মাওলানা সাইফুল ইসলাম: আল্লাহ তায়ালা বলেন হে ঈমানদার গন তোমাদের উপর সিয়াম কে ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।
সিয়াম একটি আরবি শব্দ যার মূল অর্থ বিরত থাকা, শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদেক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়াতে পানাহার এবং স্ত্রী গমন থেকে বিরত থাকা কে সিয়াম বলে।
রোজারর উদ্দেশ্য
আমাদের উপর রমজান মাসের রোজাকে ফরজ করা হয়েছে এ কারনে যে, আমরা যেন মুত্তাকী হতে পারি। আল্লাহ তায়ালা মানুষ কে ফেরেশতা ও চতুষ্পদ প্রাণীরর মাঝামাঝি করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মাঝে যেমনি ভাবে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন তেমনি ভাবে চতুষ্পদ প্রাণীরর বৈশিষ্ট্য ও দিয়েছেন।
আকল হলো ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য আর শাহওয়াত হলো চতুষ্পদ প্রাণীর বৈশিষ্ট্য। মানুষের মাঝে এই উন্নত ও অনুন্নত উভয় গুন দুটির সমষ্টি ঘটানোর বড় একটি উদ্দেশ্য হলো মানুষ কে পরিক্ষা করা।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী বলেন, একজন মানুষ যখন আকল কে ভুলে গিয়ে শাহওয়াতের মাঝে ডুবে যায় তখন সে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাক্তিতে পরিণত হয় এমনকি একসময় সে আর আশরাফুল মাখলুকাত থাকেনা, বরং সে চতুষ্পদ প্রাণীরসাথে মিশে যায়, এমনকি কখনো কখনো চতুষ্পদ প্রাণীকেও হার মানায়। পক্ষান্তরে যখন সে আকলের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে শাহওয়াত কে দমন করতে থাকে তখন সে সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয় এমনকি একসময় সে মর্যাদায় ফেরেশতাদেরও উপরে চলে যায়।
মানুষকে মূলত ফেরেশতাদের উপরে মর্যাদা দেওয়ার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আমরা উপরের আলোচনা দ্বারা বুঝতে পারলাম যে, আকলের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মর্যাদায় ফেরেশতাদের উপর যাওয়াই হলো মানুষের মূল লক্ষ ও উদ্দেশ্য।
আমরা মানুষ অনেক দুর্বল যার স্বীকৃতি দান কারি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন " মানুষ কে দুর্বল করে সৃষ্টি করা" এ আয়াতে দুর্বলতার দ্বারা শাহওয়াত দমনের দুর্বলতাই উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তায়ালা জানতেন যে, মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই পরিপূর্ণ ভাবে তাদের লক্ষ ও উদ্দেশ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবেনা। তাই আমাদের উপর সিয়াম সাধনা কে ফরজ করেছেন। যার মাধ্যমে অটোমেটিক আমাদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য পৌছা সহজ হয়ে যাবে।
প্রত্যেকটা জিনিষের একটা মূল উৎস থাকে আর এই শাহওয়াত বা কু প্রবৃত্তির মূল উৎস হলো পেট/পাকস্থলী। পেট যখন পূর্ণ থাকে তখনি তার থেকে সৃষ্টি হয় যৌন চাহিদা যার কারনেই মানুষ বিবাহের মুখাপেক্ষী হয়।
এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের প্রয়োজন বাড়তে থাকে। আর যখন কারো প্রয়োজন বাড়ে তখন তার মাঝে মাল সম্পদ অর্জনের ফিকির শুরু হয়। কারন মাল সম্পদ ছাড়া প্রয়োজন পুরা করা সম্ভব নয়। আর একজন মানুষ যখন সম্পদের পিছে পড়ে তখন সে নিজের অজান্তেই গুনাহের সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করে।
যেমন- তার মধ্যে শুরু হয় প্রভাব প্রতিপত্তির লোভ কারন প্রভাব প্রতিপত্তি ছাড়া মাল অর্জন করা বড়ই দুস্কর। এবং একসময় সে অহংকারী হয়ে উঠে, ধন সম্পদে তার থেকে নিচু লোকদের কে ছোট মনে করে এবং ঘৃণা করতে থাকে। তার থেকে বেশী সম্পদশালীদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে, এমনকি একসময় তাদের সাথে শত্রুতা করতে থাকে এভাবে তার মধ্যে হাজারো পাপের সূচনা হতে থাকে যা সবকিছুর মূল হলো এই পেট।
সুতরাং বুঝাগেল পেট যখন দুর্বল থাকবে মানুষ এসকল পাপ থেকে সহজেই বাচতে পারবে এবং সে তার লক্ষ উদ্দেশ্য পৌছতে সক্ষম হবে অর্থাৎ- মর্যাদায় ফেরেশতাদের উপরে পৌঁছে পরিপূর্ণ মুত্তাকী হতে পারবে আর এটাই হলো সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য।
উদ্দেশ্য হাসিলের পথে বাধা
আমরা পূর্বের আলোচনা দ্বারা বুঝতে পারালাম যে রমজানের এই উদ্দেশ্য হাসিল হয় পেট খালি রাখার মাধ্যেমে। কিন্তু আমাদের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৎসরের অন্যান্য মাসের তুলুনায় এ মাসে আমরা বেশি আহার করে থাকি। এমনকি কারো কারো ক্ষেত্র দেখা যায় সারা বৎসরে যে পরিমাণ উৎকৃষ্ট খাবার খাওয়া হয় এই এক মাসেই তার থেকে বেশী খাওয়া হয় যার কারনে আমাদের শাহওয়াত/কুপ্রবৃত্তি দমন হওয়ার পরিবর্তে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
তাই আমরা রমজানের উদ্দেশ্য অর্জন থেকে বঞ্চিত থাকি।
আমাদের কে রমজানের ফায়দা পেতে হলে বিষয়টি অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।
ইমাম গাযালী বলেন রমজানের পরিপূর্ণ ফায়দা পাওয়ার জন্য আমাদের ঘুম ও কমিয়ে দেওয়া উচিৎ যাতে করে বেশী বেশী খুদা ও পিপাসা অনুভব করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মুত্তাকী হওয়া যায়।
রোজার ফায়দা
রোজার ফজিলত বর্ণনাতীত তার থেকে আমি দশটা উল্লেখ করছি ১. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হুযুর (সাঃ) বলেন যে ব্যক্তি ইমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখবে তার পিছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে ( বুখারী)
২. রোজাদার ব্যক্তির মুখের দূর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের থেকেও বেশী প্রিয় (মুসলিম) ৩. মানুষের প্রত্যেক আমলের ছওয়াব দশ গুন থেকে সাতশত গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওায় হয় কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেন রোজা হলো আমার জন্য আর আমি নিজেই (আমার শান মতো) তার ছওয়াব (বাড়িয়ে) দিব (মুসলিম)
৪. রোজা রখলে অন্তত পরিষ্কার থাকে। ৫. অন্তত নরম থাকে যার করনে আল্লাহর নিকটে কান্নাকাটি করা যায়।
৬. উদ্ধত ও অবাধ্যতা দূর হয়। ৭. কু প্রবৃত্তি দমন থাকে।
৮. শরীর হালকা থাকে যার কারনে ইবাদত করা সহজ হয়। ৯. খরচ কমে যায়। ১০. দুনিয়ার ব্যাপারে অল্পেতুষ্টির গুন অর্জিত হয়।
আরেফ বিল্লাহ শায়েখ আহমাদ বিন আব্দুল আহাদ শরহিন্দি রহঃ বলেন, যদি কোন ব্যক্তিকে রমজানে নেক আমল করার তাওফিক দেওয়া হয় তাহলে তাকে সারা বৎসর নেক আমলের করার তাওফিক দেওয়া হয় পক্ষান্তরে যদি কোন ব্যক্তিকে নেক আমলের থেকে বঞ্চিত রাখা হয় তাহলে তাকে সার বৎসরও নেক আমলের তাওফিক থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
রমজান মাস হলো রহমত, নাজাত ও মাগফেরাতের মাস। হুযুর সাঃ বলেছেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তির যে রমজান পাওয়ার পরেও স্বীয় গুনাহ কে মাফ করাতে পারলো না।
তাই আসুন আমরা রমজানের হক আদায় করার মাধ্যমে রোজার ফজিলতের হকদার হয়, নবীর বদদোয়া থেকে বাচি সর্বোপরি পরিপূর্ণ মুত্তাকী হই।
-এটি