মাওলানা ইউসুফ নূর।।
(বক্ষমান নিবন্ধটি ইতিপূর্বে কাতার ধর্মমন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় হানাফি মাজহাব অনুসারী প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে হাম্বলী মাজহাব ও সালাফী প্রভাবিত কাতার সরকারের ভিন্ন মাজহাবের প্রতি উদার মনোভাব সকলের জন্য উদহারণ বলে আমরা মনে করি। এ উদারতা সকলের মাঝে বিকশিত হোক -এই আমাদের কামনা)
করুণাময় আল্লাহর বিশেষ উপহার মাহে রমজান। পবিত্র রমজান অত্যন্ত মহিমান্বিত কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ মাস। রমজানের রোজা ইসলামের অন্যতম রুকন বা মৌলিক স্তম্ভ। রোজা ও রমজানের ফাযায়েল মাসায়েল এবং তাৎপর্য বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করা সকল মুসলিম নর-নারীর কর্তব্য। এ মহান কর্তব্য আদায়ে সহায়তার উদ্দেশ্যেই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
রোজার পরিচিতি:
সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়তে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে রোজা বলে।
-মুখতাসারুল ফিকহিল ইসলামি,পৃষ্ঠা,৬২৩
হাদিসে রোজা ও রমজান:
১- আবূ হুরায়রা রা, থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব। রোযা ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন রোযার দিনে অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোযাদার। যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ! অবশ্যই রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিস্কের গন্ধের চাইতেও সুগন্ধিময়। রোযাদারের জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাকে আনন্দিত করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে। -বুখারী, ১৯০৪।
২- সাহল রা, থেকে বর্ণিত,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে,রোযাদারগণ কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে। -বুখারী, ১৮৯৬
৩- আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ শাইতান ও দুষ্ট জিনগুলোকে রমজানের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং এর একটি দরজাও আর খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং এর একটি দরজাও আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনঃ হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহর পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।-তিরমিজি, ৬৮২।
৪, আবূ হুরায়রা রা, থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের আশায় যে রমযানের রোযা পালন করলো তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -ইবনু মাজাহ:১৬৪১
৫,আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা,থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। আহমাদ:৬৫৮৯-সহিহ আল জামে:৩৮৮২।
রোযার উদ্দেশ্য:
পানাহার ও যৌনাচার হতে বিরত থেকে প্রবৃত্তি দমন ও সংযম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনই রোযার উদ্দেশ্ আল্লাহ বলেন: হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। আল বাক্বারাহ:১৮৩।
আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রাহ, বলেন, সিয়ামের উদ্দেশ্য হল পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদা সমূহের মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠা করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহন করে। ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছায় ভাটা পড়ে।পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয় এবং দারিদ্র্যপীড়িত অগণিত আদম সন্তানের অনাহারক্লিষ্ট মুখ তখন তার অন্তরে সহানুভূতির উদ্রেক করে। অন্তর বিগলিত হয় মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতায়। যাদুল মাআদ।
ইমাম গাযযালী রহ,এর ভাষায়,মানুষকে আখলাকে ইলাহী তথা ঐশ্বরিক গুণে গুণান্বিত করে তোলাই হল রোজার উদ্দেশ্য। -ইহয়াউল উলূম।
রোজার উপকারিতা:
রোজার দ্বারা একদিকে মানুষের আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও চিন্তা শক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ও রোজার উপকারিতা স্বীকৃত। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে অতিভোজন রোগের মূল আর রোজা এর অনন্য প্রতিষেধক। রোজা পালনের ফলে দেহে গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের ক্ষমতা ফিরে আসে। তাতে লিভার সুস্থ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাকস্থলী অধিক চাপ থেকে রক্ষা পাওয়ায় পেটের পীড়া উপশম হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসারের ক্ষত শুষ্ক রূপ পরিগ্রহ করে। দেহে নতুন শক্তি ফিরে আসে। এমনকি ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে এক বিশেষ সমতা সৃষ্টি করে। নেশার মোহ কেটে যায়। মাসিক মদীনা ,মার্চ,১৯৯৪।
ডাক্তার সলোমন গার্হস্থ্য স্বাস্থ্যবিধি গ্রন্থে মানবদেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করে বলেন, ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মাঝে মধ্যে ডকে নিয়ে চুল্লি হতে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমনটা আবশ্যক, উপবাস দ্বারা মাঝেমাঝে পাকস্থলী হতে অজীর্ণ খাদ্যটি নিষ্কাশিত করাও তেমনটা দরকার। মাওলানা আজমী কৃত মিশকাত বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা। এককথায় রোজার আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উপকারিতা অপরিসীম।
রোজার বিধান:
রমজানের রোজা ফরজ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান পাবে সে অবশ্যই এ মাসের রোযা রাখবে। -আল বাক্বারাহ: ১৮৫।
রোজা ইসলামের বড় রুকন তথা মৌলস্তম্ভ। ইবনু উমার রা, থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল- এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, নামাজ কায়েম করা, যাকাত দেয়া, বাইতুল্লাহর হজ্জ করা ও রমজানের সিয়াম পালন করা। মুসলিম, ২১
কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা' দ্বারা রোজা ফরজ প্রমাণিত হওয়ায় এর অস্বীকারকারী কাফের। আর যে রোজা ফরজ হওয়া বিশ্বাস করে কিন্তু তা পালন করে না সে কবিরা গুনাহগার; বেঈমান নয়। উল্লেখ্য, পাগল ও নাবালক ছাড়া সকল মুসলিম নর-নারীর উপর রমজানের রোজা ফরজ। ১০বছরের নাবালক ছেলে মেয়েদেরকে রোজার অভ্যাস করানো সুন্নাত।
রমজানের চাঁদ: রমজান মাসের চাঁদ দেখা মাত্রই রোজা রাখা ফরজ। ইবনু আব্বাস রা, থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রমযানের পূর্বে রোযা রেখ না। তোমরা রমযানের চাঁদ দেখার পর রোযা রাখা আরম্ভ কর এবং চাঁদ দেখার পর তা ভাঙ্গ। মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না গেলে তবে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। আবূ দাঊদ :২০১৬ তিরমজি: ৬৮৮।
রোজার নিয়ত:
নিয়ত অর্থ অন্তরের সংকল্প। মুখে তা উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই।রোজার নিয়ত ছাড়া সারাদিন উপবাস থাকলেও রোজা আদায় হবেনা। রমজানের রোজার নিয়ত রাতেই করে নেয়া দরকার । হানাফী মাযহাব অনুযায়ী দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত করা যায়। তবে কাজা রোজার নিয়ত রাতেই করতে হবে। রাতে রোজার নিয়ত করার পরও সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি হালাল এবং এসব কারণে রোজার নিয়ত ভঙ্গ হয় না।
যে সমস্ত কারণে রোজা ভেঙ্গে যায়:
কানে বা নাকে ওষুধ দেওয়া। ইচ্ছা করে মুখ ভরে বমি করা। কুলি করার সময় অসতর্কতাবশত গলায় পানি চলে যাওয়া। এমন কিছু গিলে ফেলা যা মানুষ খায় না বা ওষুধ হিসেবেও সেবন করে না যেমন কংকর পয়সা ও কাঠ ইত্যাদি।
বিড়ি সিগারেট বা হুক্কার ধোঁয়া সেবন করা। লোবান আগরবাতি জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া গ্রহণ করা। নাকে নস্যি টানা। কানে তেল ঢালা ও পায়খানার জন্য ঢুস নেওয়া। ভুলে পানাহার অথবা স্ত্রী সহবাস করার পর রোজা ভঙ্গ হয়েছে মনে করে আবার এসব করা। রাত বাকি আছে ভেবে ফজরের পর পানাহার করা কিংবা ইফতারের সময় হয়েছে মনে করে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতারি করা।
দাঁত থেকে নির্গত রক্ত গিলে ফেলা (যদি তা থুতুর বেশি হয়) হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হওয়া। প্রস্রাবের রাস্তায় ঔষধ প্রবেশ করানো। মুখে পান গুল ইত্যাদি রেখে ফজরের পর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকা।
এসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং পরে শুধু কাযা করতে হয়। কাফফারা দিতে হয় না। মনে রাখা উচিত, ভুল করে পানাহার স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গের অন্যান্য কারণ পাওয়া গেলেও রোজা ভঙ্গ হয় না। তবে স্মরণ হওয়া মাত্রই বিরত হতে হবে। -আহকামে যিন্দেগী ও বেহেশতি যেওর।
রোজার কাফফারা:
ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ও যৌন সঙ্গমের ফলে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি দিতে হয়। কাফফারা আদায়ের জন্য দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে হবে। মাঝে কোনো কারণবশত: বাদ পড়ে গেলে আবার নতুনভাবে শুরু করতে হবে। তবে মাঝখানে হায়েজ হলে তা ধর্তব্য।
কিন্তু পবিত্র হওয়ার পরদিন থেকেই বাকিগুলো রেখে পূরণ করতে হবে। নেফাস, রোগ, কিংবা অন্য কোন কারণে মাঝখানে রোজা রাখতে না পারলে তা মাফ হবে না। আবার নতুন করে দুই মাস রোজা রাখা ওয়াজিব। যদি কাফফারা রোজা রাখার শক্তি না থাকে তাহলে ৬০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মিসকিনকে দু'বেলা পেট ভরে খাওয়াতে হবে। মনে রাখা দরকার, এক রমজানে একাধিক রোজা ভেঙ্গে থাকলে একটিমাত্র কাফফারা ওয়াজিব হবে। তবে যে কয়টি ভেঙেছে তার পুরো কাযা করতে হবে। বেহেশতি যেওর।
জরুরী মাসআলা:
এক দেশে রোজা শুরু করার পর অন্য দেশে চলে গেলে সেখানে আগে ঈদ হয়ে গেলে প্রথম দেশের হিসেবে যে কয়টি রোজা বাদ পড়েছে তার কাযা করতে হবে আর দ্বিতীয় দেশে গিয়ে রোজা দু-একটা বেড়ে গেলে তা রাখতে হবে। আহকামে যিন্দেগী
যা মাকরুহ নয়:
মিসওয়াক করা দাড়ি-গোঁফ মাথা ও শরীরে তেল মালিশ করা। চোখে ঔষধ বা সুরমা ব্যবহার করা। গরম বা পিপাসার তীব্রতা কমানোর জন্য গোসল করা। যে কোন প্রকারের ইনজেকশন বা টিকা নেয়া। অনিচ্ছাকৃতভাবে মশা মাছি বা ধোঁয়া গলার ভেতরে প্রবেশ করা। নিজের থুথু জমা না করে গিলে ফেলা। স্বপ্নদোষ হওয়া। দাঁতের রক্ত পড়া ( যদি গলার ভেতরে না যায়) এসব কারণে রোজা ভঙ্গ কিংবা মাকরুহ হয় না।বেহেশতি যেওর।
যেসব কারণে রোজা না রাখা বা ভেঙ্গে ফেলার অবকাশ আছে:
অভিজ্ঞ ধর্মপ্রাণ ডাক্তারদের মতে রোজার কারণে রোগ বেড়ে যাওয়ার কিংবা নতুন রোগ দেখা দেয়ার অথবা রোগ মুক্তি বিলম্বিত হওয়ার আশংকা থাকা। শরীয়ত সম্মত সফরে থাকা। গর্ভবতী বা দুগ্ধ দায়িনী মহিলার রোজার কারণে নিজের বা সন্তানের জীবনের আশঙ্কা বোধ করা। হায়েজ-নেফাছ শুরু হওয়া। অত্যাধিক ক্ষুধা বা পিপাসায় প্রাণের আশঙ্কা দেখা দেয়া। অজ্ঞান কিংবা উম্মাদ হয়ে যাওয়া। এসব অবস্থায় ছেড়ে দেয়া রোজাগুলো পরে কাযা করতে হবে। আহ্কামে যিন্দেগী।
রোযার ফিদয়াহ বা ক্ষতিপূরণ:
অতি বৃদ্ধ হওয়ার কারণে রোজা রাখতে অক্ষম হলে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি রোগ হলে এবং সুস্থ হওয়ার কোন আশা না থাকলে এমন ব্যক্তির জন্য প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে ফিদয়াহ আদায় করা জায়েজ আছে। প্রত্যেকটি রোজার পরিবর্তে ফিতরা পরিমাণ পণ্য বা তার মূল্য দান করাই হলো এক রোজার ফিদয়াহ। কোন ব্যক্তি রোজার কাজা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে ওয়ারিশগণ তার রোজার ফিদয়াহ্ আদায় করবে। মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত থাকলে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ফিদয়াহ্ আদায় করা হবে। ওসিয়ত না করে থাকলে ওয়ারিশগণ স্বেচ্ছায় আদায় করলে তা কবুল হওয়ার আশা করা যায়।
সেহেরী সেহরি খাওয়া সুন্নাত।
আনাস রা,থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও। কেননা সেহরীর মধ্যে রয়েছে বরকত। তিরমিজি:৭০৮
সুবহে সাদিক উদয়ের আশঙ্কা না হওয়া পর্যন্ত দেরি করে সেহরি খাওয়া মুস্তাহাব। দুঃখের বিষয়, অনেকেই বর্তমানে মধ্য রাতে সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়ে এবং ফজরের নামাজ না পড়ে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে। এটা কবীরা গুনাহ। ফরজ নামাজ সময় মত আদায় না করে রোজা ও সেহরির বরকত তালাশ করা বোকামি মাত্র।
ইফতার: সূর্য ডুবে যাওয়ার পর বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ইফতার করা মুস্তাহাব।
সাহল ইবনু সাদ রা, থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: লোকেরা যতদিন শীঘ্র ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।বুখারি,১৯৫৭
ইফতারির ব্যবস্থা করা: রোযাদারদের ইফতার করোনো অশেষ সওয়াবের কাজ।
যায়দ বিন খালিদ আল-জুহানী রা, থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করায়, তার জন্য রয়েছে ইফতারকারীদের সমান সওয়াব ।তবে একারণে ইফতারকারীদের সওয়াবে ও কোন ঘাটতি হবে না। ইবনু মাজাহ: ১৭৪৬
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বময় দূর্যোগ চলছে। লকডাউনের ফলে দেশে ও প্রবাসে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনাহারের সম্মুখীন।মাহে রমজানে তাদের কাছে ইফতার ও আহার সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার সওয়াব অনেক বেশি- এতে কোন সন্দেহ নেই।
রমজানের কতিপয় আমল:
মাহে রমজান হচ্ছে ইবাদতের বসন্তকাল।নেক আমলের মাধ্যমে এর প্রতিটি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করা উচিত। ফরজ রোযার পাশাপাশি রমজানে আরো কতিপয় আমলের সবিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং বিপুল সওয়াব রয়েছে। সেগুলো হলো
তারাবি ও তাহাজ্জুদের নামাজ: আবু হুরাইরাহ রা, বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কিয়াম (তারাবিহ ও তাহাজ্জুদের নামাজ) আদায় করবে তার পূর্বেকার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। -বুখারি,২০০৯,মুসলিম:৭৫৯।
কুরআন তিলাওয়াত: আল্লাহ ইরশাদ করেন, রমজান সেই মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল বাক্বারাহ,১৮৫।
ইবনু আব্বাস রা,বলেন: রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে জিব্রাইল আ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে কুরআন শোনাতেন। বুখারি:১৯০২।
সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীন এ মাসে কুরআন তিলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। হযরত উসমান রা. রমজানে প্রত্যেকদিন কুরআন খতম দিতেন। ইমাম শাফেয়ী রহ, রমজানে ৬০ বার কুরআন খতম করতেন। কাতাদাহ রা. প্রত্যেক সপ্তাহে এক খতম করতেন। অতএব, পবিত্র রমজানে কুরআনের তিলাওয়াত ঔ অধ্যয়ণে মনোনিবেশ করতে হবে। আর যারা শুদ্ধ করে কোরআন পড়তে জানে না, এ মাসে কুরআন শেখার ব্যাপারে তাদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। কুরআন নাযিলের মাসে কুরআনের নিবিড় সান্নিধ্যে আসার ব্যাকুলতা সকলের মাঝে সৃষ্টি হওয়া দরকার। মাজালিসে রামাদান।
উমরাহ: ইব্নু আব্বাস রা, থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: রমজান মাসে একটি উমরাহ আদায় করা একটি ফরজ হজ্জ আদায় করার সমান অথবা বলেছেনঃ আমার সাথে একটি হজ্জ আদায় করার সমান। -বুখারি:১৮৬৩
ইতিকাফ: আবদুল্লাহ্ ইব্নু উমর রা, থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। -বুখারি:২০২৫
দান-খয়রাত: ইব্নু আব্বাস রা, থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমজানে তিনি আরো অধিক দান করতেন।বুখারী, ১৯০২,মুসলিম:২৩০৮
অতএব,মানবতার এই ক্রান্তিকালে রাসূলের আদর্শ অনুসরণে গরিব, আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত প্রতিবেশী, দুস্থ মানবতা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে মুক্তহস্তে দান করা উচিত। রমজানের শিক্ষা,নবীপ্রেমের দাবী ও জাতীয় কর্তব্য মনে করে সকলের এ ব্যাপারে অধিকতর সক্রিয় হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
রমজানের শেষ দশ দিন: রমজানের শেষ দশ দিন অত্যন্ত মর্যাদা ও অনন্য ফযিলতের অধিকারী। মুক্তিকামী সকল নর-নারীর এ দিনগুলোতে ইবাদতের ব্যাপারে সর্বোচ্চ যত্নবান থাকা চাই। নবীজীবন আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। হযরত আয়শা রা, বলেন, রমজানের শেষ দশ দিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদতের জন্য যে পরিশ্রম করতেন তা অন্য সময়ে করতেন না। মুসলিম :১০৭৫
লাইলাতুল ক্বদর: রমজান ও বছরের সবচেয়ে মর্যাদাবান রজনী হচ্ছে লাইলাতুল ক্বদর। কুরআনে এই রাতের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করে একটি স্বতন্ত্র সূরা নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন: লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
সূরা আল ক্বাদর:৩
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায় যে ব্যক্তি ঈবাদত করবে তার পূর্বের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বুখারি:১৯০১,মুসলিম:৭৬০
লাইলাতুল ক্বদর অস্পষ্ট কেন? হাজার মাসের চেয়ে ও শ্রেষ্ঠ লাইলাতুল ক্বদর কোন্ রাতে তার সুনির্দ্দিষ্ট বর্ণনা পেয়ে ও আমরা হারিয়েছি।তার কারণ দুই মুসলিমের বিবাদ। হাদিসটি পড়ুন!
আবু সাঈদ খুদরী রা,বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,হে লোক সকল! আমাকে ক্বদরের রাত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং আমি তোমাদের তা জানানোর জন্য বের হয়ে এলাম। কিন্তু দু’ ব্যক্তি পরস্পর ঝগড়া করতে করতে উপস্থিত হল এবং তাদের সাথে ছিল শয়তান। তাই আমি তা ভুলে গেছি। অতএব তোমরা রমজান মাসের শেষ দশ দিনে তা অন্বেষণ কর। মুসলিম: ২৬৬৪।
আবু সাইদ খুদরী রা,বর্ণিত অপর হাদীসে এ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমরা রমজানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্বদরের সন্ধান করো। মুসলিম:২৬৬২।
উলামা হযরাত ও সুধী মহল চিন্তা করুন,দুই মুসলিমের বিরোধের কারণে উম্মতের কত বড় ক্ষতি হলো!!অধচ আজ অনৈক্য ও বিবাদ যেন আমাদের ইবাদতে পরিণত হয়েছে।ফেসবুকের অভিশাপে নফল সংক্রান্ত মতপার্থক্য ও মতবিরোধে রূপ নিয়ে মমত্ববোধ হরণ করছে। আজাবকালীন সময়ে ও আমরা আত্মকলহে মশগুল ।আল্লাহর পানাহ।
লাইলাতুল ক্বদরের দোয়া: ক্বদরের রাতে এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়া সুন্নাত: اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني
হে আল্লাহ নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করা তোমার পছন্দ । অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও। ইবনু মাজাহ:৩১৯৯
লেখক: ইমাম-খতিব ও মুবাল্লিগ,কাতার ধর্মমন্ত্রণালয়, নির্বাহী পরিচালক, আলনূর কালচারাল সেন্টার,কাতার
-এটি