মাওলানা হাফেজ আহসান জামিল।।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, يا ايها الذين امنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون অর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন তোমাদের পূর্বসূরীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল।
এই পবিত্র আয়াতে... من قبلكم বাক্যটি পূর্বের সমস্ত শরীয়তে রোজা ফরজ ছিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। রোজা এমন একটি ইবাদত, যা শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরজ করা হয়নি। বরং এটি পূর্ববর্তী শরীয়ত, পূর্ববর্তী উম্মতের ও নবীদের উপরও রোজা ছিল।
হজরত আদম,হজরত মুসা, হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের যুগেও রোজা ছিল। কিন্ত ধরন ছিল ভিন্ন। আর তা এজন্য দিয়েছেন যাতে করে বান্দা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়াবান হতে পারে। আর এই তাকওয়ার এতই গুরুত্ব যে তাকওয়া ছাড়া তিনি বান্দার আমলের দিকে তাকাবেন না। অর্থাৎ বান্দা নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে, কিন্তু এর পিছনে তাকওয়া ছিল না। ছিল বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে দেখাবার চিন্তা। এজন্য তার কষ্ট করে হজ্জ করা, নামাজ পড়া, রোজা রাখা, যাকাত দেয়া সব বিফলে যাবে। আর তাকওয়া থাকে, দিলে যা শরীরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে আগেই আমাদেরকে বলেছেন... الا ان في الجسد مضغه اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا وهي القلب মানুষের শরীরের মধ্যে একটি গোস্ত পিণ্ড রয়েছে, যতক্ষণ তা ভালো থাকবে সমস্ত দেহ ভালো থাকবে। আর যখন উহায় পছন ধরবে সমস্ত দেহেই পছন ধরে যাবে। শুনে রাখ সেই গোশতের টুকরাই় হইতেছে ক্বলব। আর এই ক্বলবকে সুস্থ রাখার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে রোজা। আর এজন্যই আমরা যেন আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে পারি তাই দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা দান করেছেন। আর আল্লাহ তাই বলেছেন তাক্বওয়া সম্পর্কে... لن ينال الله لحومها ولا دماؤها ولكن يناله التقوى منكم আল্লাহর নিকট পৌঁছেনা কুরবানীর জন্তুর গোশত ও রক্ত। বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।
একটি হাদীসে এসেছে... ان الله لاينظر الى صوركم واموالكم ولكن ينظر الى قلوبكم واعمالكم অর্থাৎ আল্লাহ পাক তোমাদের বাহ্যিক অবয়ব বা ধন ঐশ্বয্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। তাহার দৃষ্টি তোমাদের অন্তরসমূহ আর আমলসমূহের উপর হয়ে থাকে। এছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাকওয়া সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ان المتقين فى ظلال وعيون وفواكه مما يشتهون كلوا واشربوا هنيئا بما كنتم تعملون انا كذلك نجزي المحسنين মুক্তাকিরা শীতল ছায়া ও ঝরনা বিশিষ্ট উদ্যানে নিজেদের পছন্দ মত ফল-মুলের মাঝে থাকবে । আর তোমরা যে সমস্ত আমল করেছ, তাহার বদৌলতে পানাহার করো। এমনিভাবে আমি মুত্তাকীদেরকে প্রতিদান দেই।
অন্যত্র ঘোষণা হয়েছে ان للمتقين مفازا حدائق واعنابا وكواعب اترابا وكاسا دهاقا لا يسمعون فيها لغوا ولا كذابا جزاء من ربك عطاء حسابا নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা সফল। তাদের জন্য আছে বাগ বাগিচা এবং আঙ্গুর আর পরিচ্ছন্ন সমবয়সী এবং উপচাইয়া পড়ে এমন পানীয় পেয়ালা। তাহারা তথায় অর্থহীন ও মিথ্যা কথা শুনতে পাবে না।
আর এই রমজান মাসই হলো তাকওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাস। কেননা রমজান মাসের প্রথম ভাগে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষনা করে বলেন... يا باغي الخير اقبل ويا باغي الشر اقصر অথ্যাৎ হে নেকীর প্রত্যাসী অগ্রসর হও। এবং খুব নেকীর কাজ কর। আর হে পাপের অবিলাসি এখন থেকে বিরত থাকো।
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। فتحت ابواب الجنه وغلقت ابواب النار وسلسلت الشياطين অর্থাৎ রমজানে বেহেশতের দরজা সমূহ খুলে যায়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। এবং শয়তানকে কারাগারে আবদ্ধ করা হয়। রমজানের রোজার প্রতি উদ্বুদ্ধ করিয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন। من قام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে রমজানে রোজা পালন করে, তাহার পূর্বের সমুদয় পাপ মার্জনা করা হয়।
রমজান আগমনের পূর্বেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে এ মাস সম্পর্কে বলেন. عن سلمان الفارسي رضي الله عنه قال خطبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم في اخر يوم من شعبان فقال يا ايها الناس قد اظلكم شهر عظيم شهر مبارك فيه ليله خير من الف شهر جعل الله صيامه فريضه وقيام ليله تطوعا من تقرب فيه بخصله من الخير كان كمن اد فريضه فيما سواه ومن اد فريضه فيه كان كمن ادى سبعين فريضه فيما سواه وهو شهر الصبر والصبر ثوابه الجنه وشهر المواساه
হজরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, শাবান মাসের শেষ দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন, হে লোক সকল তোমাদের নিকট উপস্থিত, একটি মর্যাদাপূর্ণ এবং বরকতপূর্ণ মাস। এতে রয়েছে এমন এক রাত যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ মাসে আল্লাহ সওম ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি এই মাসে একটি নেক কাজ করলো সে যেন অন্য কোন মাসে ফরজ কাজ করলো। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল। সে যেন অন্য কোন মাসে ৭০ টি ফরজ কাজ আদায় করল। এ মাস ধৈর্য্যের মাস। আর ধৈয্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। সহানুভূতি প্রদর্শনের মাস। (মেশকাত)
সাওমের পুরস্কার ক্ষমা। (বুখারী -মুসলিমের) হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, من صام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن قام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه- متفق عليه
যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মবিশ্লেষণের সাথে রমজানের সাওম আদায়করল। সে তার অতীতের গুনাহ সমূহ মাফ। করে নিল। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মবিশ্লেষণের সাথে রমজানে দীর্ঘ সালাত আদায় করল। সে অতীতের গুনাহ মাফ করে নিল( বুখারী )
রোযা ও কোরআন একত্রে সুপারিশ করবে- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الصيام والقران يشفعان للعبد يقول الصيام اي رب اني منعته الطعام والشهوات بالنهار فيشفعني فيه ويقول القران منعتهم النوم بالليل فشفعني فيه فيشفعان
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সিয়াম বলবে হে রব আমি এই ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যান্য কামনা-বাসনা থেকে ফিরিয়ে রেখেছি।আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আল কুরআন বলবে আমি এই ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। দুর্ভাগা রোজাদারদের সম্পর্কে হাদিসে এসেছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এমন কত রোজাদার আছে যারা তাদের রোজার দ্বারা ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পায় না। এমন কত নামাজে দন্ডায়মান অবস্থায় রাত জাঘরন কারি আছে, যারা শুধুমাত্র জাগরণ ছাড়া আর কিছুই পায় না। কিছু মানুষ শুধু শুধু কষ্ট করে।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من لم يدع قول الزور والعمل به فليس لله حاجه في ان يدع طعامه وشرابه- بخاري
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং মিথ্যার উপর আমল করা ছাড়তে পারেনি তার খাবার ও পানীয় দ্রব্য বর্জন করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
পাপের কাফফারা হবে নামায, রোযা ও যাকাত। قال حذيفه انا سمعته يقول فتنه الدجال في اهله وماله وجاره يكفرها الصلاه والصيام والصدقه
হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মানুষ তার পরিবার, সম্পদ এবং প্রতিবেশীর ব্যাপারে যে ভুল ত্রুটি করে, তার সালাত সাওম এবং সদকা দ্বারা সেগুলোর কাফফারা হয়ে যায়। (বুখারী)
ইফতারে বিলম্ব না করার কথ হাদীসে এসেছে, عن سهل بن سعد رضي الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر - بخاري
হযরত সাহল বিন সা'দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, লোকেরা যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন ভালো অবস্থায় থাকবে। (বুখারী)
ইতেকাফ, عن بن عمر رضي الله قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الا واخر من رمضان -متفق عليه ইবনে উমর রা. আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,রাসূল (সাঃ) রমযানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতেন। (বুখারী-মুসলিম) المعتكف يعتكف الذنوب ويجز ي له من الحسنات كعامل الحسنات كلها ( ابن ماجه)
মুতাকেফ তথা ইতেকাফকারী ব্যক্তি যাবতীয় গুনাহ হইতে নিজেকে মুক্ত রাখে। এবং তাকে ঐরুপ পুন্যের প্রতিদান দেয়া হয়,যেমন দেয়া হয় সর্বক্ষণ পূণ্যকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিকে।
ঈদুল ফিতর- ঈদের চাঁদ আকাশে উদয় হওয়ার সাথে সাথে মুবারক মাস রমযান শেষ। আগামি দিন ঈদের দিন, খুশি ওপুরস্কার বিতরণের দিন। যাহারা দীর্গ সাধনায় উত্তীর্ণ হইল, আর যাহারা মাস ব্যাপি রবকে সন্তুষ্ট করার জন্য আরাম আয়েশ, নিদ্রা ত্যাগ করিল, আজ তাহারা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে পুরস্কার বিতরন স্থান ঈদগাহ গমন করবে।
হাদীসে ঈদের রাতেরও বেশ ফযিলত রয়েছে,যে ব্যক্তি দুই ঈদের দিনের রজনীতে জাগ্রত থাকিয়া ইবাদাত করবে, সেই ব্যক্তি কিয়ামতের দিবসে ভয়ংকর আতংক হইতে বাচিয়া থাকবে। এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, يغفر لامته في اخر ليله من رمضان
এই রজনীতে উম্মতে মুহাম্মদীকে ক্ষমা করা হয়। কারণঃ العامل انما يوفى اجره اذا قضى عمله
শ্রমিককে কাজ শেষ করার পরই হাদীয়া দেওয়া হয়। আর একটি বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহপাক ঈদের রজনীতে ফেরেশতাদিগকে লক্ষ্য করে বলেন, يا ملائكتي ما جزاء اجري وفي عمله
হে আমার ফেরেশতাগণ যাহারা পূর্ণভাবে সাধনা করিয়াছে তাহাদের কি পুরস্কার হইবে? ফেরেশতাগণ বলিবেন হে বিশ্বজগতের প্রভু তাহাদিগকে তাহাদের পূর্ণ প্রাপ্য প্রদান করা উচিৎ তখন আল্লাহ পাক স্বীয় মর্যাদা ও ক্ষমতার শপথ করিয়া ঘোষণা করবেন, যে রোযাদারগণ قد غفرت لكم و بدلت سيئاتكم حسنات নিশ্চয়ই আমি তোমাদিগকে ক্ষমা করলাম এবং তোমাদের গুনাহসমূহ স্বভাবে পরিণত করে দিলাম فاير جون مغفور لهم অতঃপর রোযাদারগণ এমন অবস্থায় ঈদের মাঠ থেকে ফিরবে যে তাহাদের কোন গুনাহ নাই।
-এটি