পবিত্র মক্কা মুকাররমা ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত স্থান। এই জনপদের প্রতিটি বস্তুই ইসলামের বহু নিদর্শন ও ঘটনাবলীর সাক্ষী। আজকের আয়োজনে থাকছে পবিত্র এই নগরীর ঐতিহাসিক কয়েকটি মসজিদের গল্প। লিখেছেন আওয়ার ইসলামের কন্ট্রিবিউটর বেলায়েত হুসাইন।
এক. বাইতুল্লাহ বা মসজিদুল হারাম
পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফ মুসলমানদের নিকট সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান- যা পবিত্র কাবা শরিফকে ঘিরে সৌদি আরবের মক্কা মুকাররমায় অবস্থিত।
এদিকে অভিমুখী হয়ে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ তাদের প্রধানতম ইবাদত নামাজ আদায় করেন। বাইতুল্লাহ শরিফকে মসজিদুল হারাম বলেও আখ্যায়িত করা হয়। 'হারাম' শব্দের অর্থ 'অবৈধ' এবং 'পবিত্র' দুটোই হয়। পবিত্র অর্থে মসজিদুল হারাম অর্থ পবিত্র মসজিদ। আবার অন্য অর্থে, এখানে যুদ্ধ আর রক্তপাত নিষিদ্ধ বিধায় একে মসজিদুল হারাম বলে।
মসজিদুল হারামের হৃদপিণ্ডে অবস্থিত পবিত্র কাবাঘর আল্লাহ তায়ালার এক অপূর্ব সৃষ্টি। হজের মৌসুমে প্রতিবছর লাখ লাখ মুসলমান কাবাঘর তাওয়াফ করতে মক্কায় গমন করেন। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে মক্কা নগরীর অবস্থান হওয়ায় আল্লাহতায়ালা এটিকে মক্কাতেই স্থাপন করেন।
৮৮ একরেরও বেশি জায়গাজুড়ে অবস্থিত মসজিদুল হারাম পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। এখানে একসঙ্গে অন্তত ৯ লক্ষ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। হজের মৌসুমে মুসল্লি সংখ্যা ৪০ লক্ষে পৌঁছে যায়। মসজিদে সর্বমোট ৯ টি মিনার রয়েছে। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৮৯ মিটার।
দুই. মসজিদে আয়েশা
মসজিদে আয়েশা মক্কার তানঈম এলাকায় অবস্থিত। হারাম শরিফের বাইরে এটি মক্কা থেকে সর্বাধিক নিকটবতী স্থান। মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে মক্কা-মদিনা রোডে আল হিজরা এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদ থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধা হয়।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) এখান থেকে উমরার ইহরাম বেঁধে উমরা করেছিলেন। পরে সেখানে একটি বিশাল মসজিদ গড়ে উঠে। আর মসজিদটির নাম দেয়া হয় মসজিদে আয়েশা। মসজিদটি ইসলামি শিল্পনৈপুণ্যের এক অনুপম নিদর্শন।
বিশাল এই মসজিদের দু'টি মিনার ও একটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটি খেজুর গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত। তৎকালীন সৌদি শাসক খাদেমুল হারামাইনিশ শারিফাইন বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ মসজিদে আয়েশার ব্যাপক সংস্কার করেন। এবং ১০০ মিলিয়ন রিয়াল খরচ করে ৮৪ হাজার বর্গমিটারে মসজিদের সীমানা বর্ধিত করেন। একসঙ্গে অন্তত ১৫ হাজার মুসল্লি ঐতিহাসিক এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। নফল ওমরাহ পালনকারীদের জন্য মসজিদে আয়েশা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
তিন. মসজিদে মাশআরে হারাম
মুজদালিফার ময়দানে একটি ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। নাম মাশআরে হারাম। এটিকে মুজদালিফার মসজিদও বলা হয়। মুজদালিফার কুজা পাহাড়ের নিচে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অবস্থান করেছিলেন। এর সামনে মুজদালিফা ৫ নম্বর রোডের পাশে মসজিদটি অবস্থিত। প্রায় পনেরো হাজার মুসল্লি একসঙ্গে এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের পেছনের দিকে ৩২ মিটার উচুঁ দু’টি মিনার আছে। অনেক দূর থেকে মিনার দু’টি স্পষ্ট দেখা যায়।
চার. মসজিদে জিন
জিন মসজিদ মক্কার একটি বিখ্যাত মসজিদ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। তবে এটা জিনদের বানানো কোনো মসজিদ নয়, কিংবা একদিনে গায়েবিভাবে হয়েছে এমনও নয়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কা নগরীতে যে স্থানে জিনরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলো, পরে সেখানে একটি মসজিদ গড়ে ওঠে। সেটাই মসজিদে জিন নামে প্রসিদ্ধ।
অন্য বর্ণনায় আছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জিনদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়ার সময় হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) কে একটি বৃত্ত এঁকে এখানে রেখে যান এবং বলে যান আমি না আসা পর্যন্ত এই বৃত্ত থেকে বের হবে না।
মসজিদটি মক্কার পূবে হাজুন পাহাড়ের নিচে এবং হাজুন ব্রিজের পঞ্চাশ মিটার দূরে অবস্থিত। মসজিদের পাশের রাস্তার নাম জিন মসজিদের সড়ক। এই মসজিদের একটু দূরে মক্কার বিখ্যাত গোরস্থান জান্নাতুল মোয়াল্লা অবস্থিত। ৬০০ বর্গমিটারের মসজিদটি দেখতে হাজিদের ভিড় দেখা যায়।
ইতিহাসে আছে, একদিন এখানে মহানবী (সা.) নামাজ আদায়কালে আকাশপথে গমনরত একদল জিন কোরআনের অভিনবত্ব ও সুমধুর সুরে আকৃষ্ট হয়ে থমকে যায় এবং এ ঘটনা তারা তাদের জাতির কাছে গিয়ে ব্যক্ত করে।
এ ঘটনা কোরআনে বলা হয়েছে এভাবে, ‘(হে নবী) বলুন, আমার প্রতি অহি নাজিল করা হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করেছে, অতঃপর (ফিরে গিয়ে নিজ জাতির লোকদের) বলেছে; আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি। যা সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়, তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনও আমাদের রবের সঙ্গে কাউকে শরিক করবো না।' (সূরা জিন, আয়াত: ১-২)
অত:পর তারা এ মসজিদের স্থানে এসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনে ইসলাম গ্রহণ করে
পাঁচ. মসজিদে নামিরা
আরাফার মসজিদের নাম হলো মসজিদে নামিরা। আরাফার ময়দানের পশ্চিম সীমান্তে রয়েছে এই মসজিদ। মসজিদের পশ্চিম পাশে ছোট্ট একটি পাহাড় রয়েছে, যার নাম নামিরা। আরাফার দিন রাসুল (সা.)-এর তাঁবু এখানেই স্থাপন করা হয়েছিল। সূর্য ঢলার পর তিনি এরই নিকটবর্তী ওয়াদি উরানায় (উরানা উপত্যকায়) হজের খুতবা প্রদান করেন এবং নামাজের ইমামতি করেন। এটিই হলো বিদায় হজের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ভাষণ।
যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি খুতবা প্রদান করেন এবং ইমামতি করেন, সেখানে হিজরির দ্বিতীয় শতকে মসজিদ (মসজিদে নামিরা) নির্মাণ করা হয়। এই উপত্যকা (ওয়াদি উরানা) আরাফার সীমানার বাইরে। ফলে এখানে নির্মিত মসজিদটিও আরাফার সীমানার বাইরে ছিল।
পরবর্তী সময় মসজিদটি প্রশস্ত হতে থাকে। এভাবে মসজিদের পেছনের অংশ আরাফার সীমানার মধ্যে বিস্তৃত হয়। এ কারণেই মসজিদে নামিরার কিছু অংশ (পুরনো অংশ) আরাফার সীমানার বাইরে আর কিছু অংশ আরাফার সীমানার মধ্যে পড়েছে। মসজিদের ভেতরে দুই সীমানার মধ্যে বোর্ড ঝোলানো রয়েছে, যাতে লেখা আছে যে ‘এখান থেকে আরাফার সীমানার বাইরে।’
যাতে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করার পর আরাফার বাইরের অংশে নামাজ আদায়কারী হাজিরা পিছে সরে আরাফার সীমানার মধ্যে এসে উকুফে আরাফা করতে পারেন। বর্তমানে মসজিদের পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে দৈর্ঘ্য ৩৪০ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ ২৪০ মিটার। প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক এতে নামাজ আদায় করতে পারে।
সূত্র: মাক্কায়ী ডটকম ও উইকিপিডিয়া
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম