়ে এভাবে রমজানকে স্বাগত জানানোর রীতি আর কোথাও চোখে পড়ে না।
মিসরে রমজানের সময় রাস্তাঘাট, দোকানপাট রঙিন ফানুস দিয়ে সাজানো হয়। রমজানকে স্বাগত জানানো হয় রঙিন ফানুস, লণ্ঠন ও রঙিন আলো জ্বালিয়ে। বিদ্যুৎ আসার আগে কেরোসিনের বাতি জ্বালানো হতো। শত বছর আগে অবশ্য গ্যাসের লণ্ঠনের ব্যবহার শুরু হয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মিসরীয়রা প্রথম রমজানের ফানুস ব্যবহার করেছিল ৩৫৮ হিজরির (২৪ জুলাই ৯৬৮) ৫ রমজান তারিখে। ওই দিন ফাতেমি খলিফা আল মুয়িজ রাতে কায়রো প্রবেশ করেন। স্থানীয়রা বাতি, মোমবাতি এই সব নিয়ে তাকে স্বাগতম জানায়। যাতে বাতাসের বেগে নিভে না যায় সে জন্য মোমবাতিকে কাঠের ফ্রেমে রেখে কয়েকটি দিক বন্ধ করে দেয় পামপাতা ও চামড়ার টুকরা দিয়ে। সেই থেকে ফানুসের প্রচলন শুরু।
পরে অবশ্য ফাতেমি শাসনের একসময় আইন জারি করা হয়- দোকানপাট এবং ঘরবাড়ির সামনের স্থান, দোকান বা বাড়ির মালিক পরিচ্ছন্ন রাখবেন এবং রাতের বেলা রাস্তায় আলোর জন্য লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখবেন। এরপর, খলিফা আল হাকিম (৯৯৬-১০২১) আইন করেন, নারীরা রাতের বেলা ঘরের বাইরে বের হবেন না।
যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তবে বাড়ির কেউ যেন লণ্ঠন নিয়ে সঙ্গে থাকে। যেসব বাড়ির বাইরে লণ্ঠন জ্বালানো থাকত না, তাদের জরিমানা করা হতো। এর ফলে লণ্ঠন ব্যবসা রাতারাতি তুঙ্গে ওঠে, নানা সাইজের, রঙের ও কারুকাজের লণ্ঠন বাজারে বের হয়। রঙিন লণ্ঠন এখনও মিসরীয় সমাজে সমাদৃত এবং বৈঠক ঘরের শোভাবর্ধনের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়।
বিভিন্ন রকমের লণ্ঠন মিসরে পাওয়া যায়। রমজানে ও ঈদের সময় ঘর সাজাতে সব ধরনের ফানুস লোকজন পছন্দ করেন। যেমন- ‘ফানুস মোরাব্বা’র চারটি পাশ রয়েছে। যেমন- ইদেল ( সোজা), মাহরুত (বাঁকানো), আবু লোজ (বাদামের মতো), আবু ইরক (শাখার মতো) ইত্যাদি। তা ছাড়া আবু বিলাদ (পুরুষ লণ্ঠন), মোসাদ্দাস (ছয় কোণা), আবু নেগমা (তারার মতো), শাক্কিত আল বাতরিক (চাঁদের মতো) লণ্ঠনও খুবই জনপ্রিয়।
রমজানের আরও নামকরা কিছু লণ্ঠন হলো- আবু হেজাব, আবু দালিয়া, তাইয়ারা ও সারুক। সব লণ্ঠনের সেরা লণ্ঠন ‘আবু বিলাদ।’ এটা বেশ বড়। সাথে চার কোণায় চারটি ছোট ছোট লণ্ঠন ঝোলানো থাকে। এ ধরনের লণ্ঠন দিয়ে দোকান সাজানোর কাজ হয়। এর তৈরি ও ডিজাইন চলে সারা বছর। লণ্ঠন সাধারণত তাহত আল রাব, আল ঘুরিয়া, বিরকিত আল ফিল এলাকায় প্রচুর মজুদ করা হয় এবং রমজানের আগে পাইকারিভাবে বিক্রি হয়।
হাতে ঝুলিয়ে নেওয়ার লণ্ঠন ফাতেমি আমলে (দশম-১২তম শতক) খুব জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে যে আকার ও প্রকারে লণ্ঠন চালু আছে, তা ১৯ শতকের শুরুতে চালু হয়। লণ্ঠন তৈরির কারিগররা মূলত আল দারাব আল আহমার এবং বিরকিত আল ফিল এলাকায় বেশি বসবাস করেন।
অধুনা চীনা লণ্ঠনে বাজার ভরপুর। ব্যবসায়ীরা সস্তায় নানা রঙের চীনা ফানুস বাজারে ছাড়েন। চীনা লণ্ঠন মিসরের বাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ১০ বছর আগে। এগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চীনা ফানুসগুলোতে ফেরাউন, পিরামিড ও প্রাচীন মিসরের দেবদেবীর প্রতিকৃতি বেশি স্থান পেত। এসব রমজানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই ধর্মভীরু মুসলমানরা এ ধরনের ফানুস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন। এমতাবস্থায় সরকার মিসরীয় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা এবং স্থানীয় বাজারকে রক্ষা করার জন্য চীনা ফানুস আমদানি বন্ধ করে দেন।
বর্তমানে বিভিন্ন আয়োজনে বিভিন্ন রকমের লণ্ঠন ব্যবহৃত হচ্ছে। মিসরীয় সংসদে ১৯৩০ সালে যে ধরনের আলোর ব্যবস্থা করা হয়, সেই রকমের লণ্ঠন তৈরি করে বিভিন্ন সমাবেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। জন্মদিন উদযাপনের জন্য ‘ফারুক ফানুস’ নামে বিশেষ লণ্ঠন প্রচলিত। কথিত আছে, জন্মদিনের প্রসাদ সাজানোর জন্য অতীতের রাজা ফারুক এ ধরনের ৫০০ লণ্ঠন ব্যবহার করেছিলেন।
লণ্ঠনের অবয়ব খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে টিনের একটি ক্যানের মতো ছিল দেখতে। এর ভেতর থাকত মোমবাতি। এরপর টিনের পরিবর্তে কাচ ব্যবহার শুরু হয়। এরপর কাচে ফাঁপানো অংশ সৃষ্টি করে বাতাস ঢোকানো হয়, নানা রঙ ব্যবহার করে বর্ণিল করা হয়। কোনো কোনো লণ্ঠনে আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করা হয়। লণ্ঠনের নানা রঙের আলো, চোখ ধাঁধাঁনো রঙ, আলোর ঝলকে ঝকমক করে ওঠে। মানুষ মোহিত হয়ে লণ্ঠনের মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-এটি